একজন হাসান শাহরিয়ার:
দায়িত্বশীল ও নীতিনৈতিকতা সম্পন্ন সাংবাদিকতার পথিকৃৎ
ড. জহিরুল হক শাকিল
চলে গেলেন দেশের কিংবদন্তীতুল্য সাংবাদিক বৃহত্তর সিলেট তথা বাংলাদেশের কৃতিসন্তান হাসান শাহরিয়ার। গতকাল ১০ এপ্রিল সকাল সাড়ে ১১টায় ঢাকার ইমপালস হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসারত অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন। বাংলাদেশের সৎ, নিষ্ঠাবান, দৃঢ়চেতা ও পাহাড়সম ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষটি ৭৬ বছর বয়সে করোনার কাছে পরাজিত হয়ে এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুসে সংক্রমণসহ বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগছিলেন হাসান শাহরিয়ার। গত ৮ এপ্রিল দিবাগত রাত দেড়টার দিকে অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথমে তাঁকে রাজধানীর ল্যাব এইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে তাকে আনোয়ার খান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু কোথাও আইসিইউ বেড না পাওয়া রাজধানীর ইমপালস হাসপাতালে নেওয়া হয়। শনিবার চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মৃত্যুর কয়েক মিনিটের মধ্যেই বাংলাদেশের প্রধান সংবাদমাধ্যমের অনলাইন ভার্সনে ও টিভি চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে খবরটি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও হাসান শাহরিয়ারের মৃত্যু সংবাদটি গুরুত্ব সহকারে প্রচার হয়। অনেকের ফেসবুকের টাইমলাইনে পথিকৃৎ সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ারের জীবন-কর্ম ও তাঁর সাথে কাজের অভিজ্ঞতা, সম্পৃক্ততা নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এমপিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হাসান শাহরিয়ারের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘সাংবাদিকতায় হাসান শাহরিয়ারের অবদান মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এদেশের সাংবাদিকতায় হাসান শাহরিয়ারের ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’
হাসান শাহরিয়ারকে কেবল জাতীয় পর্যায়ের একজন সাংবাদিক ও কলামিস্ট বললে তাঁর কর্ম ও অবদানকে খাটো করা হবে। তিনি বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় আন্তর্জাতিকতা যুক্ত করেছেন। হাসান শাহরিয়ারের মাধ্যমে বিশ্বের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা বাংলাদেশের সংবাদপত্র শিল্প সম্পর্কে জেনেছে; বাংলাদেশকে জেনেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাত্তোর প্রতিটি জাতীয় সংকটে দেশ ও বিদেশের সংবাদপত্রে তিনি শুধু লেখালেখি করেননি; বিষয়ভিত্তিক মন্তব্য করেছেন। তিনি মনেপ্রাণে আওয়ামী লীগের আদর্শ ও চিন্তাচেতনায় বিশ্বাসী হলেও তাঁর কোনো রিপোর্টে বা কলামে কারো পক্ষাবলম্বন করেননি। আজকের যুগে হাতে গোনা যে কয়েকজন ব্যক্তি সাদাকে সাদা বা কালোকে কালো বলতে পারেন তিনি ছিলেন তাদের একজন। দেশের সংকট ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে অনেক সংবাদ পরিবেশন করেছেন; কলাম লিখেছেন। কিন্তু দেশকে, দেশের ব্যবস্থাকে কোনো সময় খাটো করেননি। একজন সত্যিকারের দায়িত্বশীল সাংবাদিক ছিলেন। তাঁর লেখনির মাধ্যমে দেশের অনেক জাতীয় সংকটের সমাধান হয়েছে। সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে নতুন সংকট তৈরী করেননি; পরিস্থিতিকে আরো জটিল করেননি। সাংবাদিকতায় যে নীতিনৈতিকতা বলে একটি ব্যাপার আছে আমরা হাসান শাহরিয়ারের সাংবাদিক জীবনে তা পুরোপুরি দেখেছি।
বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য থেকে শুরু করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থাভাজনসহ আওয়ামীলীগের অনেক মন্ত্রী-এমপির সাথে সুসম্পর্ক থাকলেও হাসান শাহরিয়ার তা বিকিয়ে কোনো ফায়দা নিয়েছেন বলে জানা নেই। ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসলে হাসান শাহরিয়ারকে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় ও সরকারী দায়িত্ব প্রদানের প্রস্তাব করা হয়। দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হাসান শাহরিয়ার সেসময় ক্ষমতার দূরেই থাকেন।
