জালাল আহমেদ

১৯৯৫-৯৬ বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য সময়

১৯৯৫-৯৬ বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য সময়। ১৯৯৪ সালে আমি চট্টগ্রামে থাকাকালেই আওয়ামী লীগ ও তাঁর মিত্ররা সংসদ থেকে পদত্যাগ করে। সংসদ বাস্তবে অকার্যকর হয়ে পড়ে। তৎকালীন স্পীকার পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে তাঁদের অনুপস্থিত বিবেচনা করতে থাকেন ফলে ৯০ কার্যদিবসের ক্ষনগণনা শেষে ১৪৭ জনের পদ শূন্য হয়। আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী যুগপৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করতে থাকে। বিএনপি প্রথম থেকেই এই দাবির প্রতি কান দেয়নি এবং সরকার প্রধানও বিভিন্ন বিরূপ মন্তব্য করেন। শূন্য পদে উপনির্বাচন সম্ভব না হওয়ায় মহামান্য রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেংগে দেন এবং নির্বাচন কমিশন নতুন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে থাকে। প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। এই অবস্থায় একাধিক তারিখ পরিবর্তনের পর ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়। প্রধান বিরোধী দলসমূহের অনুপস্থিতি ও প্রতিরোধের মুখে একটি যথাযথ নির্বাচন অনুষ্ঠান চ্যালেঞ্জিং ছিল।
তখনো জেলা প্রশাসক ছিলেন মশিউর রহমান। তাঁর একটি গুন ছিল যে তিনি সকলের সংগে ব্যক্তিগত ভালো সম্পর্ক রেখে চলার চেষ্টা করতেন। এটি চমৎকারভাবে ফল দেয় এই নির্বাচনের সময়। ১৫ ফেব্রুয়ারি সকল বিরোধী দল দেশব্যাপী হরতাল আহবান করে। এই সর্বব্যাপী হরতালের মাঝে নির্বাচন অনুষ্ঠান চ্যালেঞ্জিং এবং ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। সারাদেশে ঐদিন ১৮ জন মারা যায় কিন্তু নোয়াখালীতে সাধারণভাবে দিনটি শান্তিপূর্ণভাবে কাটে। আর জেলা প্রশাসক মশিউর রহমান আমাদের অফিসেই থাকতে বলেন। ফলে আমরা সারাদিন একবারও অফিস থেকে বাইরে না গিয়ে কাটিয়ে দেই। দিনের সবচেয়ে খারাপ খবরটা আসে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা থেকে। জাতীয় পার্টি’র মওদুদ আহমেদ এবং আওয়ামী লীগের ওবায়দুল কাদের এর মত দুইজন বড় নেতার উপজেলায় কঠোরভাবে হরতাল পালিত হচ্ছিল। দুপুরের দিকে খবর আসে যে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার কোন এক এলাকায় রাস্তা কেটে দিয়ে সেনাবাহিনীকে আটকে দেয়া হয়েছে। খবর পেয়ে স্বভাবতঃই আমরা সবাই উদ্বিগ্ন। উদ্বিগ্ন দ্বিবিধ কারণে। সেনাবাহিনীর উপর হামলা হলে তারা “শুট টু কিল” গুলি চালাবে, আর আমাদের কাকে যেতে হয় সেনাবাহিনীর উদ্ধারে!
