জালাল আহমেদ
আমি আদালতের খাস কামরায় বসেই রায় লেখা শেষ করতাম

আমি বাসা বদল করে এলাম লালখান বাজার ম্যাজিস্ট্রেট কলোনীতে, তিন পুরনো ভবনের মাঝেরটিতে, তিনতলায়। একদিন সন্ধ্যায় বাসায় কলিং বেল বাজলো, দরজা খুলে দেখি ছাতা হাতে প্রাক্তন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম, শফি ভাইয়ের আরেক হাতে একটি মিষ্টির প্যাকেটও রয়েছে। তিনি বসলেন, বললেন যে তিনি এসেছেন ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজে যোগ দিতে। তিনি ভলান্টিয়ার করায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তাঁকে ন্যস্ত করেছে জেডআরসি’র অফিসে। মনে পড়লো যে স্বয়ং জেডআরসি ১৯৭০ এর ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী ত্রাণ কাজে স্বেচ্ছায় অংশ নিয়েছিলেন এবং আমার জানামতে দ্বিতীয় নজির আমাদের ব্যাচমেট মোহাম্মদ শফিউল আলম। শফি ভাইয়ের এই মহত্ত্বের কথা আমি সব সময় শ্রদ্ধার সংগে স্মরণ করি। পরে তাঁকে কক্সবাজারে দেয়া হয়েছিল এবং তিনি আন্তরিকতার সাথে সে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
জেডআরসি চাইলেন সরকার প্রধানের জন্য এই ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম নিয়ে একটা তথ্যভিত্তিক প্রতিবেদন তৈরী করতে। একটা টাস্কফোর্স করা হল এ কাজের জন্য। তথ্য সংগ্রহ ও সমন্বয় ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তা সন্নিবেশ করা ও এর দালিলিক রূপ দেয়া আরেকটি। প্রথমটির সংগে আমি যুক্ত ছিলাম কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় দায়িত্বটি পালন করেন ১৯৭৯ ব্যাচের মেধাবী কর্মকর্তা, একসময়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব আমিনুল ইসলাম ভুঁইয়া। এর একটি টাইমলাইন ছিল, আমরা সবাই মিলে ঐ টাইমলাইন অনুসরণের চেষ্টা করেছি। প্রতিবেদন শেষও হল, ছাপানো প্রথম খসড়া যেদিন মোকাম্মেল হক অনুমোদন করলেন আমিনুল ইসলাম ভূঁইয়া ঐদিন বললেন যে তাঁর সন্তানসম্ভবা স্ত্রী ইতোমধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। দাপ্তরিক কাজের জন্য কি পরিমাণ নিবেদিত হলে এই মহত্ব দেখানো সম্ভব তা আমি এত বৎসর পরেও ভাবি। স্যারকে ঐদিন রাতেই ঢাকায় পাঠানো হল তাঁর স্ত্রীর শয্যাপাশে থাকার জন্য।
সেই প্রতিবেদন ‘অপারেশন সেবা’ নামে ছাপা হল, মোকাম্মেল হক প্রতিবেদনসহ উড়াল দিলেন ঢাকায়। প্রধানমন্ত্রী’র সামনে প্রতিবেদন উপস্থাপন করলেন এবং আর কখনো এই দায়িত্বে চট্টগ্রাম ফিরে এলেন না। দু’একদিনের মধ্যেই তাঁর পদায়ন হল স্বাস্থ্যসচিব হিসেবে। প্রতিবেদনটির একটি কপি আমার কাছে ছিল ২০১৭ পর্যন্ত কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঐ বছর আমার সরকারি বাসভবন আশিয়ানের ফ্ল্যাটে উইপোকার আক্রমণে তা ধ্বংস হয়। আরেক কপি কি আর কোথাও পাবো! প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৯৯১ সালের ঐ ঘূর্ণিঝড় “ম্যারিয়ান” এ ১ লাখ ৩৮ হাজার লোক প্রাণ হারায়।
জেডআরসি চলে যাবার পরে অফিসেও ভাংগনের সুর। তারও আগে জুন মাসের ১৩ তারিখে সি এঞ্জেল তাদের অপারেশন শেষ করে চলে গিয়েছে। আমিও আমার নিজ কাজে মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেসিতে ফেরত আসলাম। আদালতের নিয়মিত রুটিন কাজের মাঝে ডুবে গেলাম। ব্যস্ত আদালতে যারা কাজ করেছেন তাঁদের পক্ষেই কেবল এই চাপ অনুধাবন করা সম্ভব।
