হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসনের ভূমি বিভাগের কোন কর্মচারি আর কখনো দুর্নীতি করবেন না

মঈন উদ্দিন আহমেদ ॥ হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসনের ভূমি বিভাগে কর্মরত আড়াইশ কর্মচারি প্রতিজ্ঞা করেছেন তারা কোনদিন দুর্নীতি করবেন না। শপথবাক্যে তারা বলেন- এখন থেকে আমরা মনে করবো জনগণই আমাদের মালিক এবং আমরা জনগণের অতিনগণ্য বেতনভোগী কর্মচারি। শপথে তাঁরা অতীতের ভুল ভ্রান্তির জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মাক্ছুদুর রহমান পাটওয়ারী তাদেরকে শপথবাক্য পাঠ করান। সোমবার বিকেলে হবিগঞ্জ শহরের জেলা পরিষদ অডিটরিয়ামে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে স্বচ্ছ, দক্ষ ও জনবান্ধব ভূমি ব্যবস্থাপনা শুদ্ধাচার ও উত্তম চর্চা বিষয়ক প্রশিক্ষণে তাদেরকে এই শপথবাক্য পাঠ করানো হয়। জেলা প্রশাসক মাহমুদুল কবীর মুরাদ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাবৃন্দসহ জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাবৃন্দও শপথবাক্য পাঠ করেন।
হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক মাহমুদুল কবীর মুরাদের সভাপতিত্বে প্রশিক্ষণে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মাক্ছুদুর রহমান পাটওয়ারী বলেন, ভূমি মন্ত্রী চান জনগণের জন্য স্বচ্ছ, নির্ভুল এবং দক্ষভাবে কাজ করতে হবে যাতে করে তারা হয়রানীর শিকার না হন। এখন থেকে সকল ভূমি অফিসে সরকারের সকল কর্মকর্তার নামের তালিকা মোবাইল নম্বরসহ বোর্ডে দেয়া হবে যাতে করে যে কোন বিষয়ে জনগণ অভিযোগ দিতে পারে। আর মনে রাখতে হবে ভূমি মন্ত্রণালয়ে উপরী বলতে কোন জিনিস নেই। পদোন্নতি বা কোন কাজের জন্য এই মন্ত্রণালয়ে কোন উপরী দিতে হয় না।
তিনি বলেন, ভূমি জরিপ নিয়ে বেশী হয়রানীর অভিযোগ পাওয়া যায়। এখন থেকে এটি আর চলবে না। জরিপ সঠিক না হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে সোজা বাড়িতে পাঠানো হবে। আর সরকার জরিপের অটোমেশনের জন্য ১৩শ’ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করেছে। নামজারীর ভোগান্তির জন্য সরকার ই-নামজারী চালু করেছে। এখন ঘরে বসেই নামজারী করা যাবে। নামজারীর ফি ১১শ’ ৫০টাকা নির্ধারিত। অথচ বিভিন্ন অজুহাতে নেয়া হয় তারও অনেক বেশি। এখন থেকে নামজারির ফি বেশী কোথাও নিতে পারবে না। আগে ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে আবেদন নিষ্পত্তি করা হতো। এখন ২৮ কার্যদিবসের মধ্যে আবেদন নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। আর প্রবাসীদের ক্ষেত্রে শহরাঞ্চলের জন্য ৯ কার্যদিবস এবং গ্রামাঞ্চলের জন্য ১২ কার্যদিবসের মধ্যে আবেদন নিষ্পত্তি করতে হবে। তা অবশ্যই মানতে হবে। ইতোমধ্যে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ১ হাজার নয়া ভূমি অফিস তৈরি করে তাতে নতুন জনবল নিয়োগ দেয়া হবে। এসিল্যান্ডদেরকে গাড়ি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে জনগণকে দ্রুত সেবা দেয়ার জন্য এবং সরকারি জমি রক্ষা করতে। যদি কেউ এর মিস্ইউজ করে তাহলে গাড়ি কেড়ে নেয়া হবে। দেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকার ২৮ ভাগ ব্যয় হয় স্বল্প সংখ্যক সরকারি কর্মচারির পেছনে। আর অবশিষ্ট ৭২ ভাগ ব্যয় হয় বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য। যেখানে আমরা জনগণের টাকায় বেতনভুক্ত কর্মচারি সেখানে কেন আমরা জনগণের সাথে ভাল আচরণ করব না।
