মদিনার আসল পথ ছেড়ে বামদিকে লোহিত সাগরপাড় শহর ইয়ানবু’র রাস্তা ধরে বদরের যাত্রাপথ। মেঘের ছায়ায় মিষ্টি রোদে মরুভূমির উপর ও পাথরের পাহাড়ের মাঝ দিয়ে ১২০ কিলোমিটার বেগে চলার অনুভূতিই অন্যরকম

ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব
১৭ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭।
মক্কা থেকে মদিনা যাওয়ার পথে ট্যাক্সিক্যাবের পাকিস্তানি ড্রাইভার বলল বদরের যুদ্ধের ময়দান দেখে যাবেন? অনেকটা পথ ঘুরে যেতে হবে, তাই ১০০ রিয়াল বেশি লাগবে। আমার স্ত্রী ও জেষ্ঠ্য কন্যা সমস্বরে সম্মতি জানালে ড্রাইবারের সাথে দর কষাকষির আর তেমন সুযোগ রইল না। মদিনার আসল পথ ছেড়ে বামদিকে লোহিত সাগরপাড় শহর ইয়ানবু’র রাস্তা ধরে বদরের যাত্রাপথ। মেঘের ছায়ায় মিষ্টি রোদে মরুভূমির উপর ও পাথরের পাহাড়ের মাঝ দিয়ে ১২০ কিলোমিটার বেগে চলার অনুভূতিই অন্যরকম। যথাসময়ে হাজির হলাম বদরের প্রান্তরে। ট্যাক্সি ড্রাইভার গাইেেডর ভূমিকা পালন করে যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে গেল। দুই পাহাড়ের মাঝখানে সমতল তামাটে-সবুজ আগোচালো শুষ্ক ভূমি। যুদ্ধোত্তর বিদ্ধস্থ অবস্থার নিদর্শন মনে হল যেন একেবারে মুছে যায়নি। অবাক হয়ে অপলকনেত্রে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। চোখে ভাসতে লাগল মাত্র ৩১৩ জন সৈন্য নিয়ে ১০০০ কাফেরের সাথে অসম সেই যুদ্ধর ছবি। কি পরিমাণ খোদাভীতি এবং আনুগত্য আর আত্মবিশ্বাস থাকলে এহেন অবস্থায় জেতা যায় সহজেই অনুমেয়। ময়দানের অনতিদূরে ছোট্ট পাহাড় চূড়ায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রথম যুদ্ধের প্রথম সমরনায়ক হযরত মুহাম্মদ (সঃ) স্বয়ং নিজে। সঙ্গে হযরত আবু বকর, হযরত উমর এবং হযরত আলীসহ নিবেদিত প্রাণ, ঈমানের জোরে মহাবলীয়ান তেজোদৃপ্ত অন্য সাহাবাগণ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের, জাহেলিয়াত আর অসভ্যতার বিরুদ্ধে সভ্যতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এক চরম পরীক্ষা! মুহাজেরদের তুলনায় চার-পাঁচগুণ বেশি ছিলেন নব চেতনায় উদ্দীপ্ত, ঈমানের দৃঢ়তায় বলীয়ান ও জান্নাত পিপাসু কোমলমতি আনসারগণ। অপরিণত বয়স্ক আনসার কিশোররা যুদ্ধে সামিল হতে চাইলে হযরত মুহাম্মদ (সঃ) তাদেরকে বুঝিয়ে মদিনায় রেখে আসেন। এক অদৃশ্য শক্তির আবেশে আত্মাহুতির কি এক চরম বাসনা! এক ক্ষুধার্থ সাহাবী যুবক খেজুর খাওয়ার মূহুর্তে যখন রসুলুল্লাহ (সঃ) এর নিকট থেকে শহীদদের বেহেস্তের সুসংবাদের বর্নণা শুনতে ছিলেন হাতের খেজুর ফেলে দিয়েই যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে শাহাদাৎ বরণ করলেন। একত্ববাদ প্রতিষ্ঠায় প্রথম যুদ্ধে শহীদ হওয়ার এ কি এক স্বর্গীয় আকাঙ্ক্ষা! সঙ্গে আল্লাহর উপর অগাধ বিশ্বাস ও ভরসা এবং তার রসুলের উপর আনুগত্যের কি এক অনুপম দৃষ্টান্ত!
