তাহমিনা বেগম গিনি
মাঝে মাঝে ঘর থেকে বের হয়ে পড়ি গন্তব্যহীন অবস্থায়। তবে কথায় আছে না ‘মোল্লার দৌঁড় মসজিদ পর্যন্ত’। আমার অবস্থাও তথৈবচ। সপ্তাহ দু’এক আগে উদ্দেশ্যহীনভাবে এমনি চলছিলাম। হঠাৎ নজরে পড়লো ভীষণ রকমের কালারফুল কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ৩/৪টি হবে এমন রঙিন প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকার নাম বলতে পারবো না, তবে হবিগঞ্জ থেকে দূরত্ব বেশী নয়। সম্পূর্ণ বিদ্যালয় পতাকার রঙে রঙিন করা হয়েছে। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে বাউন্ডারী দেয়ালও। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। আমি নিজেকে দেশ প্রেমিক মনে করতে সামান্যতম দ্বিধা করি না। মুক্তিযুদ্ধ নিজের চোখে দেখেছি। ৯ মাস, তার আগের ঘটনা, ১৫ই আগস্ট ভারতীয় সেনাবাহিনীর যুদ্ধ এবং যুদ্ধ পরবর্তী আচরণ, যুদ্ধ পরবর্তী দুর্ভিক্ষ (তথাকথিত) সামনে দেখেছি, উপলব্ধি করেছি। শুধুমাত্র দেখিনি শরণার্থি শিবির। যুদ্ধকালীন সময় নিজের অনেক কিছুতে জড়িত থাকা। দেশে থেকেই বীরাঙ্গনাদের কান্না, হাহাকার, শহীদদের মহান আত্মত্যাগ, রাজাকার, ইসলামি ছাত্রসংঘ, আল-বদরদের নৃশংসতা খুব কাছ থেকে দেখেছি। জাতীয় পতাকার জন্ম কাহিনী তাও জানি। আমাদের কোনো জাতীয় পতাকা ছিল না। ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ করে ৩০ লাখ মুক্তিযোদ্ধার বুকের রক্ত, ২ লাখ অথবা তার চেয়েও বেশি মা বোনদের রক্ত, সারা অঙ্গের তাজা রক্তের বিনিময়ে আমরা এ দেশ পেয়েছি। এই দেশ পেয়েছি বলেই আমাদের একটি পতাকা হয়েছে। পতাকাই আমাদের পরিচিতি, বিদেশে দেশের পরিচিতি। জাতীয় সঙ্গীতের সাথে যখন জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় তখন আপনাতেই চোখ জলে ভরে ওঠে। এই সম্মানিত শ্রদ্ধেয় পতাকার এমন অবমাননা। পুরো বিদ্যালয়গুলো জাতীয় পতাকার আদলে রং করা হয়েছে। এমনকি ওয়াশ রুমের দরজায়ও। জানি-না এই নির্দেশ সরকার দিয়েছেন কিনা। আমি বলবো জাতীয় পতাকার চরম অবমাননা করা হয়েছে। তখনই মনে পড়ে গেল মাসখানেক আগে হবিগঞ্জে ঘটে যাওয়া একটি উৎসবের কথা- পতাকা উৎসব। হবিগঞ্জের সৃজনশীল জেলা প্রশাসক মাহমুদুল কবীর মুরাদের একান্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি উৎসব। পতাকা উৎসবে আমি একজন দাওয়াতি ছিলাম, তাই কাছ থেকেই সব দেখেছি। বিশাল জেলা পরিষদ অডিটোরিয়াম কানায় কানায় পূর্ণ ছিল ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, বিভিন্ন দপ্তরের সরকারি কর্মকর্তা, প্রধান শিক্ষক, সুধীজন। প্রিন্ট এবং টেলিমিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ, জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন সকলের উপস্থিতি ছিল উৎসব মুখর। সবার হাতে ছিল ছোট ছোট পতাকা। বলা যায় পতাকাময় পুরো অডিটোরিয়াম। এমন একটি উৎসবমুখর পরিবেশে জেলা প্রশাসক মহোদয় প্রতিটি স্কুলের, মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষকবৃন্দের হাতে সঠিক মাপের, সঠিক রঙের পতাকা তুলে দেন। কারণ বাসা-বাড়ি, স্কুল-কলেজে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যে