হবিগঞ্জের পরবর্তী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেছেন- শুধু উচ্ছেদ নয়, সরকার ও জনস্বার্থে যা করা দরকার আমি তা-ই করবো ॥ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ তাওহিদুল ইসলাম জানান, উচ্ছেদ অভিযান প্রতিদিনই চলছে। আশা করি এ অভিযান বাধাগ্রস্ত হবে না।

এসএম সুরুজ আলী ॥ হবিগঞ্জ শহরের পুরাতন খোয়াই নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযানের ১ মাস ৮ দিনের মাথায় হঠাৎ করে জেলা প্রশাসক মাহমুদুল কবীর মুরাদের বদলীর খবর শুনে উচ্ছেদ অভিযান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন শহরবাসী। অনেকেই ধারণা করছেন উচ্ছেদ অভিযান স্থগিত করার জন্য পুরাতন খোয়াই নদীর প্রভাবশালী অবৈধ দখলদাররা নিজেদের স্থাপনা বহাল তবিয়তে রাখতে তদবির করে জেলা প্রশাসককে বদলী করিয়েছেন। আবার কেউ কেউ মনে করছেন সরকারি চাকরির অনিয়ম অনুযায়ী জেলা প্রশাসকের বদলী হয়েছে। তবে জেলা প্রশাসক মাহমুদুল কবীর মুরাদ বলেছেন তিনি যেখানেই যান কেন খোয়াই নদীর উচ্ছেদ অভিযান নিয়মিত খোঁজখবর রাখবেন এবং পরবর্তী জেলা প্রশাসক এসে উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত রাখবেন। হবিগঞ্জের পরবর্তী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান জানিয়েছেন, সরকার ও জনস্বার্থে যা করা দরকার তিনি তা-ই করবেন।
প্রসঙ্গত, হবিগঞ্জ শহরকে নান্দনিক শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও জলাবদ্ধতা দূরীকরণের লক্ষ্যে এমপি অ্যাডভোকেট মোঃ আবু জাহিরসহ শহরের বিশিষ্টজনদের উপস্থিতিতে গত রমজানের ঈদের রাতে সার্কিট হাউজে জেলা প্রশাসনের নৈশভোজের অনুষ্ঠানে পুরাতন খোয়াই নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেলা প্রশাসক মাহমুদুল কবীর মুরাদ গত ১৫ সেপ্টেম্বর তাঁর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি উচ্ছেদের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। সংবাদ সম্মেলনে জেলা প্রশাসক বলেছিলেন শহরকে নান্দনিক করার জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার উপরে ‘খোয়াই রিভার সিস্টেম উন্নয়ন প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দিয়েছেন। সে অনুযায়ী হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রকল্প বাস্তবায়নের স্ক্যাচম্যাপ তৈরি করে। প্রকল্পের মাধ্যমে নদী পুনখনন, তীর রক্ষা ও বনায়নের মাধ্যমে নান্দনিক রূপ দেয়া হবে। উচ্ছেদ অভিযানে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। ১৬ সেপ্টেম্বর ডায়াবেটিকস হাসপাতালের পেছন থেকে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করা হয়। পরবর্তীতে মাহমুদাবাদ, অনন্তপুর, হবিগঞ্জ সদর হাসপাতাল এলাকা, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে মুক্তিযোদ্ধাদের দখলকৃত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। উচ্ছেদ অভিযানে অনেকের বহুতল বিল্ডিং ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। আবার অনেকেই নিজেদের স্থাপনা স্বেচ্ছায় ভেঙ্গে ফেলেছেন। তবে উচ্ছেদের শুরু থেকে একটি মহল উচ্ছেদ অভিযান থেকে নিজেদের অবৈধ স্থাপনা, বাসা বাড়ি রক্ষার জন্য বিভিন্ন মহলে দৌঁড়ঝাপ করেছেন। তাদের বাসার সামনে সরকারি দলের নেতা পরিচয়সহ বিভিন্ন পরিচয়ে ব্যানার লাগিয়েছেন। সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার শহরের মার্কাজ মসজিদ ও চাঁদের হাসি হাসপাতালের সম্প্রসারিত অংশে অভিযান পরিচালনা করা হয়। আজ শুক্রবারও উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে জানিয়েছেন হবিগঞ্জ সদর উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) মাসুদ রানা। তিনি বলেন আমাদের এ উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত থাকবে। এদিকে বুধবার উচ্ছেদ অভিযানের ১মাস ৮ দিনের মাথায় হঠাৎ করে জেলা প্রশাসক মাহমুদুল কবীর মুরাদকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পরিচালক হিসেবে বদলী করা হয়। আর হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিব মোহাম্মদ কামরুল হাসানকে।
পুরাতন খোয়াই নদীর উচ্ছেদ অভিযান চলাকালে জেলা প্রশাসকের বদলিকে সহজভাবে মেনে নিতে পারছেন না হবিগঞ্জ শহরবাসী। কারণ, হবিগঞ্জের পরিবেশ রক্ষায় পুরাতন খোয়াই নদী পাড়ের অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ ছিল হবিগঞ্জ শহরবাসীর দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা। জেলা প্রশাসক মাহমুদুল কবীর মুরাদ বদলী হওয়ায় পুরাতন খোয়াই নদীর অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হবে কি-না, এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। হবিগঞ্জ শহরের ইনাতাবাদ এলাকার বাসিন্দা শাহ জালাল উদ্দিন জুয়েল জানান, পুরাতন খোয়াই নদীর উচ্ছেদ এটা দীর্ঘদিনের দাবি। উচ্ছেদ অভিযান শুরু হওয়ার পর স্বাগত জানিয়েছেন শহরবাসী। কিন্তু একটি কুচক্রী মহল উচ্ছেদ অভিযান বাঁধাগ্রস্ত করার জন্য অনেক ষড়যন্ত্র করেছেন। এর মধ্যে জেলা প্রশাসকের বদলী হওয়া সাধারণ মানুষের মধ্যে আশঙ্কার সৃষ্টি করেছে। তবে আমরা আশা করি, উচ্ছেদ অভিযান কেউ বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। হবিগঞ্জের সচেতন লোকজন জেলা প্রশাসনের পাশে থাকবে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) জেলা সহ-সভাপতি কবি তাহমিনা বেগম গিনি জানান, আমি জানি না জেলা প্রশাসক মাহমুদুল কবীর মুরাদকে কি কারণে বদলী করা হয়েছে। দখলকারীরা তদবির করে যদি বদলী করিয়ে থাকে তাহলে উচ্ছেদ অভিযানে বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে পুরোপরি উচ্ছেদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত মাহমুদুল কবীর মুরাদ থাকলে ভাল হতো। আমরা আশা জেলা প্রশাসক মাহমুদুল কবীর মুরাদ যেখানেই থাকেন না কেন তিনি উচ্ছেদ অভিযানের তদারকি করবেন আর নবাগত জেলা প্রশাসক উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত রাখবেন। এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ তাওহিদুল ইসলাম জানান, উচ্ছেদ অভিযান প্রতিদিনই চলছে। আশা করি এ অভিযান বাধাগ্রস্ত হবে না। তিনি বলেন, শীঘ্রই প্রায় আড়াইশ কোটি টাকার খোয়াই সিস্টেম প্রকল্প একনেকে অনুমোদন হবে।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মাহমুদুল কবীর মুরাদ জানান, হবিগঞ্জবাসীর দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা অনুযায়ী পুরাতন খোয়াই নদী উদ্ধার ও হবিগঞ্জ শহরকে নান্দনিক শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান শুরু করা হয়েছিল। তা এখনও অব্যাহত রয়েছে। আমার পরে যিনি আসবেন তিনি উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত রাখবেন। এ ব্যাপারে হবিগঞ্জের পরবর্তী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসানের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, খোয়াই নদীর উচ্ছেদ অভিযান সম্পর্কে আমি অবগত নই। আপনাদের মাধ্যমে এ বিষয়টি অবগত হয়েছি। তিনি বলেন, শুধু উচ্ছেদ নয়, সরকার ও জনস্বার্থে যা করা দরকার আমি তা-ই করবো।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, প্রাথমিক পর্যায়ে সদর হাসপাতাল থেকে নাতিরাবাদ পর্যন্ত দুই কিলোমিটার ৩১৫ মিটার পুরাতন খোয়াই নদীকে সংস্কার করে নান্দনিক করার পরিকল্পনা রয়েছে। অনেকটা ঢাকার হাতিরঝিল প্রকল্পের আদলে এটি করা হবে। নদীর দু’পাড় উঁচু করে বাঁধ নির্মাণ, দুই তীরে রাস্তা, ৫টি ব্রিজ নির্মাণ ও গাছ লাগানো হবে।
পরবর্তীতে হবিগঞ্জ পৌরসভা সেখানে পার্ক ও শিশুদের বিনোদনের ব্যবস্থা করবে। এ প্রকল্পের আওতায় পুরাতন খোয়াই নদীর দু’পাড়ে প্রশস্ত ওয়াকওয়ে, ওয়াটার পিউরিফিকেশন পাম্প স্থাপন, পর্যটকদের জন্য বোটিং ব্যবস্থা, এলইডি সড়কবাতি স্থাপন ও শিশুদের জন্য কিডস কর্ণার করা হবে।
সূত্র জানায়, হবিগঞ্জ জেলা শহরকে বন্যার কবল থেকে রক্ষা করতে ১৯৭৬ সাল থেকে দুই দফায় মাছুলিয়া থেকে কামড়াপুর পর্যন্ত খোয়াই নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা হয়। ১৯৭৬-৭৭ সালে মাছুলিয়া থেকে রামপুর পর্যন্ত তিন কিলোমিটার এবং ১৯৭৮-৭৯ সালে রামপুর থেকে কামড়াপুর গরুর বাজার পর্যন্ত আরও দুই কিলোমিটার গতিপথ পরিবর্তন করা হয়। এরপর থেকে নদীর পুরনো অংশটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। আর এ ফাঁকে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক নেতা, সরকারি চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, আইনজীবীসহ নানা পেশার মানুষ নদীর পুরনো অংশটি দখলে নিতে থাকেন। এক সময় নদী অস্তিত্ব হারিয়ে কোথাও খাল, আবার কোথাও ড্রেনে পরিণত হয়।
জেলা প্রশাসক মাহমুদুল কবীর মুরাদ পুরাতন খোয়াই নদীর অবৈধ দখল উচ্ছেদের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। শুধু তাই নয়, তিনি হবিগঞ্জ শহররক্ষা বাঁধ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এসব ছাড়াও তিনি সুন্দর হবিগঞ্জ গঠনে হাওর, পাহাড় রক্ষায় কাজ করে আসছিলেন।