জীবনের প্রথম বিদেশ যাত্রা
জালাল আহমদে
আমি অকূল পাথারে! নোয়াখালীতে আবার কি হলো? বিষয় জলবৎ তরলং, পানির মত সোজা, উপকূলে যা হয়, ১০ নাম্বার মহাবিপদ সংকেত। আমি আগের দিন ৩ নাম্বার দেখে এসেছিলাম, দুইদিনে যে ১০ হয়েছে সে খবর পাই নাই অথবা আমি না থাকলে ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হবে এই কথা ভাবি নাই হয়তো। যাই হোক কিছু করার নেই, ধরা তো পড়েছি। সচিবালয় থেকে বের হয়ে নোয়াখালী চলে গেলাম। বাংলাদেশের উপকূলে ১৬ মে ১৯৯৭ এর আগে থেকেই এই ঘূর্ণিঝড়ের জন্ম। ১৯ মে তারিখে এটা চট্টগ্রামের উপকূলে আঘাত হানে। বাতাসের গতিবেগ ছিল ২১৫ কিলোমিটার/ঘন্টা পর্যন্ত, সংগে ১০ ফুট পর্যন্ত জলোচ্ছ্বাস। তার আগের ২৪ ঘন্টায় আমরা উপকূলের মানুষজনকে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়া আসার কারণে নোয়াখালীতে কোন প্রাণহানি হয় নাই। ২০ তারিখ সকালের মধ্যে এই ঝড় প্রায় অস্তিত্বহীন হয়ে যায়। জেলা প্রশাসক মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সংগে কথা বলেন এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব কেবল আমাকে যাবার অনুমতি দিলেন জেলা প্রশাসককে না।
আমি ঐদিনই ঢাকা চলে আসি, পরদিন ২১ মে দুপুরে থাই এয়ারওয়েজ এর ফ্লাইটে ব্যাংকক হয়ে আমস্টারডাম। আমি আগে উল্লেখ করেছি যে সিডিএসপি প্রকল্পে একজন ডাচ টিম লিডার ছিলেন, আর্নেড ভ্যান রিজেন, তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম পোষাকের বিষয়ে এবং সে বললো যে আমরা খুব ভালো সময়ে যাচ্ছি, মে-জুন, গ্রীষ্ম, হাফ শার্ট পরেই ঘুরতে পারবো। ইতোমধ্যে দলের বাকি ১২ জন চলে গিয়েছেন। আমি যাবার আগে সকালে আয়োজক প্রতিষ্ঠানকে জানানোর সুযোগ পেলাম কিন্তু আমস্টারডামে কি ব্যবস্থা থাকবে তা নিশ্চিত ছিলাম না। আর যেতে হবে আমস্টারডাম নেমে আরো দূরের এক বিশ্ববিদ্যালয় শহর ভাগেনিংগেন এ। আরেকটা কাজ ছিল বৈদেশিক মুদ্রা জোগাড় করা। আমি যেদিন সরকারি আদেশ পেলাম ঐদিন বিকেলে সংগ্রহের ইচ্ছা ছিল কিন্তু ফিরে যেতে হয়েছিল নোয়াখালী।
ঢাকা আসার আগেই হাতিয়ার এমপি, বাংলাদেশের একজন পথিকৃৎ তৈরী পোষাক ব্যবসায়ের উদ্যোক্তা হাতিয়া’র সংসদ সদস্য ফজলুল আজিমের সংগে কথা বলি। তিনি তাঁর একান্ত সচিব সাঈদের সংগে যোগাযোগ করিয়ে দেন। ফলে সকালেই স্কাউট ভবনে সাঈদের সংগে গিয়ে দেখা করি ও প্রতি ইউএস ডলার ৪৫ টাকা করে সংগ্রহ করি। ফ্লাইট ছিল দুপুর দেড়টায়, যথাসময়ে এয়ারপোর্টে এসে প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা সেরে ফ্লাইটে চেপে বসি। পথে ব্যাংককে প্রায় ৭ ঘন্টা ট্রানজিট, এ সময়ে বিশ্রাম নেবার জন্য একটা এয়ারপোর্ট হোটেলের কুপনও ধরিয়ে দেয়া হল। জীবনের প্রথম বিদেশ যাত্রা, স্বাভাবিক একটা উত্তেজনা কাজ করছিল তবে অনেক কিছুই চেনা চেনা মনে হচ্ছিল, দীর্ঘদিন মাসুদ রানা পড়ার ফল। মাসুদ রানা যেমন ব্যাংকক গিয়েছে অনেকবার, তেমনি আমস্টারডামেও গিয়েছে। ফলে আমি যেন যাচ্ছিলাম আমার চেনা পরিমন্ডলে। আমি সবসময় বিমানে জানালার পাশের সিট পছন্দ করি, জানালার পাশে বসে মেঘনা মোহনার উপর দিয়ে নোয়াখালী চট্টগ্রাম পার হয়ে মায়ানমার, তারপর থাইল্যান্ড।