পতাকা বিভিন্ন দিবসে উত্তোলন করতে দেখি সেগুলোর অনেকটাই রং, মাপ সঠিক থাকে না। সেজন্য এই উদ্যোগ। একটি রাষ্ট্রের, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের প্রতীক জাতীয় পতাকা। আমার আপনার আত্ম পরিচয়, জাতিসত্ত্বা, স্বকীয়তা, জাতীয়তা, দেশের পরিচয় জাতীয় পতাকা। উক্ত অনুষ্ঠানে অত্যন্ত আনন্দ মুখর উৎসবের মাঝে প্রায় পনেরশো জাতীয় পতাকা শিক্ষক মন্ডলীর হাতে তুলে দেন জেলা প্রশাসক মহোদয়। দেশপ্রেমিক জেলা প্রশাসক মহোদয়কে ধন্যবাদ। হবিগঞ্জবাসি এই উৎসবের কথা মনে রাখবে। আমার অনুরোধ একবার দেখে আসুন রং করা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো। প্রতিটি বিদ্যালয়ে বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ কর্ণার হয়েছে। আমার ব্যক্তিগত অনুরোধ এইসব কর্ণারে একটি সঠিক মাপের জাতীয় পতাকা রাখা হোক এবং এই পতাকার জন্মবৃত্তান্ত কারা এই পতাকার আতুর ঘরে জড়িত ছিলেন সঠিক, সত্য ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা হোক। নতুন প্রজন্ম এসবের কিছুই জানে না। পতাকার কথা বলতে গেলেই অনেক প্রিয়, সম্মানিত, শ্রদ্ধেয় শহীদ মিনারের কথা মনে পড়ে। আমি বলি শহীদ মিনার বাংলাদেশের সমস্ত ইতিহাস, সংগ্রাম, দাবি আদায়, ভাষা অন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রামের বাতিঘর। শহীদ মিনার আমাদের শিখিয়েছে মাথানত না করতে। শহীদ মিনার শিখিয়েছে আমি বাঙালি। শহীদ মিনার শিখিয়েছে দেশপ্রেমিক হতে। শহীদ মিনার আমায় বলেছে বাংলার কথা বলতে। শহীদ মিনার আমায় বলেছে আমার দেশ বাংলাদেশ। সেইজন্য পাকিস্তান আমলে যে কোনো সংগ্রামে আন্দোলনে বারবার আক্রান্ত হয়েছে শহীদ মিনার। একাত্তরে শহীদ মিনারের অস্তিত্ব ছিলো না। জনপ্রিয় এমপি আবু জাহির মহোদয় নিজ উদ্যোগে অনুদানে হবিগঞ্জের ১৪৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার বানিয়ে দিয়েছেন। এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত ছিলাম না, কিন্তু শুনেছি অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এবং বহু শিক্ষক শিক্ষিকার উপস্থিতিতে এই শহীদ মিনারের উদ্বোধন হয়েছে। ধন্যবাদ প্রিয় এমপি আবু জাহির মহোদয়কে। এ সবের এখন অতি প্রয়োজন। অস্থির সময় পার করছে বাংলাদেশ। নৈতিক অধঃপতন, মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, দেশ প্রেমহীন রাজনীতি। মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য, সর্বত্র দুর্নীতিতে সাধারণ মানুষ বেসামাল, অসুস্থ। একমাত্র মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখের পানে চেয়ে আছেন সবাই। বাংলাদেশ, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, শহীদ মিনার, কোনো একটিকে অস্বীকার করার উপায় নেই আদর্শ নাগরিকের। কোমলমতি প্রজন্মকে পাঠ্য বইয়ের বাইরে শিক্ষা দেওয়া হোক জাতীয় পতাকাকে মাথায় ধারণ করে শহীদ মিনারকে অভিবাদন করতে। জাতীয় পতাকা, শহীদ মিনার ছাড়া বাংলাদেশ অস্তিত্বহীন। কবির ভাষায় বলি-
তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি।
তোমার সেবায় মহান দুঃখ সহিবারে দাও ভকতি।