মঈন উদ্দিন আহমেদ ॥ বাংলাদেশের একটি বিশেষ জনগোষ্ঠি হচ্ছে দলিত সম্প্রদায়। তারা সমাজের অনগ্রসরমান জনগোষ্ঠি হিসেবেও পরিচিত। সমাজের চলমান ধারা থেকে স্বেচ্ছায় দূরে থাকায় তারা নানা সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। তবুও সরকার তাদের জীবনমান উন্নয়নে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের জন্য গ্রহণ করা হয়েছে নানামুখি পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ। আর এ পদক্ষেপ বাস্তবায়নে প্রয়োজন দলিতদের একাগ্রতা, আগ্রহ ও সহযোগিতা।
জাতীয় নির্বাচন পরবর্তী চলমান ৫ বছরে বাস্তবায়নযোগ্য দলিতদের জন্য স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনের পদক্ষেপ সম্পর্কে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ হবিগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক শঙ্খ শুভ্র রায় বলেন, দলিতদের কল্যাণে সরকার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যার মধ্যে রয়েছে বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, স্কুল-কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তি, শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতীদের জন্য ফ্রি ড্রাইভিং, মৎস্য চাষ, সেলাই প্রশিক্ষণ ও কম্পিউটার প্রশিক্ষণ। এ সকল কিছুই তাদের কল্যাণে। তারা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে সরকারের এ সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে হবে। তবেই সরকারের উদ্যোগ সফল ও সার্থক হবে। দলিতরা নিজেদেরকে এ সকল উদ্যোগ থেকে দূরে সরিয়ে রাখলে সরকার যত ভাল উদ্যোগই গ্রহণ করুক না কেন তা দলিতদের জন্য কোন কল্যাণ বয়ে আনবে না।
মূলধারার জনগোষ্ঠির সাথে অধিকার বিষয়ে দলিতদের পার্থক্য সম্পর্কে তিনি বলেন, সুদীর্ঘকাল থেকে দেখা যাচ্ছে দলিতরা বৈষম্যের শিকার। খুব সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে দেখা যায়, দলিতদেরকে উচ্চ বর্ণের লোকেরা স্পর্শ পর্যন্ত করতে চায় না। তাদেরকে চায়ের কাপ পর্যন্ত আলাদা করে দেয়া হয়। তাদের বাড়িতে কোন আচার অনুষ্ঠান হলে তাদের সমাজের লোকজন ছাড়া অন্য বর্ণের হিন্দুরা তাদের বাসায়ও যায় না। যদিও শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাওয়ায় এ অবস্থার অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। তাই বলে তা দেশ থেকে একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গেছে তা বলা যাবে না। এই বৈষম্য থাকার কারণে দলিতরা নিজেরাও নিজেদেরকে এইভাবেই প্রস্তুত করে নিয়েছেন। এ অবস্থার জন্য তাদের মাঝে শিক্ষার অনগ্রসরতা দায়ী। দলিতদের মাঝে শিক্ষার হার বৃদ্ধি না পেলে এবং তাদের মাঝে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত না হলে সমাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়া তাদের জন্য খুবই দুরূহ। সমাজে তাদেরকে ভালভাবে পূণর্বাসন করতে গেলে গোষ্ঠীগতভাবে বা পাড়াভিত্তিক না থেকে সমাজের বিভিন্ন স্তরে তাদের ছড়িয়ে পড়তে হবে। তা ছাড়া দলিতদের বড় একটি সমস্যা হচ্ছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা। অপরিচ্ছন্ন থাকাটা তাদের জীবনের একটি অংশ হয়ে গেছে। খাবার-দাবার, পরিধেয় বস্ত্র, বাসস্থান সবকিছুর মধ্যে পরিবর্তন আনতে হবে যাতে তারা সমাজের মূল ¯্রােতের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে। সামাজিক সমস্যাগুলো আন্দোলন বা আইন করে সমাধান করা সম্ভব নয়। তার জন্য প্রয়োজন নিজেদেরকে প্রস্তুত করা। সমাজে দলিত শ্রেণির লোকজন নিজেদেরকে উপরে না উঠিয়ে দলিত থেকে করুণা পাওয়ার ক্ষেত্রে বেশি আগ্রহী। রাষ্ট্রের করুণা পাওয়া অর্থাৎ কোটা পাওয়ার চেষ্টায় নিজেদেরকে দলিত মনে করে বা দাবি করে কোটার উপকার পাওয়ার চেষ্টা করে। এটি দলিতদের উচ্চাবিলাসী না হওয়ার অন্যতম একটি কারণ। মূল ¯্রােতধারার জনগোষ্ঠী সব সময় দলিতদেরকে তাদের সেবক হিসেবে মনে করে আসছে। সেবকরা যদি নিজেদেরকে উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা না করে সে ক্ষেত্রে মূল ¯্রােতধারারই লাভ হয়। মূল ¯্রােতধারার লোকজন কখনোই মনে প্রাণে চাইবে না দলিতরা উপরে উঠুক। কারণ মানুষের সেবা পাওয়ার আকাঙ্খা খুব তীব্র। সে ক্ষেত্রে সেবক মালিক হোক এটি মূল ¯্রােতধারার জনগোষ্টির চাওয়ার কোর কারণ নেই।