ভূমি সচিব আরো বলেন, ১৯৭১ সালে জাতির পিতার নির্দেশে বাংলার আপামর জনতা নিজের আরাম আয়েশ বাদ দিয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। কারো দয়ায় এ দেশ স্বাধীন হয়নি। ৩০ লাখ শহীদের তাজা রক্তের বিনিময়ে, দুই লাখ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। পাকিস্তান সরকার এক রায়ে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসির আদেশ দেয়। ওই সময় বঙ্গবন্ধু ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে তার শেষ ইচ্ছা জানিয়েছিলেন বাংলার মাটিতে যেন তার কবর দেয়া হয়। কতটুকু দেশ প্রেম থাকলে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে এমনটা বলা যায় তা আমাদের অনুধাবন করতে হবে। প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত কর্মচারিকে সকল সময়ে প্রত্যেক জনগণের অর্থাৎ নাগরিকের জন্য সেবা করার মানসিকতা থাকতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানে কোথাও কোন কর্মচারিকে কর্মকর্তা লিখা নেই। অথচ সাধারণ জনগণ আমাদের কাছে যখন সেবার জন্য আসে আমাদের ভাবটা এমন যে আমি মস্ত অফিসার। অনেক বড় কর্মকর্তা। তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেন, অবস্থাটা এমন পর্যায়ে এসে ঠেকেছে টাকা ছাড়া কোথাও কোন কাজ হয় না। এসিল্যান্ড অফিস বলেন, সাবরেজিস্ট্রার অফিস বলেন, থানা বলেন সর্বত্র একই চিত্র। শেখ হাসিনা সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স, মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। মাদক সেবনকারী আর মাদক বিক্রেতা তারা দেশের শত্রু, জাতির শত্রু। তাদের শক্তি অনেক পেছনে থাকে। তিনি বাস্তবতার আলোকে বলেন, অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলায় দেখা যায় একজন উকিলও নেই, অথচ ২ পুড়িয়া মাদক মামলায় আসামীর জামিন আবেদন চাইতে উকিলের সংখ্যা অনেক। যা সত্যিই ভাববার বিষয়। তিনি সামাজিকভাবে মাদকসেবী ও বিক্রেতাদের বয়কট করার আহবান জানান। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, কেউতো তার জীবদ্দশায় অর্জিত সম্পদ মৃত্যুর পর সাথে নিয়ে যেতে পারে না তবুও কেন তারা ঘুষ খায়। কার জন্য, কিসের জন্য ঘুষ খায়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় উপর শ্রেণিকে বিক্রি করে অনেকেই মোটা অংকের ঘুষ লেনদেন করে থাকেন। যার পুরোটাই প্রতারণা। আমাদের মনে রাখতে হবে উপর বলতে কিছু নেই। উপর হচ্ছেন আপনি নিজে। আপনি ঠিক হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। সাধারণ জনগণ আমাদের কাছে যে কাজের জন্য আসবে আমাদেরকে জনবান্ধব হয়ে সেই কাজ করে দিতে হবে। জাতির পিতা যেমন দেশের জন্য, দেশের জনগণের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন আমাদেরকেও আমলাতান্ত্রিক মনোভাব পরিহার করে দেশের সেবায়, দেশের জনগণের সেবায় আত্মনিয়োগ করতে হবে। যাদের মধ্যে জাতির পিতার চেতনা বিদ্যমান তারা কখনো অপরাধ করতে পারে না। তারা সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি অর্থাৎ অপরাধমূলক কর্মকান্ড করতে পারে না। আমাদের কথায় ও কাজে সুন্দর সম্পর্ক থাকতে হবে।
প্রশিক্ষণ কর্মশালায় আলোচনায় অংশ নেন হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক নুরুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এস এম ফজলুল হক, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক জেলা ইউনিট কমান্ডার মোহাম্মদ আলী পাঠান, জিপি অ্যাডভোকেট আফিল উদ্দিন, জেলা আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট আলমগীর চৌধুরী, হবিগঞ্জ প্রেসক্লাব সভাপতি হারুনুর রশিদ চৌধুরী, জিপি-ভিপি অ্যাডভোকেট আব্দুল মোছাব্বির বকুল প্রমূখ। শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) তারেক মোহাম্মদ জাকারিয়া।
অনুষ্ঠানে হবিগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মর্জিনা আক্তার, জেলার সকল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, এসিল্যান্ড, কানুনগো, তহসীলদারসহ জেলা প্রশাসনের কর্মচারিগণ উপস্থিত ছিলেন।