মহামারির সময় প্রতিদিন গ্রামে চার পাঁচ জন মারা যেত। কেউ না কেউ গোরস্থান বা শ্মশানে মরদেহ সৎকারের উদ্দেশ্য হাজির থাকতেনই। বিদ্যুৎ বিহীন ঘুটঘুটে অন্ধকারে প্রায় নিভুনিভু কুপি বাতির আলোতে পাটি বিছিয়ে দাদি কলেরা দেবীর গল্প তুলতেন

ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব

প্রায় অর্ধশত বছর আগের কথা। তখনো প্রাইমারি পড়াশোনার গন্ডি পেরোইনি। প্রতি কার্তিক মাসে বর্ষার পানি যখন শুকিয়ে আসতো ভাটি অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি গ্রামেই ডায়রিয়া তথা কলেরা দেখা দিত। এখন বিচ্ছিন্নভাবে কলেরার উপস্থিতি থাকলেও অন্যান্য ডায়রিয়ার সাথে একাকার হয়ে গিয়েছে। তাই কলেরাকে আর আলাদাভাবে বিচার করা হয় না। তাছাড়া চিকিৎসায়ও তেমন একটা ব্যবধান নেই।
যা বলছিলাম, গ্রামে যখন কলেরার মহামারী দেখা দিত তখন সাধারণ মানুষের মাঝে আতঙ্ক আমি কাছ থেকে শুধু দেখিনি উপলব্ধি করেছি হাড়ে হাড়ে। শিশু বয়সে যেকোন বিপদ আপদে দাদি জান প্রাণ দিয়ে আগলে রাখতেন। তথাপি শিক্ষার আলো বিহীন অজপাড়াগাঁয়ে কুসংস্কারের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে নিরাপদ থাকা খুব কঠিন ছিল বৈকি!
মহামারির সময় প্রতিদিন গ্রামে চার পাঁচ জন মারা যেত। কেউ না কেউ গোরস্থান বা শ্মশানে মরদেহ সৎকারের উদ্দেশ্য হাজির থাকতেনই। বিদ্যুৎ বিহীন ঘুটঘুটে অন্ধকারে প্রায় নিভুনিভু কুপি বাতির আলোতে পাটি বিছিয়ে দাদি কলেরা দেবীর গল্প তুলতেন। কলেরা দেবীর নজর যার উপর পড়তো তারই শুরু হত ডায়রিয়া। এক ঘরে ঢুকলতো কয়েকজন শেষ।
কলেরা দেবীর বর্ণনা একেকজন একেকভাবে দিতেন। কেউ ঘরের পেছনে, কেউ গাছ তলায়, কেউবা একাকী রাস্তায় দেবীর সাক্ষাৎ পেতেন। কলেরা দেবীকে কেউ কাল বিড়াল, কেউ একচোখা কুকুর অথবা বিশাল সাদা ঘোড়ার মত দেখেছেন বলে বর্ণনা দিতেন। কেউবা রাস্তায় পথ আটকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিশালকায় দৈত্যের মতও দেখেছেন এমনটা জানান দিতেন। দাদি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দীর্ঘশ্বাস সমেত আমার সামনে এসব বর্ণনা তুলে ধরতেন। ভয়ে জড়সড় হয়ে দাদির আঁচল ধরে কলেরার রোজনামচা শুনতাম কোনদিন কোন বাড়িতে কতজন বিয়োগ হল। দমকা হাওয়ায় কুপি বাতিটা নিভে গেলে ভয়ে গলাটা শুকিয়ে যেত। প্রসঙ্গক্রমে শীতলা দেবীর কথাও বাদ পড়তো না। ঘুম আসার আগে কল্পনার রাজ্যে বহুরূপী কলেরা দেবীকে নিয়ে বিভোর হতাম। জনকল্যাণে মাঝরাতে দুয়েকজন লাল শালু বা সন্ন্যাসী লোহার শিকল হাতে ঝনঝন শব্দ তুলে কলেরা দেবীকে তাড়াতেন। মানুষকে সাহস দেয়ার জন্য বড় বড় হাকও ছাড়তেন। এতে বিশ্বাসের মাত্রা দ্বিগুণ হয়ে যেত। বিনিময়ে তারা পেতেন চাল ডাল তথা জীবিকা নির্বাহের কিছু দরকারি উপকরণ। যতদূর মনে পড়ে মানুষের ইবাদত বন্দেগি তখন বেড়ে যেত অনেক গুণ।
দাদি গল্পের মাঝে মাঝে সুর তুলে ইসলামী শের বা গজল গাইতেন। ছোট সময়ে বেশ কটা মুখস্থ ছিল, যা শুনতে শুনতে মনে গেঁথে গিয়েছিল। একটার দু’লাইন এখনো মনে আছে…

“আলী’র হাতের জুলফিকার
মায়ের হাতের তীর..
যেখান থেকে আইছত বলা (বালাই)
সেখানেতে ফির…”