স্টাফ রিপোর্টার ॥ হবিগঞ্জের বানিয়াচঙ্গের কৃতি সন্তান, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের খ্যাতিমান শিল্পী সুবীর নন্দী স্মরণে ‘হবিগঞ্জ এসোসিয়েশন ঢাকার’ উদ্যোগে আজ শুক্রবার বিকেল ৪টায় ঢাকাস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহবাগ শহীদ ডক্টর মিলন অডিটোরিয়ামে এক স্মৃতিচারণ সভার আয়োজন করা হয়েছে। সভায় প্রয়াত এই গুণী শিল্পীর জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করবেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছির হোসেনসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। উক্ত স্মরণ সভায় বৃহত্তর সিলেটবাসি ও সুবীর নন্দীর সকল ভক্তদের উপস্থিতি কামনা করেছেন হবিগঞ্জ এসোসিয়েশন নেতৃবৃন্দ।
সুবীর নন্দী বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনে এক প্রবাদ পুরুষ। মহান এই কালজয়ী সংগীত শিল্পীর জন্ম ১৯ নভেম্বর ১৯৫৩ সালে হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং থানার নন্দীপাড়া নামক মহল্লার সম্ভ্রান্ত কায়স্থ সংগীত পরিবারে। বাবা সুধাংশু নন্দী ছিলেন একজন চিকিৎসক ও সঙ্গীত প্রেমী। মা পুতুল রানী ও ছিলেন সংগীতের প্রতি অনুরাগী। ছোটবেলা থেকে তিনি ভাই বোনের সঙ্গে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নিতে শুরু করেন ওস্তাদ বাবর আলী খানের কাছে। সুবীর নন্দী ১৯৬৩ সালে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়াকালীন সময়ে গান গাইতে শুরু করেন এবং ১৯৬৭ সালে তিনি প্রথম সিলেট বেতার কেন্দ্রে গান পরিবেশন করেন। এই সময় কালে তিনি বিদিত লাল দাসের কাছে সংগীতের বিভিন্ন রাগ কলা কৌশল রপ্ত করতে থাকেন। পরবর্তীতে ১৯৭০ সালে ঢাকা রেডিও তে প্রথম রেকর্ডিং মধ্য দিয়ে জাতীয় পর্যায়ে সংগীত পরিবেশনা করেন। প্রথম গান ‘যদি কেউ ধূপ জ্বেলে দেয়’ এর গীত রচনা করেন মোহাম্মদ মুজাক্কের এবং সুরারোপ করেন ওস্তাদ মীর কাসেম। পরবর্তীতে তিনি বেতার এর পাশাপাশি টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৭৬ সালে আব্দুস সামাদ পরিচালিত সূর্য গ্রহন চলচ্চিত্রের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৭৮ সালে আজিজুর রহমান পরিচালিত অশিক্ষিত চলচ্চিত্রে নায়ক রাজ রাজ্জাক সুবীর নন্দী গাওয়া গানে অভিনয় করেন। যা তখনকার সময় বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। গানটি ছিল ‘মাস্টার সাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই’। তারপর তিনি চলচ্চিত্রে একজন জনপ্রিয় প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন এবং একে একে চলচ্চিত্রে স্বনামধন্য চিত্র নির্মাতা সুবীর নন্দীকে সংগীত পরিবেশনের জন্য আহ্বান জানান। চলচ্চিত্রে গানের পাশাপাশি ১৯৮১ সালে তার একক অ্যালবাম ‘সুবির নন্দির গান’ ডিস্কো রেকর্ডিং ব্যানারে বাজারে আসে। সুদীর্ঘ ৪০ বছরে ২৫০০ এর বেশি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। পাশাপাশি অনেক গানে সুরারোপে মুখ্য ভূমিকা রাখেন।
চলচ্চিত্রে সুবীর নন্দীর জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে :
১। দিন যায় কথা থাকে; ২। আমার এ দু চোখ পাথর তো নয়; ৩। পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই; ৪। আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি; ৫। হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে; ৬। বন্ধু হতে চেয়ে তোমার; ৭। কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো; ৮। কেন ভালবাসা হারিয়ে যায়; ৯। তোমারি পরশে জীবন আমার ওগো; ১০। একটা ছিল সোনার কন্যা; ১১। ও আমার উড়াল পঙ্খীরে ইত্যাদি অসংখ্য জনপ্রিয় গানের মাধ্যমে উনি বাংলা সংগীতাঙ্গনকে সমৃদ্ধ করে মানুষের মনোরঞ্জন করতে সমর্থন হন।
সংগীতাঙ্গনে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান করেন- ১। ১৯৮৪ (মহানায়ক)
২। ১৯৮৬ (শুভদা), ৩। ১৯৯৯ (শ্রাবণ মেঘের দিন), ৪। ২০০৪ (মেঘের পরে মেঘ), ৫। ২০১৫ ( মহুয়া সুন্দরী)। এই বছর ২০১৯ সালে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। এছাড়াও তাকে তিনবার বাচসাস পুরস্কার ও দেশ বিদেশে বিভিন্ন সময় সম্বর্ধনা প্রদান করা হয়।
সুবীর নন্দী সংগীতের পাশাপাশি দীর্ঘদিন জনতা ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন। দেশ বিদেশে অনেক মঞ্চ অনুষ্ঠানে ভক্তকূলকে দীর্ঘদিন যাবৎ সংগীতের মূর্ছনায় আনন্দ দিয়ে গেছেন।
জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের আজীবন প্রিয় গান ছিল ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’ এই গানটির গীতিকার গিয়াস উদ্দিন ও সুরকার বিদিত লাল দাস আশির দশকের মাঝামাঝি সুবীর নন্দী এই গানটিতে কন্ঠ দিয়ে তুমুল জনপ্রিয় করে তুলেন। জনপ্রিয় বাউল শিল্পী শাহ আব্দুল করিমের ‘আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভ্রমরা’ ও ‘আমারে কেউ ছুঁইয়ো না গো সজনী’ এ দুটি গান সুবীর নন্দীর কন্ঠে প্রথম রেকর্ডিং হয় এবং অল্প সময়ের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে।
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের শিলচর, কলকাতা ও আগরতলায় সুবীর নন্দীর গান বেশ জনপ্রিয়। বলিউডের জনপ্রিয় প্লেব্যাক সিঙ্গার উদিত নারায়ন সুবীর নন্দীর একটি গান পুনরায় কলকাতার একটি চলচ্চিত্রে পরিবেশন করেন।
সুবীর নন্দী দীর্ঘদিন যাবত ফুসফুস কিডনি ও হৃদ রোগে ভুগছিলেন। এ বছর ২০১৯ সালে ১৪ এপ্রিল তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করেলে ৩০ এপ্রিল তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু পৃথিবীর সকল মায়া ত্যাগ করে এই শিল্পী দেশ বিদেশের অসংখ্য ভক্তদের অশ্রুসিক্ত করে ৭ মে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। সুবীর নন্দীর পরলোক গমনের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষাভাষী সংগীত অঙ্গনে একটি ধ্রুবতারার পতন হয়।