হাসান শাহরিয়ার ১৯৪৪ সালের ২৫ এপ্রিল সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার বিন্নাকুলী গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত ও রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতা মকবুল হোসেন চৌধুরী ছিলেন অবিভক্ত আসাম-বাংলার বিশিষ্ট সাংবাদিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, খেলাফত আন্দোলনের নেতা ও ভাষাসংগ্রামী। ঐতিহ্যবাহী সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মকবুল হোসেন চৌধুরী ১৯৩৭ সালে আসাম ব্যবস্থাপক সভার সদস্য (মেম্বার অব লেজেসলেটিভ এসেমব্লি বা এমএলএ) নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন পত্রিকা ‘যুগভেরী’র (১৯৩২) প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। সিলেটের ‘যুগবাণী’ (১৯২৫) ও কলকাতার দৈনিক ‘ছোলতান’ (১৯৩০) পত্রিকারও সম্পাদক ছিলেন হাসান শাহরিয়ার পিতা মকবুল হোসেন চৌধুরী। হাসান শাহরিয়ারের বড় ভাই হোসেন তওফিক চৌধুরীও বিশিষ্ট আইনজীবী ও কলামিস্ট। জমিদার পরিবারের সন্তান হয়েও হাসান শাহরিয়ার নামের সাথে কখনও চৌধুরী ব্যবহার করেননি। সুদর্শন ও পোষাকে আশাকে পরিপাটি হাসান শাহরিয়ার হাস্যোজ্জল মুখ দেখলে অনেকেই বিমুগ্ধ হয়ে যেতেন। যে কোনো ব্যক্তির পেছনে সমালোচনা করা বা কুৎসা রটনা আমাদের সমাজের এক বৈশিষ্ঠ হয়ে যেখানে দাড়িয়েছে সেখানে হাসান শাহরিয়ারকে নিয়ে কাউকে সমালোচনা করতে দেখেনি; তিনি নিজেও কারো পেছনে বা অনুপস্থিতিতে কোনো নেতিবাচক মন্তব্য করতেন না। দেখতে যেমন সুদর্শন ব্যক্তিজীবনেও পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করতেন। তিনি ছিলেন চিরকুমার।
হাসান শাহরিয়ার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে লেখাপড়া শেষ করে ১৯৬৭ সালের দিকে উচ্চশিক্ষার্থে পশ্চিম পাকিস্তান বা বর্তমান পাকিস্তানের করাচিতে যান। সেখানে তিনি পাকিস্তানের জনপ্রিয় দৈনিক ডনের সাংবাদিক হিসেবে সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন। ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকের পশ্চিম পাকিস্তান প্রতিনিধি। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে তিনি ইত্তেফাক পত্রিকায় একজন পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের ও মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ কাভারেজ দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য হন। হাসান শাহরিয়ার দৈনিক ইত্তেফাকের কূটনৈতিক রিপোর্টার, চীফ রিপোর্টার, বার্তা সম্পাদক ও সর্বশেষ ২০০৮ সালে নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে অবসরে যান। ইত্তেফাকের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সাময়িকী নিউজ উইক, আরব নিউজ, ডেকান হ্যারাল্ড, ডেইলি সানসহ বিভিন্ন পত্রিকার বাংলাদেশের প্রতিনিধি ছিলেন। ইংরেজী, উর্দু ও হিন্দি ভাষায় দক্ষ ছিলেন হাসান শাহরিয়ার। তিনি ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক থাকাকালীনই বাংলাদেশের প্রথম রঙ্গীন সংবাদপত্র হিসেবে ইত্তেফাক প্রকাশিত হয়।
হাসান শাহরিয়ার একজন পেশাদার সাংবাদিকের পাশাপাশি সাংবাদিকদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেতৃত্বও দিয়েছন। ১৯৯৩-৯৪ সালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি হাসান শাহরিয়ার কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের (সিজেএ) আন্তর্জাতিক সভাপতি হিসেবে দু’মেয়াদে দায়িত্বপালন করেন। ছিলেন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সংগঠন ওভারসিজ করেসপন্ডেন্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ওকাব) এর সভাপতি। তিনি ছিলেন সাংবাদিকদের একজন সত্যিকারের অভিভাবক।