জেলা প্রশাসক উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দুজনকে কাজে লাগালেন এই সংকট মোচনে। তিনি অফিসে বসে টেলিফোনে টেলিফোনে ঐ দুজনকে দায়িত্ব দিলেন নিজেদের হরতাল ভেঙ্গে মোটরসাইকেল নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে রাস্তা মেরামত করে সেনাবহিনীকে উদ্ধার করে উপজেলা সদরে এনে জেলা প্রশাসককে জানানোর জন্য। তাঁরা দু’জন তাই করলেন। কার্যক্ষেত্রে সুসম্পর্ক কি রকম ফলদায়ী এটা সেদিন নতুন করে দেখলাম এবং এটা কখনো ভুলিনি। ফরমাল অরগ্যানাইজেশন এবং ইনফরমাল অরগ্যানাইজেশন বলে দু’টো কথা আছে। অনেক সময়ই প্রশাসনের জন্য ইনফরমাল অরগ্যানাইজেশন এন্ড কমিউনিকেশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সেই নির্বাচনে কোম্পানীগঞ্জ আসনে যিনি বিজয়ী হয়েছিলেন তিনি ভোট পেয়েছিলেন ২৬০০ প্লাস। এই ভোট বাড়ানোর জন্য দেখেছি তাঁর কাকুতি মিনতি। ‘ইজ্জত কা সওয়াল’ ছিল এই ২৬০০ প্লাস ভোটে এমপি হওয়া কিন্তু আমাদের কিছু করার ছিল না, কাস্টিং ভোটেই তিনি এমপি হন।
একতরফা নির্বাচনে বিএনপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। এরপরের অবস্থা আমরা সবাই জানি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন আরো জোরদার হয় এবং এই সংসদেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল উত্থাপিত হয়। একই সময়ে ঢাকার তৎকালীন মেয়র মোহাম্মদ হানিফ জাতীয় প্রেসক্লাব এর সামনে জনতার মঞ্চ নামে একটি রাজনৈতিক সমাবেশের আয়োজন করেন এবং সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত তা লাগাতার চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এই মঞ্চে আওয়ামী লীগের সমমনা রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন এবং এমন কি সরকারী কর্মকর্তাদের কেউ কেউ যোগদান করেন। কর্মরত সচিবদের একটি বড় অংশ রাষ্ট্রপতি’র সংগে দেখা করে দায়িত্ব পালনে তাঁদের অপারগতা প্রকাশ করেন। “বঙ্গভবনে যাওয়া এবং জনতার মঞ্চে যোগদানের ক্ষেত্রে যিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি হচ্ছেন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, যিনি পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী হয়েছিলেন।”
২০১৬ সালের ২৪ মার্চ দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকায় ‘জনতার মঞ্চ-ফিরে দেখা’ শিরোনামে একটি কলাম ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর লিখেন “৭ই মার্চ সন্ধ্যায় অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, আওয়ামী লীগ নেতা খ ম জাহাঙ্গীর ও শিল্পীদের মুখপাত্র সৈয়দ হাসান ইমাম সুধা সদনে জননেত্রী শেখ হাসিনার সংগে সাক্ষাৎ করেন। তৎকালীন সিভিল সার্ভিস প্রশাসনের মহাসচিব হিসেবে আমার সংগে আলোচনা করে তাঁদের নেত্রীর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন সহকর্মী রবিউল আলম মোক্তাদির চৌধুরী (এখন সংসদ সদস্য)।” “মুনতাসীর মামুন, খ ম জাহাঙ্গীর ও হাসান ইমামের সংগে আলোচনা করে জননেত্রী শেখ হাসিনা ঢাকার নির্বাচিত মেয়র আওয়ামী লীগের নগর নেতা মোহাম্মদ হানিফকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে একটি একক মঞ্চ স্থাপন করে বিক্ষোভ, প্রতিবাদ এবং দাবি সমন্বিত ও সোচ্চারভাবে উপস্থাপনের নির্দেশ দেন”। যখন নানাদিক থেকে আন্দোলন তীব্রতর হচ্ছে, তখন ৩০ মার্চ প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পরামর্শে সংসদ ভেঙ্গে দেন রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাস। পদত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ করে গঠিত হয় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তত্ত্বাবধায়ক সরকার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে থাকে। এর মাঝেই সেনাবাহিনীর একটি অংশ থেকে একটি অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা হয়। সেনাপ্রধান রাষ্ট্রপতির একটি নির্দেশ পালনে পরাক্সমুখ হলে সেনাপ্রধানের বিদ্রোহ প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় ও নতুন সেনাপ্রধান নিয়োগ দেয়া হয়। ১২ জুন ১৯৯৬ তারিখে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচন ঘরে বসে করার ছিল না। আমি সকালে বাসা থেকে বের হয়ে বাসার কাছে নোয়াখালী কারামতিয়া মাদ্রাসা সেন্টারে নিজের ভোট দেই এবং তারপর সারাদিনের জন্য নির্দিষ্ট এলাকায় টহলে বের হয়ে যাই। নির্বাচন ছিল শান্তিপূর্ণ।
অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হয় ও আওয়ামী লীগ এতে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ১৪৬, বিএনপি ১১৬, জাতীয় পার্টি ৩২ ও জামাতে ইসলামী ৩টি আসন লাভ করে। শতকরা হারে আওয়ামী লীগ ৩৭.৪, বিএনপি ৩৩.৬, জাতীয় পার্টি ১৬.৪ এবং জামাতে ইসলামী ৮.৬ ভোট লাভ করে। জাতীয় পার্টি ও জামাতে ইসলামী তাদের এই ভোটের হারেই পরবর্তীতে এখন পর্যন্ত দুই বড় দলকে প্রভাবিত করে আসছে। স্বৈরাচারী হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদও জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাঁর আপেক্ষিক গুরুত্ব ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছিল।