হবিগঞ্জের কিন্ডারগার্টেনগুলোর সাফল্যগাঁথা (এক)

বিদ্যালয়টিতে সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের ভর্তির ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় দেয়া হয়ে থাকে ॥ শিশুর সুশিক্ষা নিশ্চিতে শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করার পূর্বে বিদ্যালয় সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়ার পরামর্শ দিলেন অধ্যক্ষ ইসমত আরা বেগম

মঈন উদ্দিন আহমেদ ॥ দি রোজেস। হবিগঞ্জ শহরে শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে যার সুনাম ও খ্যাতি সর্বমহলে। এক সময় এই প্রতিষ্ঠানটি ছিল হবিগঞ্জের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানে নিজের সন্তানকে ভর্তি করাতে প্রতিটি পরিবারে ছিল নিরব প্রতিযোগিতা। এ প্রতিষ্ঠানে সন্তানকে ভর্তি করাতে পেরে মা-বাবাও অন্যরকম গর্ব অনুভব করতেন। ভর্তির সুযোগ পেলে ফেলতেন স্বস্থির নিঃশ^াস।
হবিগঞ্জ শহরে শিশুদের স্কুল প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্যোক্তা সৈয়দ এবাদুল হাসান বলেন, সন্ধানী সাংস্কৃতিক সংসদ নামে আমাদের একটি ক্লাব ছিল। ওই ক্লাবের মাধ্যমে আমরা ১৯৭৬ সালে হবিগঞ্জে প্রথম শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ কিন্ডারগার্টেন স্কুল গড়ার স্বপ্ন দেখি। এ লক্ষে আমরা তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক আজিজুর রহমানের সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করলে তিনি আমাদের উৎসাহিত করেন। তিনি আমাদের সংগঠনের সবাইকে নিয়ে করণীয় নির্ধারণে আলোচনায় বসেন। আলোচনায় অংশ নেন সাবেক পৌর কমিশনার গোলাম মোর্তজা, অ্যাপোলো মাইকের মালিক (নাম জানা নেই), দৈনিক খোয়াই পত্রিকার স্বপ্নদ্রষ্টা মরহুম আজিজুর রহমান, অ্যাডভোকেট পূণ্যব্রত চৌধুরী বিভূ, এ জেড আব্দুন নুর চৌধুরী, সাংবাদিক ইসমত চৌধুরী, অ্যাডভোকেট আমির হোসেন, অ্যাডভোকেট মনসুর উদ্দিন আহমেদ ইকবাল, অ্যাডভোকেট আফরাজ আফগান চৌধুরী, অ্যাডভোকেট আফরোজ বখ্ত, সাবেক পৌর চেয়ারম্যান শহীদ উদ্দিন চৌধুরী, জাহানারা আফছর সহ শহরের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। ওই সভায় এ জেড আব্দুন নুর চৌধুরী বাচ্চাদের স্কুল খোলার বিপক্ষে মত দিলে আলোচনা সেখানেই থেমে যায়। পরে মহকুমা প্রশাসক আজিজুর রহমান বলেন, আপনারা বাচ্চাদের স্কুল না খোললে আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি। পরে মহকুমা প্রশাসক আজিজুর রহমান স্কুল খোলার উদ্যোগ নিয়ে ১৯৭৭ সালের প্রশাসনের মাধ্যমে ১ জুলাই ‘দি রোজেস’ শিশু কিশোর বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
‘দি রোজেস’ শিশু কিশোর বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ইসমত আরা বেগম বলেন, বিকেজিসি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ‘দি রোজেস’ স্কুলের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৭৭ সালের ১ জুলাই ‘দি রোজেস’ শিশু কিশোর বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ ছিলেন মোতাহ্-হারা-ঝুনু। তিনি ১৯৭৭ সালের ১ জুলাই থেকে ১৯৮৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ওই সময়ে হবিগঞ্জ নিউ ফিল্ডে এক্সিভিশন হয়। ওই এক্সিভিশন থেকে যা আয় হয় তা থেকে একটি ফান্ড গঠন করা হয়। ওই ফান্ডের টাকায় নিউ ফিল্ডের পাশে স্থাপনা নির্মাণ করে বিকেজিসি থেকে দি রোজেস স্থানান্তরিত হয়ে নিজস্ব ক্যাম্পাসে যাত্রা শুরু করে। প্লে থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রছাত্রী ভর্তি কার্যক্রম চলে পুরোদমে। ওই সময়ে ছাত্রছাত্রী ছিল প্রায় ৫শ’। বর্তমানে স্কুলের শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় পৌনে ৩শ’।
স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আজকাল প্রতিটি পাড়া মহল্লায় কিন্ডার গার্টেন স্কুল গড়ে উঠছে। এলাকাভিত্তিক স্কুল গড়ে উঠায় অভিভাবকরা নিজের এলাকায় সন্তানদের ভর্তি করছেন। ফলে এক সময়ের সাড়া জাগানো শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দি রোজেসে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা আগের চেয়ে কমে গেছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, প্রায় প্রতিদিনই প্রতিযোগিতা করে বিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু সেই হারে বাড়ছে না পড়ালেখার মান।
তিনি বলেন, দি রোজেস হচ্ছে এক গুচ্ছ গোলাপ। এ বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মনন ও মেধা যেন গোলাপের মতই প্রষ্ফুটিত তথা বিকশিত হয়ে সমাজে সৌরভ ছড়াতে পারে সে লক্ষে শিক্ষকমন্ডলী দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তারা তাদের পরিশ্রমের সুফলও পাচ্ছেন। এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আজ দেশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত। কেই ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেই ব্যারিস্টার, কেউ কর্ণেল, কেউ মেজর, কেউ সচিব, কেউ শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় কর্মরত রয়েছেন। তারা যখন এসে সুসংবাদ দেয়, আমাদের দোয়া নিতে আসে মিষ্টির প্যাকেট হাতে তখন মনটা আনন্দে ভরে যায়। তখন নিজেকে নিয়ে অন্যরকম গর্ব অনুভব করি। এছাড়া হবিগঞ্জের স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও বিকেজিসি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি সফলতা অর্জন করে। বিশেষ করে বিদ্যালয়গুলোর ১ থেকে ১০ পর্যন্ত যাদের রোল থাকে তারা অধিকাংশই দি রোজেসের শিক্ষার্থী।
তিনি পড়ালেখার পাশাপশি শিশুদের সুষ্ঠু বিকাশে খেলাধুলা ও শরীর চর্চা করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, খেলাধুলা ও শরীর চর্চা প্রতিটি শিশুর মেধা বিকাশে সহায়ক। একটি শিশুকে পরিপূর্ণ মানুষ হতে হলে বর্তমানের মুখস্থ বিদ্যা অর্জনের প্রতিযোগিতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। মুখস্থ বিদ্যা দিয়ে ভাল ফলাফল অর্জন করা যায় যা সাময়িক। এর ভিত্তিও থাকে দুর্বল। আমাদেরকে এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতে অসুস্থ মানসিকতা পরিহার করতে হবে। শিশুদের মুখস্থ বিদ্যায় পারদর্শী না করে জ্ঞান অর্জনে পারদর্শী করতে হবে। তবেই তা আমাদের তথা দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।
দি রোজেস এর পরিচালনা পদ্ধতি ঃ বর্তমানে বিদ্যালয়টি জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। এর পরিচালনা পর্ষদের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জেলা প্রশাসক।
দি রোজেস এর শ্রেণি সংখ্যা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের বিষয় সমূহ ঃ দি রোজেস শিশু কিশোর বিদ্যালয়ে প্লে থেকে স্ট্যান্ডার্ট ফাইভ পর্যন্ত পাঠদান করা হয়ে থকে। সেখানে সরকার নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তক বাংলা, ইংরেজি, গণিত, ধর্মশিক্ষা, বাংলা ব্যাকারণ, ইংরেজি গ্রামার, সাধারণ জ্ঞান, কম্পিউটার ও চিত্রাংকন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে থাকে। এছাড়াও সংগীত শরীর চর্চা বিষয়ক শিক্ষা দেয়া হয়ে থাকে।
ভর্তি পদ্ধতি ও ভর্তি ফি ঃ দি রোজেস স্কুলে প্রতি বছরের ডিসেম্বর মাস থেকে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়। আর ক্লাস শুরু হয় জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ থেকে। তাছাড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়। প্লে থেকে কেজি শ্রেণি পর্যন্ত নতুন মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি ফি ২ হাজার ৭৫০ টাকা। আর পুরাতন হলে ২ হাজার ৫৫০ টাকা। নতুন হিন্দু ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি ফি নতুন ২ হাজার ৬৫০ টাকা। আর পুরাতন হলে ২ হাজার ৪৫০ টাকা। স্ট্যান্ডার্ট ওয়ান থেকে স্ট্যান্ডার্ট ফাইভ পর্যন্ত নতুন মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি ফি ২ হাজার ৯৫০ টাকা। আর পুরাতন হলে ২ হাজার ৭৫০ টাকা। নতুন হিন্দু ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি ফি নতুন ২ হাজার ৮৫০ টাকা। আর পুরাতন হলে ২ হাজার ৬৫০ টাকা। মাসিক বেতন স্ট্যান্ডার্ট ওয়ান থেকে স্ট্যান্ডার্ট ফাইভ পর্যন্ত ৬শ’ টাকা। যা প্রতি চলতি মাসের ৬ ও ১৫ তারিখ পরিশোধ করতে হয়। তবে ২৫ তারিখ জরিমানাসহ বেতন পরিশোধ করা যায়। পরপর ২ মাস বেতন পরিশোধ না করলে শিক্ষার্থীর ভর্তি বাতিল হয়ে যায়। পরবর্তীতে ২শ’ টাকা ভর্তি ফি দিয়ে পুনরায় ভর্তি হতে হয়।
