হবিগঞ্জের পুলিশ কর্মকর্তা রুকনের কন্যা রুম্পা হত্যায় সৈকত ৪ দিনের রিমান্ডে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ হবিগঞ্জ শহরের চৌধুরী বাজার ফাঁড়ির পরিদর্শক রুকন উদ্দিনের মেয়ে রুবাইয়াত শারমিন রুম্পার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের কথা স্বীকার করেছেন তার বন্ধু আবদুর রহমান সৈকত। তবে রুম্পার মৃত্যুর দিনে তিনি ঘটনাস্থলের আশেপাশে ছিলেন না বলে দাবি করেছেন। রুম্পার মৃত্যুর ঘটনার সঙ্গে তিনি কোনোভাবে জড়িত নন বলেও দাবি করেছেন সৈকত। শনিবার রাতে সৈকতকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সৈকত রুম্পার সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন। ঘটনার তদন্তের স্বার্থে সৈকতকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে চার দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। তবে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর গোয়েন্দারা রুম্পার মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত কিছু বলতে পারছে না। গোয়েন্দাদের ধারণা ঘটনার দিন রুম্পার সঙ্গে দেখা হয়েছে, কথাও হয়েছে।
তাদের দুই জনের ফোনালাপের রেকর্ড থেকে এমনটি ধারণা করা হচ্ছে। তদন্ত সূত্র বলছে, সৈকতকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করলে ঘটনার বিষয়ে আরও বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যেতে পারে।
শনিবার রাতে খিলগাঁওয়ের গোড়ান এলাকা থেকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল সৈকতকে আটক করে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আসে। রুম্পার মৃত্যুর ঘটনায় গতকাল পুলিশ তার আরও ১০ বন্ধুকে ডিবি পুলিশের কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।
বুধবার রাতে রমনা থানাধীন ৬৪/৪ নম্বর সিদ্ধেশ্বরীর সার্কুলার রোডের গলি থেকে রুম্পার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে পুলিশ লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠায়।
মামলা তদন্তের প্রধান সমন্বয়কারী ঢাকা মহানগর দক্ষিণ পুলিশের ভারপ্রাপ্ত ডিসি রাজীব আল মাসুদ জানান, ‘এটা হত্যা না আত্মহত্যা তা আমরা এখনো নিশ্চিত হতে পারিনি। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট হাতে পেলে আমরা বিষয়টি বুঝতে পারবো। এছাড়াও নিহতের বন্ধু সৈকতকে রিমান্ডে আনা হয়েছে। রিমান্ডে বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে। পাশাপাশি মামলার তদন্তের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। আশা করছি বিষয়টি খুব তাড়াতাড়ি পরিষ্কার হবে।
মামলার তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঢাকা মহানগর দক্ষিণ গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, রুম্পার মৃত্যুর ঘটনার পর থানা পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেন। এরপর রুম্পার মোবাইল ফোনটি জব্দ করে কললিস্ট পরীক্ষা করা হয়। কললিস্ট পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, ঘটনার দিন থেকে আগের তিনদিনে মোট ২৪ বার রুম্পা সৈকতকে ফোন করেছেন। ঘটনার দিন রুম্পার সঙ্গে সৈকতের তিন মিনিট কথা হয়। এতে সৈকত উচ্চস্বরে কথা বলেন। রুম্পার কললিস্ট পরীক্ষা করেই ডিবি পুলিশের ধারণা আসে যে রুম্পার সঙ্গে সৈকতের একটা সম্পর্ক ছিল।
রুম্পার মৃত্যুর ঘটনা জানার পর সৈকত নারায়ণগঞ্জ এলাকায় এক বন্ধুর বাসায় আত্মগোপনে যান। কিন্তু, রুম্পার ঘটনায় তাকে আইনি জটিলতায় পড়তেই হবে এমনটি বোঝার পর তিনি গোড়ানের বাসায় চলে আসেন।
সূত্র জানায়, সৈকতকে গতকাল দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ডিবি পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের একটি টিম। নানারকম প্রশ্ন তিনি এড়িয়ে গেছেন। আবার অনেক প্রশ্ন অকপটে উত্তর দিয়েছেন। সূত্র জানায়, গত দেড় বছর ধরে রুম্পা ও সৈকতের সম্পর্ক চলে আসছিল। দুইজনের বিষয়টি সৈকতের পরিবার জানলেও রুম্পার পরিবার জানতো না। রুম্পার বাবা পুলিশ কর্মকর্তা হওয়ার কারণে এবং তাদের ওই সম্পর্ক মেনে না নেয়ার আশঙ্কায় রুম্পা তার পরিবারকে জানায়নি। তাদের সম্পর্কের বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরাও জানতেন।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সৈকত দাবি করেছেন, রুম্পাকে নিয়ে তিনি দেশের অনেক স্থানে ভ্রমণেও গেছেন।
সৈকত তদন্তকারীদের জানান, তিনি প্রথমে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ-তে পড়তেন। কিন্তু আর্থিক অনটনের কারণে তার পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায়। এতে তিনি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। পরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অন্য একটি কলেজে ভর্তি হন।