সিলেটের মানুষজন ঢাকায় যেকোনো প্রয়োজনে বা সংকটে পড়লে হাসান শাহরিয়ারের সহায়তা পেতেন। হাসান শাহরিয়ারের রেফারেন্স এর মাধ্যমে অনেক কাজের সমাধান হতো। সাংবাদিকতার মাধ্যমে সমস্যা সংকট তুলে ধরে বৃহত্তর সিলেটের উন্নয়নের ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। সিলেট বিভাগ আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
হবিগঞ্জের বিশেষত হবিগঞ্জের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের সাথে হাসান শাহরিয়ারের ছিলো সুসম্পর্ক। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের অনেক বড় বড় অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে এসেছেন। হবিগঞ্জের প্রথম অফসেট ও কম্পিউটারাজড পত্রিকা সাপ্তাহিক খোয়াই এর মানোন্নয়নের বিশেষ অবদান রাখেন। পত্রিকাটি দীর্ঘদিন ঢাকা থেকে তৎকালীন বার্তা সম্পাদক হারুনুর রশিদ চৌধুরীর মাধ্যমে ছাপা হতো। আর ওই পত্রিকার গেট আপ দিতেন হাসান শাহরিয়ার। হারুনুর রশিদ চোধুরী আজ হবিগঞ্জের মুখ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক। পত্রিকাটি গেটআপ ও সংবাদ প্রকাশে খুব কম সময়ের মধ্যে জনপ্রিয়তা পাওয়ার অন্যতম কারন হলো হারুনুর রশিদ চৌধুরীর দীর্ঘদিন হাসান শাহরিয়ারের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা। একসময় খোয়াই পত্রিকায় কাজ করার সুবাদে হারুন ভাই’র মাধ্যমে আমার হাসান শাহরিয়ারের জ্ঞান-অভিজ্ঞতার কাছে আসার সৌভাগ্য হয়েছে। আমি যখন নিউজ লিখতাম তখন মোটামুটিধরনের একটা হেডলাইন বা শিরোনাম দিয়ে দিতাম। ঢাকায় হাসান শাহরিয়ার দিতেন চূড়ান্ত শিরোনাম। আজও খোয়াই পত্রিকার কতগুলো শিরোনাম হবিগঞ্জের মানুষের মুখে মুখে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পৌরসভার পানির টেপ থেকে পাইপ দিয়ে থানা কোয়ার্টারে এক দারোগার পানি নেয়ার সচিত্র সংবাদের শিরোনাম দিয়েছিলেন, পানির কল তুমি কার? জনতার না দারোগার? আবার হবিগঞ্জের এক প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজের সংবাদের শিরোনাম দিয়েছিলেনঃ কে ছুতে পারবে সিংহ শাবকের কেশাগ্র? প্রেমিকাকে প্রেমিক থেকে বন্দি করে রাখা সংক্রান্ত সংবাদের শিরোনাম দিয়েছিলেনঃ পুরুষ কন্ঠ শুনলেই মিলির মন বলে ওঠে শংকর এলো বুঝি।
সংবাদ পরিবেশনায় অনেক সময় সাহিত্যিক হয়ে উঠতেন। সিলেটের গুচ্ছগ্রাম নিয়ে লিখতে গিয়ে লিখেছেন, ‘আমি আমার প্রেমিকারে লইয়া ভাবতে থাকি। হারাইয়া ফেলছি তারে। যেন রাস্তায় হাঁটতেছি একদিন আর পকেট থেইকা পইড়া গেল রূপার আধুলি। কাদা ছিল রাস্তায়। শব্দ শুনি নাই। যেন সময় থেইকা অনেক আগে যেই অবসাদ আর হাহাকার লইয়া আমাদের মাঝখানে একা একা বিপুল আকাশে কাতর নক্ষত্রের তাপ মাপতেছিলেন সবচেয়ে উজ্জ্বল আর সবচেয়ে আহত কবিটি, তার হৃদয়ের সব ঘাস জমতেছিল আমার বুকে। আস্তে আস্তে। আমার কথা শুনবে কে? ও গুচ্ছগ্রাম, এই বিনীত বৃষ্টির রাতে আমি ফের ধসে পড়তেছি আমার নিজের অসীম শূন্যস্থানে। এই টিলার শহরে। আর তোমারে ভাবতেছি। যেমন ভাবতাম আমার প্রেমিকারে লইয়া। খর পানির জঙ্গলে। যেন ফের মুখোশ খুইলা বসতেছি আমি ঘরের জানালায়। ও গুচ্ছগ্রাম, আসো তোমারে একটা গান শুনাই এইবার আর্টসেলের স্বরে- ‘অবশ অনুভূতির দেয়াল’। ‘তোমার জন্য বিষন্ন এক নিথর হৃদয়/ আমার ভেতর দাঁড়ায় সরব একা/ তোমার পৃথিবী স্বর্গের মতো চির অদেখা’…”
একটি মফস্বল এলাকায় জন্ম নিয়ে এক জীবনে একজন মানুষ কতো দূরই বা যেতে পারে। তাও আবার রাজনীতি বা সরকারী আমলা হয়ে নয়; একজন সাংবাদিক হিসেবে। হাসান শাহরিয়ার সেদিক থেকে একজন সফল মানুষ। জাতীয় পর্যায় থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাঁর নামযশ। সিলেট ও বাংলাদেশ একজন হাসান শাহরিয়ারের প্রয়োজন অনুভব করবে দীর্ঘদিন।
লেখকঃ ড. জহিরুল হক শাকিল, অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট। ই-মেইলঃ jahirul-psa@sust.edu