পরীক্ষা পদ্ধতি ও সময়সূচি ঃ শিক্ষাবর্ষে ১ম, ২য় ও বার্ষিকসহ মোট ৩টি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলের সাথে ২টি সাময়িক পরীক্ষার ফলাফল একত্রিত করে গ্রেডিং পদ্ধতিতে চুড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ ও মেধা তালিকা নির্ধারণ করা হয়।
সাফল্য ঃ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ঈর্ষনীয় সাফল্য অর্জন করে আসছে। ২০১৩ সালে বিদ্যালয়ের ৩২ জন শিক্ষার্থী সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সকলেই উত্তীর্ণ হয়। তন্মধ্যে ২ জন ট্যালেন্টপুল ও ২ জন সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি লাভ করে। ২০১৪ সালে বিদ্যালয়ের ২৭ জন সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সকলেই উত্তীর্ণ হয়। তন্মধ্যে ৩ জন বৃত্তি লাভ করে। ২০১৫ সালে বিদ্যালয়ের ২০ জন শিক্ষার্থী সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সকলেই উত্তীর্ণ হয়। তন্মধ্যে ২ জন ট্যালেন্টপুলসহ ৭ বৃত্তি লাভ করে। ২০১৬ সালে ১৮ জন শিক্ষার্থীর সকলেই উত্তীর্ণ হয় এবং ৬ জন এ প্লাসসহ ২ জন ট্যালেন্টপুল এবং ২ জন সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি লাভ করে। ২০১৭ সালে ২৮ জন শিক্ষাথী সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সকলেই উত্তীর্ণ হয়। তন্মধ্যে ৮ জন এ প্লাস, ১ জন ট্যালেন্টপুল ও ২ জন সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি লাভ করে। ২০১৮ সালে ১৮ জন চুড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ১৮ জনই উত্তীর্ণ হয়। তন্মধ্যে ১২ জন এ প্লাসসহ ৫ জন বৃত্তি লাভ করে।
বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার সপ্তাহের ৫ দিন শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক বন্ধ। সকাল ১০টা থেকে ক্লাস শুরুর হয়ে তা চলে বেলা দেড়টা পর্যন্ত। মাঝে সকাল ১২টা ১৫ মিনিট থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত টিফিনের বিরতি দেয়া হয়ে থাকে। ক্লাস শুরুর ১৫ মিনিট পূর্বে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে স্কুলে উপস্থিত থাকতে হয়। পাঠদান কার্যক্রম শুরুর ১০ মিনিট পর কোন শিক্ষার্থীকে ক্লাসে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। আর প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলক স্কুল ড্রেস পড়ে বিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে হয়।
বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ইসমত আরা বেগম বলেন, আমাদের বিদ্যালয়ে সর্বনি¤œ বেতনে ছাত্রছাত্রীদের পাঠদান করানো হয়ে থাকে। শুধু সেবার উদ্দেশ্যে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত। এখানে সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের ভর্তির ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় দেয়া হয়। বিদ্যালয়ে সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের সংখ্যা অধিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রাইমারী শিক্ষা হচ্ছে শিক্ষার মূল ভিত্তি। প্রাইমারীতে ভালভাবে লেখাপড়া না করালে একজন শিক্ষার্থীর ভিত ভাল হয়ে গড়ে উঠে না। বর্তমানে কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা দিনের পর দিন বাড়ছে। কিন্তু মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্র বাড়ছে না। অধিকাংশ কিন্ডারগার্টেনে প্রতিযোগিতায় সাফল্য পেতে মূল পাঠ্যবই ভাল করে না পড়িয়ে শীট নির্ভর লেখাপড়া করানো হচ্ছে। যা একজন শিক্ষার্থীর প্রকৃত মেধা বিকাশের অন্তরায়। তাই তিনি প্রতিটি কোমলমতি শিক্ষার্থীকে গুরুত্বসহকারে পাঠ্যবই পড়ানোর অনুরোধ করেন। তাছাড়া শিশুর সুশিক্ষা নিশ্চিতে শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর পূর্বে বিদ্যালয় সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে ভর্তি করানোর পরামর্শ দেন।