ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব
ভোরে ঘন্টাখানেক হেঁটে সংসদ ভবন এলাকা থেকে বাসায় ফিরছি। সকাল প্রায় সাতটা। তখনো মিরপুর সড়কে যান চলাচল তেমন শুরু হয়নি। রাস্তা ক্রস করে অপর পাড়ে তথা লালমাটিয়া ঢুকতে হলে আসাদ গেইট সংলগ্ন ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে পার হতে হয়। যান চলাচল কম থাকলে নিচ দিয়েও পার হওয়া যায় এবং সচরাচর লোকজন এভাবেই পার হচ্ছে। আমিও যে মাঝেমধ্যে ফ্লাইওভার ছাড়া নিচ দিয়ে দু’একবার যাইনি তা নয়। তবে সাধারণত উপর দিয়ে যেতেই চেষ্টা করি।
কারণ…
(১) এটা আইন। একজন শিক্ষিত বিবেকবান ব্যক্তি হিসেবে অন্তত আমাকে এ আইনটুকু মেনে চলার চেষ্টা করা উচিত।
(২) নিজের প্রাণের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে হলেও একজন সক্ষম ব্যক্তি হিসেবে উপর দিয়েই যাওয়া বাঞ্ছনীয়।
(৩) প্রাতঃভ্রমণের অংশ হিসেবে নিজ হৃদয়ের সুরক্ষা বিবেচনা করে এ চল্লিশটা সিড়ি উঠা এবং নামা তথা আসা-যাওয়ায় দুবারে আশিটা সিড়ি দুবার ডিঙ্গানো কষ্ট সহিষ্ণুই বটে।
আমি যখন ফ্লাইওভারের সিড়ি বেয়ে উঠছিলাম হঠাৎ নজরে পড়ল পেছনদিক থেকে একটা কুকুর উপরে উঠছে। তার নিজস্ব গতিতে আমাকে ক্রস করে ওপারে নেমে ধানমন্ডি সাতাস নম্বরের দিকে চলে গেল।
ভাবছিলাম, কুকুরটা ইচ্ছে করলেই নিচের ফাঁকা রাস্তা দিয়ে রোড অতিক্রম করতে পারত, কিন্তু করেনি। আসল কারণ বিশ্লেষণ করার মত মনোবিজ্ঞানী আমি নই কিন্তু এটুকু বুঝতে দ্বিধা হয়নি আমরা এখনো এ শহুরে ভাসমান কুকুরটার চেয়ে যেন অনেকটাই পিছিয়ে আছি।
অন্য আর একদিন। প্রায় বছর পাঁচেক আগের কথা। একইভাবে সকালের হাঁটা শেষ করে বাসায় ফিরছি। ঢাকা শহরে ভাসমান মানুষের মত ভাসমান কুকুরের সংখ্যাও কম নয় কিন্তু। সকালে হাটার লোকসংখ্যার তুলনায় সংসদ এলাকার ভিতরে গণনায় কুকুরের সংখ্যাও তখন কম ছিল না। দুয়েকজন ভিআইপি সুন্দর ছোট্ট লাঠি হাতে নিয়ে হাটতেন। এতে দুটো কাজ হয়, প্রথমত এক ধরনের আভিজাত্য ফুটে উঠে, দ্বিতীয়ত কুকুরের আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করারও একটা উপায় বটে। এখানে আমার মনে হয় দ্বিতীয়টাই মুখ্য।
প্রায় প্রতিদিন আনাগোনার ফলে এদের (কুকুর) সাথে একটা পরিচিতি গড়ে উঠেছিল। বুদ্ধিমান কুকুর চোখের দিকে তাকালেই শত্রু মিত্র বুঝতে পারে। অপরিচিত দু’একজন পাশ দিয়ে গেলে ছোটখাটো আওয়াজ দেয় বৈকি! কারণ এদেরও নিজস্ব একেকটা এলাকা বা রাজত্ব আছে। সহসা বাহিরের কোন কুকুরও এদের রাজত্বে সহজে প্রবেশ করতে পারে না। তবে ছোট সময় গ্রামে বড় হয়েছি বিধায় কুকুরকে ম্যানেজ করার কৌশল কিছুটা জানা আছে। তাই কোন লাঠির ব্যবহার প্রয়োজন বোধ করিনি।
তেমনি একদিন সকালে হাঁটছিলাম। আমার কয়েক গজ সামনে এক ভদ্রলোক হাতে পলিথিনের ব্যাগে করে কিছু বিস্কুট, পাউরুটি নিয়ে যাচ্ছিলেন। পিছন পিছন একটা কুকুরও হাঁটছিল। হঠাৎ দেখলাম বিস্কুটের থলিটা কামড়ে ধরে কুকুরটা দৌঁড়ে ছোট বনটার ভিতর দিয়ে নাগালের বাইরে মাঝ মাঠে চলে গেল। নির্বিকার ভদ্রলোক নিরুপায় হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধীর পায়ে চলে গেলেন।
একটু পরেই আরো চার পাঁচটা কুকুর বাচ্চা সমেত হাজির ঐ কুকুরটার পাশে। খুব একটা ঝগড়াঝাঁটি না করে অল্পক্ষনেই সকলে মিলে খাবার সাবাড়।
মনে মনে ভাবছিলাম, চুরি করা খাবার ইচ্ছে করলে কুকুরটা একাকী নিভৃতে নিজেই শেষ করতে পারত। তা না করে সবাই মিলেমিশে ভোগ করল। কুকুর সেতো ভাসমান, ভবঘুরে, নিজের ক্ষেত খামার নেই, তাই চুরির কৌশলটা আয়ত্ত করতেই পারে। কিন্তু আমরাও কম কিসের! চাকুরীর সুবাদে অনেক কিছুইতো বোবার মত চেয়ে চেয়ে দেখলাম আর নীরব সাক্ষী হয়ে রইলাম। বিতর্কিতভাবে আহরিত আমাদের সম্পদ স্বার্থপরের মত কেবল নিজেরাই ভোগ করছি এবং এ নিয়ে লুকোচুরিও খেলছি বৈ কি। অন্যকে কখনো এতে ভাগ বসানোর সুযোগদানের প্রশ্নই উঠে না। অথচ সহায় সম্বলহীন কুকুরটা অবৈধ উপায়ে আহরিত তার খাবারটা একা ভোগ করেনি, ঠিকই উদারচিত্তে ভাগ বাটোয়ারা করে নিল।