আমরা চাই ভালবাসার বাংলাদেশ গড়ে উঠুক ॥ আনিসুল হক
শিশুদের মধ্যে মানবিকতা সৃষ্টি করতে হবে ॥ সেলিনা হোসেন
মনসুর আহমেদ ॥ ফাগুন উৎসব আর দুই ভাষা সৈনিকসহ ৪ গুণিজনকে সম্মাননা জানানোর মধ্য দিয়ে উদ্বোধন হল মানিক চৌধুরী পাঠাগার। হবিগঞ্জ শহরের স্টাফ কোয়ার্টার এলাকায় নির্মিত এই পাঠাগারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে আলোকিত করেন কথা সাহিত্যিক আনিসুল হক ও কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেনসহ দেশবরেণ্য ব্যক্তিবর্গ।
গতকাল শনিবার বিকেল ৩টায় জাতীয় সংগীত এর মাধ্যমে শুরু হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, চলে রাত ৮টা পর্যন্ত। মানিক চৌধুরী পাঠাগারের সভাপতি অধ্যাপক ইকরামুল ওয়াদুদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানের শুরুতেই অতিথিদেরকে উত্তরীয় প্রদান করা হয়। এর পরই গাঁদা ফুলের তৈরি ফিতা কেটে উদ্বোধন করা হয় পাঠাগারের। মঞ্চে তখন সূচনা নৃত্য পরিবেশন করেন ক্ষুদে শিল্পীরা।
আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী ও সুনীল বিশ্বাস এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আলোচনায় অংশ নেন হবিগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আব্দুল মজিদ খান, হবিগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ডা. মুশফিক হুসেন চৌধুরী, সরকারী মহিলা কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জাহানারা খাতুন, বীর মুক্তিযোদ্ধা আশরাফ বাবুল চৌধুরী, সরকারী মহিলা কলেজের অবসরপ্রাপ্ত উপাধ্যক্ষ মুহম্মদ আব্দুজ জাহের, আবু মোতালেব খান লেবু, বাপা হবিগঞ্জ জেলা সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল, প্রভাষক মাসুক আহমেদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট সাহেল আহমেদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী গোলাম মর্তুজা প্রমুখ।
এছাড়াও হবিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে আনিসুল হক বলেন, আমরা চাই ভালবাসার বাংলাদেশ গড়ে উঠুক। যেখানে আমরা সবাই মিলে ভাল থাকব। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ মেনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে নিয়ে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হবে। মুক্তিযোদ্ধারা যে দেশ আমাদেরকে দিয়েছেন সেই বাংলাদেশ কখনও পরাজিত হয় না এবং হবে না।
তিনি বলেন, এই পেন্ডেমিক সময়ে আমরা গড় আয়ের দিক থেকে ভারতকে পিছনে ফেলেছি। আমরা করোনাকে প্রায় পরাজিত করে ফেলেছি। যেখানে বড় বড় দেশ এখনও হিমশিম খাচ্ছে। অনেক দেশের আগেই আমরা টিকা নিতে পেরেছি। আমরা সব ক্ষেত্রে জয়লাভ করবই। কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না।
কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, আমাদের যার যার অবস্থা থেকে কাজ না করলে সফলতা আসবে না। পাঠাগার মানব হৃদয়কে আলোকিত করার জায়গা সৃষ্টি করে। বই পড়লে জ্ঞানের তৃষ্ণা বাড়বে। মানবিক চেতনার যায়গাটা বড় করার জন্য পাঠাগার ভূমিকা রাখে। আমি ভাল কিছু দেখলে নিজেকে যুক্ত করি। এর জন্য এখানে এসেছি। মানিক চৌধুরী পাঠাগার কর্তৃপক্ষকে নতুন প্রজন্মের জন্য বই পড়া এবং রচনা লিখার প্রতিযোগিতা আয়োজনের আহবান জানান। তিনি ১০ হাজার টাকা অনুদানও ঘোষণা করেন।
নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বলেন, আমার প্রাইমারী শিক্ষক আমাদেরকে আদর্শ ও মূল্যবোধের শিক্ষা দিয়েছেন। কাউকে কটাক্ষ এবং তুচ্ছ তাচ্ছিল্য না করার শিক্ষা দিতেন। আমার বাড়ি করতোয়া নদীর পাশে। ছোট বেলায় সেখানে নি¤œ বর্ণের এক মাঝি ছিলেন। আমরা ছোটরা যখন তার কাছে বায়না ধরতাম নদী পার করার জন্য তখন তিনি বড়দেরকে নামিয়ে আমাদেরকে পাড় করতেন। তখন বড়রা তাকে বকাঝকা করত। কিন্তু ওই মাঝি কোন টাকা না পেয়েও আমাদেরকে পাড় করতেন এবং বলতেন ওরা আমাদের ভবিষ্যত। ওরাই একদিন দেশ গড়বে। ওই মাঝিও আমার শিক্ষক। আমাদের সবাইকে মিলে শিশুদের পরিচর্যা করতে হবে এবং মানবিকতা বোধ জাগ্রত করতে হবে।
অনুষ্ঠানে মহান ভাষা আন্দোলন ও মানিক চৌধুরী পাঠাগারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ভাষা সৈনিক অ্যাডভোকেট সৈয়দ আফরোজ বখত (মরণোত্তর), ভাষা সৈনিক অ্যাডভোকেট চৌধুরী আব্দুল হাই, বীর মুক্তিযোদ্ধা স্থপতি কাজী নুরুল করিম এবং চিত্রশিল্পী মাসুক হেলালকে মানিক চৌধুরী পাঠাগার ‘সম্মাননা পদক-২০২১’ প্রদান করা হয়।
অনুষ্ঠানের আকর্ষণ বৃদ্ধি করে দেশাত্ববোধক গান, প্রার্থনা, হামদ নাত, দলীয় নৃত্য, লাঠি নৃত্য ও বাউল সঙ্গীত।
অনুষ্ঠানে মানিক চৌধুরী পাঠাগার ও মুক্তিযোদ্ধা জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয় হবিগঞ্জ তথা সিলেট বিভাগের মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ স্মারক।
পাঠাগারের জমিদাতা ও প্রতিষ্ঠাতা সাবেক এমপি আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী জানান, গত বছরের ১০ জানুয়ারি থেকে পাঠকদের জন্য প্রাথমিকভাবে পাঠাগারের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। প্রতি শুক্রবার, শনিবার ও মঙ্গলবার বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত এ পাঠাগার খোলা থাকছে। শনিবার উদ্বোধন উপলক্ষে মানিক চৌধুরী পাঠাগারের সমৃদ্ধি কামনা করে বাণী দিয়েছেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক গওহর রেজভী, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দিপুমনি, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী, অর্থনীতিবিদ ও সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলী খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর ড. মুহাম্মদ সামাদ, কথা সাহিত্যিক আনিসুল হক, কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী, শিক্ষাবিদ ও কথা সাহিত্যিক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম, কৃষি সাংবাদিক মিডিয়া ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ, সাবেক অধ্যক্ষ মানিক চৌধুরী পাঠাগারের সভাপতি অধ্যাপক ইকরামুল ওয়াদুদ, পাঠাগারের দাতা ও প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডভোকেট আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী।