ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব
১৯৬৮ সাল। শায়েস্তাগঞ্জ বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয় তখন শিক্ষার মানদন্ডে যৌবনকাল অতিক্রম করছে। ১৯৬৭ সালে দু’জন কুমিল্লা বোর্ডে মেধা তালিকায় স্ট্যান্ড করেন, একজন এইতো বছর দু’তিনেক হল ঢাকা মেট্রোপোলিটন পুলিশ কমিশনার হিসেবে অবসর গ্রহণ করলেন। অপরজন হলেন জনাব আবিদুর রহমান যিনি ঢাকা নটেরড্যাম কলেজের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। উনাদের সহপাঠী ডাঃ সৈয়দ শাহজামান সাহেব সবসময় ক্লাসে ২য় স্থান অধিকার করতেন। মেধা তালিকায় স্থান না পেলেও কিন্তু তখনকার সময়ে কঠিন প্রতিযোগিতার মাঝে সিলেট মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছিলেন। বিশ্বখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী ড. ডিএসএ মজিদ তখন ১০ম শ্রেণীর ফার্স্ট বয়। স্বনামধন্য এই বিদ্যা নিকেতনের মহীপাল গর্বিত প্রধান শিক্ষক জনাব আবদুন নুর চৌধুরী তখন ভর্তি পরীক্ষা ছাড়া কোন ছাত্রছাত্রী ভর্তি করেন না। উচ্চ বিদ্যালয় বিহীন ভাটি বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কয়েকটা স্কুলের সেন্টার পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়ায় শিক্ষানুরাগী আমার ছোট চাচা প্রায় ৪০ কিলো দূর থেকে ভর্তির জন্য এখানে নিয়ে আসলেন। দিন কয়েক দেরি হওয়াতে সহকারী প্রধান শিক্ষক জনাব কাজী খালেক স্যারের রুমে একাকী পরীক্ষা দিতে বসলাম। হঠাৎ করে অজ পাড়া গাঁ থেকে ছোট শহরে, লুঙ্গি পাঞ্জাবী পড়া শিক্ষক ফেলে এসে প্যান্ট সার্ট পরিহিত গুরুগম্ভীর শিক্ষকের সম্মুখে প্রথমে হাত কাঁপছিল বৈ কি! স্যার মাঝখানে হয়ত সাহস দিয়ে বললেন ভাল ছাত্রতো! জীবনের দ্বিতীয় বিদ্যাপীঠে শুরু হল আবারো প্রতিযোগীতার পালা। সপ্তম অষ্টম শ্রণীতে ‘বি’ সেকশনে সেকেন্ড হলেও জুনিয়রবৃত্তি পরীক্ষায় সারা মহকুমায় দু’চারটে বৃত্তির মাঝে স্কুলে একমাত্র বৃত্তি পাওয়ায় স্যারদের আদর কিছুটা বেড়ে গেল।
১৯৭১ সালের মার্চ থেকেই আরম্ভ স্বাধীনতা যুদ্ধের। অতঃপর নয় মাস পড়াশুনা ছাড়াই স্বাধীনতাত্তোর অটোপ্রমোশনে ১০ম শ্রেণীতে। স্বাধীনতা পরবর্তী আনন্দে ভাসছে সারা দেশ। নির্ধারিত স্কুল ড্রেস সাদা পায়জামা আর সাদা সার্ট ছেড়ে লুঙ্গি আর লম্বা পাঞ্জাবী পড়া শুরু হল স্কুল জুড়ে। স্কুল ছাত্র রাজনীতির নূতন ধারায় বক্তৃতার মহড়ায় অংশ নিতে শুরু করলাম একটু একটু করে। পড়াশুনায় মনোযোগ কমে গেল অনেকটা। কেন জানি প্রথম দিকে জনাব আবদুন নুর চৌধুরী একটু ঢিল দিলেন, হয়ত সর্ব পর্যায়ে সমগ্র বাংলাদেশের অবস্থা তখন তথৈবচ বলে।
এক বছর পর জীবনের মাইল ফলক এসএসসি পরীক্ষা। মনে হল প্রধান শিক্ষক সহ অন্যান্য বয়োবৃদ্ধ শ্রদ্বেয় শিক্ষক রশীদ স্যার, সৈয়দ স্যার, মালেক স্যারদের ব্যাপারটা শুধু দৃষ্টি এড়ায়নি, স্বনামধন্য স্কুলের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবিয়েও তুলেছিল।
মধ্যাণ্য বিরতিতে সকল শিক্ষকগনকে নিয়ে কমনরুমে হেড স্যার মিটিং এ বসলেন। হঠাৎ ক্লাস টেন ‘এ’ এসে স্কুল পিয়ন করিম হুসেন ভাই বললেন মালেক স্যার আমাকে ডাকছেন। বুকটা দুরু দুরু করতে লাগল। মালেক স্যার অনেক আদর করতেন কিন্তু ভয় পেতাম ততোধিক। মুখ বন্ধ করে পান চিবুতেন আর গুরুগম্ভীর গলায় খুব আস্তে আস্তে কথা বলতেন। একসময়ের স্পষ্টভাষী দাপুটে সুঠামদেহী স্পোর্টস এর টিচার বয়সের ভারে অনকটা নুজ্ব হলেও তির্যক কথা বার্তার ধার একটুও কমেনি। স্বভয়ে কমনরুমে হাজির হলাম। শুনশান নিরবতার মাঝে দেখলাম হেড স্যার বেড়িয়ে গেলেন। রুমে ঢুকে সালাম দিয়ে দরজার পাশে হাত কচলাতে কচলাতে দাড়ালাম।
মালেক স্যার পান চিবুতে চিবুতে আমার দিকে না তাকিয়েই শুরু করলেন,
‘কি জনাব ভাল আছেন? লুঙ্গি তৎসঙ্গে লম্বা পাঞ্জাবী! দারুন মানিয়েছে!’
