রুম্পার কল লিস্ট পরীক্ষা করে দেখা গেছে তার ছেলে বন্ধু আব্দুর রহমান সৈকতের সঙ্গে রুম্পা অস্বাভাবিক কথাবার্তা বলেছেন। এছাড়া সৈকতের সঙ্গে তার সম্পর্কটা খারাপ যাচ্ছিলো। বেশ কিছুদিন ধরে সৈকতকে বিয়ের চাপ দিচ্ছিলেন রুম্পা। কিন্তু সৈকত রুম্পার সঙ্গে সম্পর্ক দীর্ঘায়িত করতে চাননি। ঘটনার দিন বন্ধুদের সামনেই সৈকত রুম্পার সঙ্গে সম্পর্ক প্রত্যাখ্যান করেছিলেন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ হবিগঞ্জ শহরের চৌধুরী বাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ রুকন উদ্দিনের কন্যা, ঢাকা স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী রুবাইয়াত শারমিন রুম্পাকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় তার বন্ধু আব্দুর রহমান সৈকতকে গ্রেপ্তার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। রুম্পা কি ছাদ থেকে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন নাকি কেউ তাকে হত্যা করেছে, এ জট খুলবে সৈকতকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে- এমনটা মনে করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। এই হত্যাকান্ডে সৈকতের সম্পৃক্ততার বিষয়টিও গুরুত্ব নিয়ে বিবেচনা করা হচ্ছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, রুম্পাকে ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করা হয়েছে এমন চিন্তা মাথায় রেখে তদন্ত চলছে। কারণ আত্মহত্যা করার জন্য তার ওই ভবনে যাওয়ার কথা না। রুম্পার কল লিস্ট পরীক্ষা করে দেখা গেছে তার ছেলে বন্ধু আব্দুর রহমান সৈকতের সঙ্গে রুম্পা অস্বাভাবিক কথাবার্তা বলেছেন। এছাড়া সৈকতের সঙ্গে তার সম্পর্কটা খারাপ যাচ্ছিলো। বেশ কিছু দিন ধরে সৈকতকে বিয়ের চাপ দিচ্ছিলেন রুম্পা।
কিন্তু সৈকত রুম্পার সঙ্গে সম্পর্ক দীর্ঘায়িত করতে চাননি। ঘটনার দিন স্টামফোর্ডের সিদ্ধেশ্বরী ক্যাম্পাসে বন্ধুদের সামনেই সৈকত রুম্পার সঙ্গে সম্পর্ক প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, ধারণা করা হচ্ছে ওই দিন সম্পর্কের রফাদফা করার জন্যই ওই ভবনের একটি মেসে সৈকতের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন রুম্পা। পরে তাদের মধ্যে বিয়ের বিষয় নিয়ে ঝগড়াঝাটি হয়। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, রুম্পা চার তলা ভবনের ছাদ থেকে নিচে পড়েন। যে ভবনের ছাদ থেকে তিনি পড়েন ওই ভবনের দ্বিতীয় তলায় ছেলেদের একটি মেস আছে। ওই মেসে ৮/১০ যুবকের সঙ্গে সৈকতও থাকতেন। ঘটনার পর থেকে ওই মেস তালাবদ্ধ। আর ওই যুবকদেরও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সূত্র জানায়, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় স্ট্রে বার্ড নামে একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রুম্পা। এছাড়াও পরিবারের সদস্যরাও পুলিশকে জানিয়েছে যে, ছোট থেকে তিনি কালচারাল সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। স্ট্রে বার্ড এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার পর তার একাধিক ছেলে বন্ধু তৈরি হয়। তাদের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক ছিল রুম্পার। তাদের মধ্যে রিফাত, সৈকত ও সবুজের সঙ্গে তার ভাল সম্পর্ক ছিল। তারা বিভিন্ন সময় কালচালার সংগঠনের পরিচালনা ও নেতৃত্বে দিয়েছেন। ডিবি পুলিশ ইতিমধ্যে রিফাত ও সবুজকে প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তবে তাদের ওই হত্যাকান্ডের সঙ্গে কোন সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। তবে শুরু থেকে সৈকতের মোবাইল ফোন বন্ধ ছিল। তবে তার মোবাইল ফোন নম্বর ট্রাকিং করে তাকে আটক করে গোয়েন্দারা।
পুলিশ ও গোয়েন্দারা ঘটনাস্থল থেকে সিসিটিভির একটি ফুটেজ সংগ্রহ করেছেন। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ভিডিও ফুটেজে ঘটনাস্থলের পাশের একটি চারতলা ভবনে সন্ধ্যা ৬টা ৪৭ মিনিটে রুম্পাকে প্রবেশ করতে দেখা গেছে। আর রাত পৌনে ১১টার দিকে তাকে ওপর থেকে পড়তেও দেখা গেছে। তবে ফুটেজে কেউ তাকে ফেলে দিচ্ছে কিনা সেটি বুঝা যায়নি। তবে তার শারীরিক অবস্থা দেখে বুঝা যাচ্ছে কেউ তাকে নির্যাতন করে ফেলে দিয়েছে। তার শরীরের বেশ কিছু স্থানে আঘাতের চিহ্ন ছিল। সিসি টিভি ফুটেজে দেখা যায়, রুম্পা নিচে পড়ে যাওয়ার পর দ্রুত আশপাশের লোকজন সেখানে এসে হাজির হন। কেউ কেউ তার হাতের পালস বোঝার চেষ্টা করছিলেন যে, তিনি বেঁচে আছেন কী-না। পরে ভিড়ের মধ্যে থেকে থানা পুলিশের একটি গাড়িতে করে তাকে পুলিশ নিয়ে যায়।