দলিতদের অধিকারগুলো পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা যায় এ ব্যাপারে তিনি বেশ কিছু সুপারিশ করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো হচ্ছে- দলিতদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা কারিকুলামে তাদের ভবিষ্যত চিন্তা চেতনা ও স্বপ্ন দেখানোর ব্যবস্থা রাখা। দলিতদের এই বিষয়গুলো বুঝানো যে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রে দ্যারিদ্রতা কোন বাঁধা নয়। এটি একটি মানসিক ও রুচির বিষয়। দলিত মেয়েদেরকে উচ্চ শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করতে হবে। বাল্য বিয়ের কুফল সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত করে বাল্য বিয়ে রোধ করতে হবে। বিশেষ কিছু পশু পালন না করে গাভী পালন বা এ জাতীয় কিছু করতে হবে যা মূল ¯্রােতধারার সাথে মিশে সেই রূপ পেশায় দলিত জনগোষ্ঠীর লোকজনকে নিয়োজিত করতে হবে। কেবলমাত্র জাতিগত পেশা ছাড়া কৃষি কাজ, ব্যবসা বাণিজ্য, চাকুরি ইত্যাদির যোগ্য হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। পাশাপাশি বাংলা ভাষায় কথা বলার দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। দলিতদের প্রতি তখনই সুবিচার করা হবে যখন রাষ্ট্র এবং সমাজ তাদের প্রতি তাদের প্রতি করুণার দৃষ্টি বাদ দিয়ে তাদেরকে সহযোদ্ধা হিসেবে পাশে টেনে নেবে। এর জন্য রাষ্ট্রের এবং মূল ¯্রােতধারার জনগণের যেমন দায়িত্ব রয়েছে তেমনি দলিতদেরকেও স্বপ্ন দেখতে হবে উপরে উঠার। তবেই আগত ভবিষ্যতে দলিতদের সুন্দর জীবন আমরা দেখতে পাব এবং দলিত শব্দটির ব্যবহার ক্রমেই কমে আসবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নিজেদের অধিকার সম্পর্কে দলিত জনগোষ্ঠীর লোকজন অসচেতন। তারা সব সময়ই এটিকে অবহেলার চোখে দেখে থাকে। তাই তারা পেছনে পড়ে রয়েছে। যদিও স্থানীয় সরকার ও প্রশাসন তাদেরকে সামনে এগিয়ে নিতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি তাদের নিজেদেরকেও শিক্ষিত সচেতন হয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। তবেই সরকারের উদ্যোগ সফল হবে।
জাতীয় নির্বাচন পরবর্তী চলমান ৫ বছর বাস্তবায়নযোগ্য দলিতদের জন্য স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনের পদক্ষেপ সম্পর্কে হবিগঞ্জ শহর সমাজসেবা কর্মকর্তা আবু নাঈম মৃধা বলেন, দলিত বিশেষ করে সমাজের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য সরকার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আর সরকারের পক্ষে স্থানীয় সরকার বিশেষভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বয়স্কদের জন্য বয়স্ক ভাতা, স্কুলগামী শিশুদের জন্য উপবৃত্তি, বিধবা ভাতা দেয়া হচ্ছে। বয়স্করা মাসিক ৫শ’ টাকা, স্কুলগামী শিশুরা ১ম থেকে ৫ম শ্রেণি ৭শ’ টাকা, ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি ৮৫০ টাকা, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা ১ হাজার ও উচ্চতর ক্লাসের শিক্ষার্থীরা ১ হাজার ২শ’ টাকা হারে ভাতা পাচ্ছেন। এছাড়া অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর যুব সমাজকে প্রশিক্ষিত করতে সরকার ফ্রি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। যা হবিগঞ্জেও দেয়া হচ্ছে। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর যে কোন যুবক-যুবতী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে নিজেকে সমাজের উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারেন। তাদের জন্য রয়েছে ড্রাইভিং, মৎস্য চাষ এবং সেলাই প্রশিক্ষণের সুযোগ। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যাচ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণার্থীদের বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দেয়ার পাশাপাশি প্রতিমাসে তাদেরকে ৫ হাজার টাকা করে ভাতা দেয়া হয়েছে। এ হিসেবে একজন প্রশিক্ষণার্থী ৪ মাস প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে ২০ হাজার টাকা ভাতা পেয়েছেন। আগামীতে দলিত বিশেষ করে সমাজের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর যুবক-যুবতীদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সেখানে দলিত অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর যুবক-যুবতীরা ফ্রি প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ পাবেন। প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত হয়ে তারা নিজেরাই নিজেদের জন্য কিছু করতে পারবে। কারো মুখাপেক্ষি না হয়ে তারা নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করলে সামাজিক বৈষম্য অনেক কমে আসবে বলে তিনি মনে করেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হবিগঞ্জের দলিত অনগ্রসর জনগোষ্ঠী বিশেষ করে চা শ্রমিকদের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। এটি অবশ্যই সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এছাড়া দলিত অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর যুবক-যুবতীরা শিক্ষিত হলে তারা আলাদা সুযোগ সুবিধা পাবে। অর্থাৎ চাকুরী ক্ষেত্রে তারা অগ্রাধিকার পাবে। এটি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য একটি ইতিবাচক দিক বলে তিনি মনে করেন।
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com