ব্যাংকক ফ্লাইট সম্ভবতঃ দুই ঘন্টার ছিল, দুই ঘন্টা শেষে ব্যাংককে নেমে ৭/৮ ঘন্টা অপেক্ষা। কুপন দেখিয়ে বিমান বন্দরের এক প্রান্তে বিশ্রামের বিছানা পাওয়া গেল একটা, ছোট্ট রুমে ছোট্ট বিছানা। আমি হ্যান্ড লাগেজ রেখে বিমানবন্দরে এক চক্কর দিয়ে এলাম। রুমে ঢুকে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু ঘুম আর আসেনা, যদি ঘুম ভাংতে দেরী হয় আর বিমান চলে যায়! তখনো ওই গল্প শুনি নাই যে “ট্রেন যাবে কেমনে, টিকেট তো আমার কাছে”! পরের অভিজ্ঞতা তাই, যাত্রী রেখে প্লেন চলে যাওয়া কঠিন কাজ। খোঁজাখুঁজি করে একবারেই যদি না পায়, অগত্যা লাগেজ আনলোডিং এর মত ঝামেলার কাজ করেই যেতে পারে। তাই একবার রুমে ঢুকি আবার বাইরে গিয়ে হাঁটাহাঁটি এই করেই সময় পার করে যথাসময়ে আমস্টারডামের লং ফ্লাইটে উঠলাম। ঢাকা থেকে দুই ঘন্টা দক্ষিন-পূর্বে গিয়ে আবার উত্তর পশ্চিমে উড়ান, প্রায় ৪ ঘন্টা ফাউ উড়ান শুধু থাই এয়ারওয়েজের টিকেটের কারণে।
তখন কেএলএম এর ঢাকা আমস্টারডাম ফ্লাইট বন্ধ হয়ে গিয়েছে আর ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ খরচ সাপেক্ষ, তাই সস্তা থাই। লম্বা জার্নি, আমার আসছেনা ঘুম, বিমান যাচ্ছে পূর্ব থেকে পশ্চিমে, রাতের আঁধারও আমাদের সংগে পশ্চিমে যাচ্ছে। বিমানের ভেতর অন্ধকারে জেগে থাকা আর ঘন্টা মিনিট গোনা। প্রথম বিদেশ সফর তাই সব অভিজ্ঞতাই নতুন। ঢাকা-ব্যাংকক ফ্লাইটে বাংলাদেশি যাত্রীই ছিল বেশি, প্লেন আকারে ছোট, পরিবেশও ছিল ভিন্ন। যদিও এই ফ্লাইট যাচ্ছে এশিয়া থেকে ইউরোপে, যাত্রী সমাবেশ আর পরিবেশ দুটোই পুরো আন্তর্জাতিক। খাবারও ছিলে ভালো। কোমল এবং কঠিন, দুধরণের পানীয়ই সরবরাহে ছিল। আমার পাশের যাত্রী ছিল এক মহিলা। জিন্স ট্রাউজার আর জিন্স জ্যাকেট পরা এই মহিলা যাচ্ছে ইন্দোনেশিয়া থেকে জুরিখ, সুইজারল্যান্ড। যদিও আমার জানা ছিল যে এই ফ্লাইটটা যাচ্ছে সরাসরি আমস্টারডাম! সেই যে দুই ট্রেন যাত্রী উঠেছে ট্রেনে, লোয়ার বার্থের জিজ্ঞাসায় আপার বার্থ জানালো যে সে যাচ্ছে সিলেট। লোয়ার বার্থ যাবে চট্টগ্রাম, সে ভাবলো বিজ্ঞানের কি অপার খেলা, একই ট্রেনের আপার বার্থ যাবে সিলেট, লোয়ার বার্থ চট্টগ্রাম!!
আমারো তখন সেই দশা, আমস্টারডামের প্লেনে উঠে যদি জুরিখে নেমে আমস্টারডাম যেতে হয় তাহলেই গেছি! ঘুমিয়ে যাবার আগে মহিলা যে গল্প করলো তাও আগে গল্পেই পড়েছি। সে ছিল এক সুইস ট্যুরিস্টের ইন্দোনেশিয়া সফরে লোকাল গাইড। এখন সেই ট্যুরিস্ট তাকে স্পন্সর করেছে সুইজারল্যান্ড যেতে এবং সে গিয়ে সেখানে তাঁর কাছেই উঠবে। এ যেন আগে শোনা আমেরিকানদের এশিয়ায় বা আরবদের ভারতে ওয়েডিং ট্যুরের মত। কিছুক্ষণের মধ্যে নিরুদ্বিগ্ন সে ঘুমিয়ে গেল আর আমি একলা জেগে রইলাম! সকালের দিকে প্লেন নামলো জুরিখে। সেখানে প্লেনের পাইলট ও কেবিন এটেন্ডেন্টস বদল হবে। আমাদের সামনেই তারা প্রস্তুত হয়ে নেমে গেল, আমাদেরও এক ঘন্টার জন্য এয়ারপোর্টে নামার অনুমতি দিল। আমরা নেমে গেলাম, হাঁটাহাঁটি করলাম, সুইস চকোলেট চেখে নিলাম।
প্লেনের মধ্যে ঝাড়পোঁচ হয়ে নতুন পাইলট ও কেবিন এটেন্ডেন্টস নিয়ে তৈরী। ফেরার পথেও জুরিখ নেমেছিলাম কিন্তু তখন আর কর্মী বদল হয় নাই আমরাও নামি নাই। এমন অভিজ্ঞতা আমার পরবর্তীতে আর হয় নাই। আমস্টারডাম পৌঁছালাম গিয়ে সকাল ১০টার দিকে। অনভিজ্ঞতার কারণে আশংকায় ছিলাম এয়ারপোর্টে কেউ আসবে না হয়তো আমাকে রিসিভ করতে। বিমান থেকে বের হয়ে ইমিগ্রেশন পার হয়ে লাগেজ সংগ্রহ করলাম। আমার ভ্রমনোপযোগী ভালো স্যুটকেস ছিল না, মনে সাধ যে এখান থেকে ভালো দেখে একটা স্যুটকেস কিনে নিব। লাগেজ বেল্ট থেকে বের হয়ে মিটিং এন্ড গ্রিটিংস প্লেসে আসতেই নাম লিখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জানে পানি এল। আমাকে নিয়ে তুললো এক মাইক্রোবাসে। যাবো ১০০ কিলোমিটার দূরের এক বিশ্ববিদ্যালয় শহর ভাগেনিংগেন এ।