ওদিকে ঘটনাস্থলের পাশের আয়েশা শপিং কমপ্লেক্সের ছাদ থেকে দুটি পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে। ছাদের ওপরে ধুলার মধ্যে স্পষ্ট পায়ের ছাপ দুটি রুম্পার কিনা সেটি নিয়েও তদন্ত চলছে। এছাড়া বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। রুম্পা ওইদিন কেন তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন, আংটি, হাতঘড়ি ও ব্যাগ তার ভাইয়ের কাছে রেখে গিয়েছিলেন। কেনইবা ওই বাসায় গিয়েছিলো বা আগে কখনও কি ওই বাসায় গিয়েছিলেন- এসব প্রশ্নের উত্তর এখনও মেলাতে পারেননি তদন্তসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, রুম্পার মৃত্যু রহস্যজনক। এ ঘটনায় বিশেষ কোনো ক্লু নাই।
ডিএমপির রমনা জোনের সিনিয়র সহকারি কমিশনার এস এম শামীম বলেন, আমরা কিছুটা আঁচ করতে পারছি। আমরা কিছুটা ক্লু পেয়েছি। তাকে হত্যা করা হয়েছে এমন ভাবনা নিয়েই আমরা তদন্ত করছি। আশা করছি এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিকে আমরা খুব শিগগির আটক করতে পারবো। এদিকে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা গতকাল রুম্পা হত্যার সুষ্ঠু তদন্তের দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছেন। বিক্ষোভ শেষে তারা সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন। সেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বক্তব্য দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আরিফুর রহমান বলেন, সংস্কৃতি মনা রুম্পা আত্মহত্যা করার মত মেয়ে না। কথা বলে সবাইকে মাতিয়ে রাখতো সে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সে সহযোগিতা করতো। আমরা জানতে চাই তার মৃত্যু কিভাবে হয়েছে। জান্নাত নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, এমন মৃত্যু কারো যেন না হয়। ঘটনার দুই দিন পরেও রহস্য বের হয়নি। হত্যা বা আত্মহত্যা যাই হোক আমরা চাই প্রকৃত সত্যটা সামনে আসুক। আদিবা নামের এক শিক্ষার্থী বলেন আত্মহত্যার করার জন্য সে কেন দূরের একটি বাসায় যাবে।
রুম্পার গ্রামের বাড়িতে শোকের মাতম ঃ রুবাইয়াত শারমিন রুম্পার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের সদর উপজেলার বিজয়নগর গ্রামে চলছে শোকের মাতম। মেয়ের কবরের সামনেই বসে অঝোরে কাঁদছেন বাবা হবিগঞ্জ শহরের চৌধুরী বাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. রুকন উদ্দিন। রুম্পার মৃত্যুকে হত্যাকান্ড দাবি করে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান স্বজনরা। মেয়ের শোকে বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন মা নাহিদা আক্তার পারুল। স্বজনরা তাকে সান্ত¡না দিয়েও কান্না থামাতে পারছেন না। দু’দিন ধরে কিছুই খাচ্ছেন না। শারীরিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি বারবার চিৎকার করে বলছেন, জরুরি কাজের কথা বলে গেল, ফিরলো লাশ হয়ে।
আমার মেয়েকে কতো কষ্ট দিয়ে ওরা মেরেছে। মরার সময় মেয়েটি কতবার জানি, মা-মা বলে চিৎকার করেছে। তিনি আরো বলেন, ইউনিভার্সিটিতে ছাত্রছাত্রীদের শিফট আলাদা হওয়ায় দু’দিন ধরে মেয়ের মনও খারাপ ছিল। তার সঙ্গে কারো বিরোধ ছিল কিনা তা বলতে পারছি না। নাহিদা আক্তার পারুল বলেন, বুধবার সকালে ডিম ভাজি করে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছি। এটাই যে শেষ খাওয়া এটা কে জানতো? সন্ধ্যায় তার চাচাতো ভাই শুভর নিকট ব্যাগ-মোবাইল দিয়ে চলে যায়। বাসার দ্বিতীয় তলায়ও রুম্পা উঠেনি। এমন কী জরুরি কাজ ছিল? যার জন্য এত দ্রুত ছুটে যায়। দিন-রাত অপেক্ষায় ছিলাম- এই তো মেয়ে ফিরবে-ফিরে আসবে। এলো লাশ হয়ে; আমার মেয়েকে কেন মেরে ফেললো- আমি এর বিচার চাই।
প্রসঙ্গত, বুধবার রাতে ঢাকার সিদ্ধেশ্বরীর সার্কুলার রোডের ৬৪/৪ নম্বর বাড়ির সামনে থেকে রুম্পার মরদেহ উদ্ধার করে রমনা থানা পুলিশ। এরপর ময়নাতদন্ত শেষে শুক্রবার ভোর ৫টায় রুম্পার লাশ গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের চরনীলক্ষ্মীয়া ইউনিয়নের বিজয়নগরে নিয়ে আসা হয়। সেখানে বেলা ১০টায় জানাজা শেষে পারিবারিক গোরস্থানে দাদী রুবিলা খাতুনের কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। রুম্পার মা নাহিদা আক্তার পারুল গৃহিণী। এক ভাই ও এক বোনের মধ্যে রুম্পা সবার বড়। ঢাকার শান্তিবাগে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন রুম্পা।