গত নভেম্বরে রুম্পা সৈকতকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন বন্ধুদের সামনে। সৈকত তা প্রত্যাখ্যান করেন। তখন রুম্পা বন্ধুদের সামনেই কেঁদেছিলেন। সৈকত রুম্পাকে ফোন না দিতে নিষেধ করলেও রুম্পা ফোন দিতেন বলে সৈকত তদন্তকারীদের জানিয়েছেন।
সূত্র জানায়, আয়েশা কমপ্লেক্সের ছাদ অথবা করিডোর থেকে রুম্পা নিচে পড়েছেন এটা প্রায় নিশ্চিত হয়েছেন মামলার তদন্তকারীরা। কারণ ওই বাসার পঞ্চমতলায় রুম্পার এক বান্ধবী তার পরিবার নিয়ে থাকেন। তদন্তকারীদের ধারণা, ওইদিন রুম্পা তার বান্ধবীর কাছে গিয়েছেন। গতকাল এ প্রতিবেদক ওই বাসায় গেলে রুম্পার বান্ধবীর পরিবারের কেউ কথা বলতে চাননি।
এদিকে ঘটনাস্থলের আরেকটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেছে তদন্তকারীরা। যে তিনটি ভবনের মাঝে রুম্পার মৃতদেহ পাওয়া গেছে, সেখানকার একটি ভবনের প্রবেশমুখে ৬টা ২৭ মিনিটে রুম্পার শারীরিক গঠনের মতো একজনকে ঢুকতে দেখা গেছে। কিছুটা অস্পষ্ট ওই ছবি। এতে সেটা রুম্পা কী-না, তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
পুলিশ সূত্র জানায়, আটকের পর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতে ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন করলে শুনানি শেষে আদালত সৈকতের ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড শুনানির সময় সৈকতের পক্ষে তার আইনজীবী আব্দুল হামিদ ভূঁইয়া আদালতে বলেন, ‘সৈকত ঘটনার বেশ কিছুদিন আগে স্ট্যামফোর্ড ইউনিভারর্সিটি ছেড়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করছেন। তাছাড়া সৈকত স্ট্যামফোর্ডে থাকাকালিন সময়ে সে বিবিএ পড়ত। তাদের ডিপার্টমেন্টও ছিল আলাদা। নিহত শিক্ষার্থী রুবাইয়াত শারমিন রুম্পার সাথে তার কোন সম্পর্ক ছিল না’। তখন কাঠগড়ায় থাকা সৈকতকে স্বাভাবিক দেখায়। তার মধ্যে কোনো বিষণœতা বা চিন্তার ছাপ ছিল না।
তদন্তকারী কর্মকর্তা রমনা জোনাল টিমের গোয়েন্দা পুলিশ পরিদর্শক মোঃ আকতারুজ্জামান ইলিয়াস এর আবেদনে আরো বলা হয়, ঘটনার দিন ৪ ডিসেম্বর বিকেল ৪টার দিকে সৈকতের সঙ্গে রূম্পার স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির সিদ্ধেশ্বরী ক্যাম্পাসের বাইরে দেখা হয়। তখন প্রেম ভালোবাসা নিয়ে কথা উঠলে আসামি সৈকত কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য রুম্পাকে অনুরোধ করলে মনোমালিন্যসহ বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত মনোমালিন্যের পর ওইদিনই রাত পৌনে ১১টার দিকে ভিকটিমকে উক্ত আসামিসহ তার সহযোগী অজ্ঞাতনামা আসামিরা মিলে হত্যা করতে ৬৪/৪ সিদ্ধেশ্বরী সার্কুলার রোডের বাড়ির ছাদ থেকে ফেলে দেয় মর্মে প্রাথমিকভাবে সন্দেহ করা হচ্ছে। মামলাটি বর্তমানে তদন্তের পর্যায়ে রয়েছে। তাই মামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে হত্যার মূল রহস্য উদঘাটনপূর্বক উক্ত হত্যাকান্ডে কারা কারা জড়িত হত্যাকারীদের প্রকৃত নাম ঠিকানা সংগ্রহপূর্বক তাদেরকে গ্রেফতার, কীভাবে ও কী কারণে উক্ত হত্যাকান্ড ঘটেছে বলে তা নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৭ দিনের রিমান্ড প্রয়োজন। রিমান্ড শুনানির জন্য বিকেল তিনটার পরপর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ মামুনুর রশিদের আদালতে হাজির করা হয় সৈকতকে। আদালতের এজলাসে তাকে নির্বিকার ও স্বাভাবিক দেখাচ্ছিল। শুনানির আগে আইনজীবীদের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সময় তার মধ্যে কোনো বিষণœতা ছিল না।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর এক প্রশ্নের জবাবে সৈকত বলেন, ‘চার-পাঁচ মাস ধরে রুম্পার সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক ছিল। সবশেষ ৪ তারিখ রুম্পার সঙ্গে তার কথা হয়। এরপর আমি বাসায় চলে যাই। এই ঘটনায় আমি জড়িত নই এবং ঘটনা সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। প্রসঙ্গত, গত বুধবার রাত ১১টার দিকে সিদ্ধেশ্বরীর এলাকার ৬৪/৪ নম্বর বাসার নিচে এক অজ্ঞাত তরুণীর লাশ দেখতে দেখতে পেয়ে স্থানীয়রা রমনা থানায় খবর দিলে ওসি মনিরুল ইসলামের নেতৃত্বে একদল পুলিশ লাশ উদ্ধার করে। তবে কে বা কারা তাকে হত্যা করেছে এ বিষয়ে কোন কিছু জানতে পারেনি পুলিশ। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে কেউ তাকে ধর্ষণ করার পর ওই ৫ তলা ভবনের উপর থেকে কেউ তাকে হত্যার উদ্যেশ্যে ধাক্কা দিয়ে ফেলে হত্যা করেছে।
রমনা থানার ওসি মোঃ মনিরুল ইসলাম জানান, সিদ্ধেশ্বরীর ৬৪/৪ নম্বর বাসার আশ পাশে তিনটা বিল্ডিং আছে, তিনটার যেকোনো একটা থেকে পড়ে মারা গেছে। তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে কেউ তাকে ধর্ষণ করার পর হত্যা করেছে। আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে, লাশ উদ্ধার করে মর্গে প্রেরণ করা হয়েছে। পুলিশ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করে।