কিছুক্ষণ দম নিয়ে শুরু করলেন, …‘অনেকতো পড়াশোনা হল, আর দরকার নেই। এবার আপনার ছোট চাচাকে খবর দেন, উনাকে আপনার হাল অবস্থা জানিয়ে বিদায় সম্বর্ধনার আয়োজন করি।’
ধীরে ধীরে কন্ঠস্বরের মাত্রা উর্দ্বগামী হতে লাগল…. ‘ক্লাস এইটে স্কলারশিপ পেয়ে স্কলারতো বনেই গেলেন, বয়স তা হয়েছে…সুতরাং…’
আজ সব মনে নেই, থাকলেও সবসময় সবকিছু বলা যায়না। তবে এটুকু মনে আছে, সম্মুখে উপবিস্ট শ্রদ্ধেয় কাজী খালেক স্যার, নৃপেন্দ্র স্যার, আফিল উদ্দিন স্যারের মত ডাকসাইটে শিক্ষকদদের সামনে অনেক্ষণ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে ছিলাম, টপ টপ করে চোখের জল পড়ছিল…
শুরু হল জীবনের নূতন গল্প। তারপর লুঙ্গি আর পাঞ্জাবী ছেড়ে আবারো সাদা পায়জামা আর সার্ট, নিয়মিত পড়াশোনা, প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বি নুরুর (নিউজিল্যান্ড প্রবাসী ডাক্তার নুরুল ইসলাম) সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বায়োলজির নূতন শিক্ষক জনাব সাইফুল ইসলাম স্যারের দৃষ্টি আকর্ষণ, অতঃপর প্র্যাক্টিক্যাল ছাড়াই (স্বাধীনতা যুদ্ধ পরবর্তী সময় মিত্র বাহিনী অবস্থানকালী সময়ে মাইক্রোস্কোপ সহ স্কুল সামগ্রী আর খুজে না পাওয়ার ফলে প্র্যাকটিক্যাল বন্ধ ছিল) ঝঝঈতে চারটে লেটার সহ ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হওয়া সব ছিল পরম শ্রদ্ধেয় মালেক স্যারের ভর্ৎসনাত্তোর আমার জীবনের ক্রমোন্নতি।
১৯৭৭ সাল। মেডিকেল কলেজ জীবনের ১ম বর্ষের এনাটমি, ফিজিওলজির কষাঘাতে যখন দিশেহারা, তখন একদিন হঠাৎ শুনি স্যার ইন্তেকাল করেছেন।
আজ আর মালেক স্যার বেঁচে নেই, স্যারের বাহ্যিক কঠোরতার অন্তরালে অভিভাবকসুলভ স্নেহের অদৃশ্য পরশটুকু অর্ধশতাব্দী পর এখনো অনুভব করি।
ঐদিনের ঐ তির্যক কথাবার্তা যা আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল, যার ফলে আমি এখন আমার আমি, অন্ধকার থেকে আলোর পথে, আমার প্রজন্ম এখন আলোর পথযাত্রী, তা হে গুরু আপনারই জন্য। আমার জন্মের জন্য ঋণী আমি আমার মাতাপিতার নিকট, কিন্ত আমার জ্ঞান, সম্মান, বৈভব যতটুকুই এর অনেক কিছুর জন্য ঋণী আপনার নিকট। হে শ্রদ্বেয় গুরু, সহগ্র শ্রদ্বাঞ্জলী আপনার জন্য। এ সজল নয়ন, সেতো আপনারই প্রতি আমার গুরুদক্ষিণা। আপনার ঐ তির্যক সতর্ক বাণী ছিল আমার জন্য অমোঘ বাণী, এ যে ভর্ৎসনা ছিল না, ছিল আমার জন্য আশীর্বাদ ॥