হযরত মুহাম্মদ (সঃ) যেখানে তাবু গেড়েছিলেন সেখানে এখন একখানা মসজিদ। মসজিদে শোহাদা তথা ১৪ জন শহীদগনের নামকরণে এই মসজিদ। এ মসজিদের বাহিরে মহিলা পুরুষের আলাদা জায়গায় কার্পেট বিছানো স্থানে নফল নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা করা আছে।
নামাজ শেষে ড্রাইভার সাহেব নিয়ে গেলেন শহীদানদের কবরস্থানের দিকে। যাওয়ার পথেই শ্বেতপাথরের সুউচ্চ ফলকে যের যবরহীন আরবীতে লিখা শহীদানদের নামের তালিকা। দু’চারটে নামের অংশবিশেষ উদ্ধার করতে পারলেও কেন জানি বোকার মত কেবল তাকিয়ে রইলাম। অনতিদূরে ৬/৭ ফুট উঁচুু দেয়ালে ঘেরা সমতল ভূমিতে শহীদগনের সমাধিস্থল।
পাথরের উপর দাড়িয়ে এক অনাড়ম্বর পরিবেশে শুধুমাত্র মাটিচাপা দিয়ে সারিবদ্ধভাবে শুয়ে রাখা ইসলামের বীর যোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল।
এক নিরব নিথর থমথমে পরিবেশ। নেই কোন গিলাপ, নেই কোন সামিয়ানা, নেই আতর গোলাপের সুবাস, নেই মোমবাতি প্রজ্বলনের কোন মহড়া, নেই ঝুলানো কোন দানবাক্স, নেই আহাজারি বা বিলাপের উপস্থিতি। স্বয়ং রাসুলের সান্নিধ্যে থেকে এক অপরুপ ও অনন্য ক্ষমতার এবং মর্যাদার অধিকারী সাহাবাগন এখানে শুয়ে নিরবে নিভৃতে। হযরত বড়পীর আবদুল কাদির জিলানীকে সাহাবীগনের মর্যাদা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছিলেন ‘সাহাবীগনের ঘোড়ার খুরের ধুলিকনার মর্যাদার সমকক্ষও আমি নই’। এমনিতর ১৪ জন চিরঞ্জীব শুহাদায়ে বদর, চরম উৎকর্ষতার তুঙ্গে যাদের অবস্থান, যাদের ত্যাগের বিনিময়ে অর্ধ পৃথিবী আজ ইসলামের ছায়াতলে, আমারই সম্মুখে সেই মহান মনিষীগন শুয়ে, যারা প্রাণাধিক প্রিয় রসুলে(সঃ) এর অবয়ব স্বচক্ষে অবলোকন করেছেন, সান্নিধ্য লাভের সৌভাগ্য অর্জন করে সাহাবায়ে কেরাম উপাধি লাভ করেছেন, তাদেরই সামনে আমি দাঁড়িয়ে, যেন নিজেকে বিশ্বাসই করতে পারছিলামনা। একদিকে একজন মুসলমান হিসেবে নিজের দৈন্যতা, অপরদিকে এখানে হাজির হওয়ার মত পরম সৌভাগ্য এ দুই অনুভূতির সংমিশ্রণে মনের অজান্তেই দুচোখের কোনদ্বয় কেন জানি ভিজে উঠল।
হে শায়িত সাহাবাগন, আপনারাতো তাদেরই সহযোদ্ধা যারা নিজেরা অর্ধাহারে থেকে বা শুধু খেজুর খেয়ে বন্দিদের রুটি খাইয়েছিলেন, আপনারাতো সেইসব সাহাবীদেরই কাতারের যারা নিজেরা তৃষ্ণার্ত থেকেও অপরজনের কথা ভেবে পানির পাত্র স্পর্শ করেননি অতঃপর একে একে মৃত্যুকোলে ঢলে পড়েছিলেন, ভ্রাতৃত্ববোধের কি অভূতপূর্ব উদাহরণ! আপনারাতো সেই সাহাবিদেরই সমগোত্রীয় যারা বিভিন্ন যুদ্ধে শত্রুর আঘাতে নিজের ঝুলে থাকা বাহু পা দিয়ে চেপে ধরে নিজেই কেটে ফেলে দিয়ে যুদ্ধ করেছেন, কি অপূর্ব আত্মত্যাগ! আপনারাতো সেইসব সাহাবিদেরই দলভুক্ত যারা যুদ্ধের ময়দানে সর্বাঙ্গ হারিয়ে শুয়ে কেবল মুখ দিয়ে ইসলামের জান্ডাকে তুলে ধরেছিলেন। কি দৃঢ়তা ঈমানের!
৭০ জন উষ্ট্রারোহী, ২জন অশ্বারোহী সহ মাত্র ৩১৩ জন সাহাবি কি পরিমান ঈমানী শক্তি, তাকওয়া এবং তাদের রসুলের প্রতি আনুগত্য থাকলে ৭০০ উষ্ট্রারোহী, ২০০ অশ্বারোহীসহ প্রায় ১০০০জন শত্রুর বিরুদ্ধে এক অসম যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারেন তা যেন আন্দাজেরও বাহিরে। সংখ্যা নয় বরং গুণগত মানই যে মুখ্য তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলেন আপনারা। তাইতো আল্লাহর প্রতিশ্রুত সাহ্য্যা আপনাদেরই জন্য। আপনাদের শাহাদাৎ বরণ অতঃপর এ যুদ্ধজয়ই ছিল ইসলামের ইতিহাসে অনন্য এক মাইল ফলক।
পবিত্র রক্তে রঞ্জিত যুদ্ধের পোষাকেই শুয়ে থাকা হে শোহাদায়ে বদর সাহাবাগণ, আপনাদের আত্মাহুতির বদৌলতেই ঐদিন সত্য মিথ্যার পার্থক্য নিরুপিত হয়েছিল, ইসলামের নূতন সূর্য উদিত হয়েছিল, ইসলামের অগ্রযাত্রা হয়েছিল ত্বরান্বিত। ইসলামের ঝান্ডাতলে আজ আমরা নিজেদের মুসলমান দাবি করি।
আল্লাহ আপনাদের উপর অনর্গল স্বর্গীয় শান্তি বর্ষণ করুন। আমিন ॥