আমি আদালতে বসার একটা নিয়ম করে নিয়েছিলাম এবং সে নিয়ম মেনেই কোর্ট করার চেষ্টা করতাম। সকালে সাধারণত কোর্ট বসতো ১০ঃ৩০ টায়। সিএমএম সাহেব নিজেও নিয়মিত আদালতে বসতেন ফলে সব ম্যাজিস্ট্রেটই কোর্ট আওয়ার মেনে চলতেন। সকালে অন্যতম দায়িত্ব ছিল জেনারেল ফাইল, মানে নতুন অভিযোগ মামলা বা সিআর (কমপ্লেইন্ট রেজিস্ট্রার) মামলা গ্রহণ। আগে মহকুমা পর্যায়ে সাবডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট বা ফৌজদারী কার্যবিধি অনুযায়ী ক্ষমতাপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট, এরপর উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট এই শুনানী করতেন। তবে আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন মহকুমা’র ধাপ বিলুপ্ত এবং উপজেলা আদালত জেলায় নিয়ে আসা হয়েছে। যে কোন ম্যাজিস্ট্রেটের জন্য জেনারেল ফাইল করা তখন একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আদালত কক্ষে এমন এমন অবস্থার উদ্ভব হয় তা আগে অনুমান করা যায় না। খোলা এজলাসে বিচারক একা, শতচক্ষু তাঁকে পর্যবেক্ষণ করে, আর আইনজীবীরাও পেশাদার। তারা আদালতের দুর্বলতা অনুসন্ধান করেন এবং নিজেদের ক্লায়েন্টদের প্রয়োজনে তা ব্যবহার করেন। তাই ম্যাজিস্ট্রেট খোলা আদালতে কখনো নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করতে পারেনও না।
আমি যখন খাগড়াছড়ি জেলায় প্রথমদিন কোর্ট করি সেদিন আইনজীবী না থাকা সত্ত্বেও ঘামছিলাম। পার্বত্য চট্টগ্রামে তখনো কোন আইনজীবী থাকার বিধান হয়নি, পক্ষগণ নিজেরাই নিজেদের মামলা পরিচালনা করতেন। এ বিধানের সবচেয়ে কার্যকর প্রয়োগ দেখেছিলাম চট্টগ্রাম সিএমএম কোর্টে, যা পরে আসবে। চীফ মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট সাধারণতঃ সকালবেলা জেনারেল ফাইল বন্টন করেন ফলে এর আগে কারো পক্ষে জানা সম্ভব হয় না যে কোন আদালতে কে বসবেন। জেলা ম্যজিস্ট্রেটরা যখন জেলা পর্যায়ে বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালন করতেন তখন অনেক জেলায় জেনারেল ফাইলের দায়িত্ব স্থায়ীভাবে তাঁকে দেয়া থাকতো। আবার অনেক জেলায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা দৈনন্দিন তা বন্টন করতেন। আমি দৈনন্দিন বন্টনের পক্ষে ছিলাম। হাইকোর্ট রুলস অনুযায়ী কোর্ট আওয়ার হল সকাল সাড়ে দশটা থেকে বিকাল সাড়ে চারটা। আমি সবসময় এটা অনুসরণের চেষ্টা করেছি। বিধি হল সাড়ে চারটা’র পরও কোর্ট চালানোর প্রয়োজন হলে তা’ উভয়পক্ষের সম্মতি নিয়ে চালানো যায়।
আমাকে জেনারেল ফাইল দেয়া হলে আমি সাধারণতঃ ১০ঃ৩০ টায় জেনারেল ফাইলে উঠতাম এবং তারপর নিজের বিচার ফাইল করতাম। জেনারেল ফাইলের দিন সাধারণতঃ বিকেলে পুলিশ ফাইল দেয়া হত না। এতে দুপুরের আগে বিচার ফাইল শেষ না হয়ে থাকলে দুপুর আড়াইটার সময় বিচার ফাইলের বাকি অংশ, বিশেষ করে সাক্ষ্য নেয়া সম্ভব হত। অন্যথায় আমি বিকালটা কাজে লাগাতাম মামলার রায় লেখার জন্য। প্রতিমাসে গড়ে ২০টি মামলার পূর্ণ রায় আমি দিতাম, কোন কোন মাসে তারও বেশি। ফলে প্রায় প্রতিদিনই রায় লিখতে হত। আমার একমাসে সর্বাধিক নিষ্পত্তি বোধহয় ছিল ১৪৯টি আর পূর্ণ রায়ের মাধ্যমে সর্বাধিক নিষ্পত্তি ছিল সম্ভবতঃ ৩৯টি। প্রথমদিকে অন্যদের কাছ থেকে শোনা অভিজ্ঞতায় রাতে বাসায় বসে রায় লিখতাম কিন্তু কিছুদিন যাবার পরই বুঝতে পারলাম যে এটা সঠিক পদ্ধতি না, অফিসে রায় লেখাই বেহতর।
আমার ৫১ মাসের মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেসিতে আমি হয়তো প্রথম ৬ মাস বাসায় বসে রায় লিখেছি, তারপর পুরো সময় আদালতের খাস কামরায় বসেই রায় শেষ করতাম। এটা বিশেষ করে পরিবারকে পারিবারিক সময় প্রদানের জন্য। এই পরামর্শই মোহাম্মদ ফয়েজউল্যা দিয়েছিলেন সিভিল অফিসার ট্রেইনিং একাডেমি (কোটা) তে। ফলে বাসায় ফিরে স্ত্রী ও সন্তানকে সময় দেয়া সম্ভব হত। যত ব্যস্ত পদেই দায়িত্ব পালন করি না কেন আমি পুরো চাকুরী জীবন তা’ অনুসরণ করেছি।
যা বলছিলাম, যদি কেউ আন্তরিকভাবে কোর্ট আওয়ার অনুসরণ করে তাহলে সময়মত আদালতের কাজ শেষ করা সহজ হয়। ঢাকা সিএমএম কোর্ট সম্পর্কে এমন মিথ ছিল যে রাত ৯টা পর্যন্ত কোর্ট করতে হয়। একটু চেষ্টা করে সে মিথও আমি ভাংতে সমর্থ হয়েছিলাম। শুরুতে আইনজীবীরা ভেবেছিলেন যে এটা বাত কি বাত, কিন্তু মাত্র একদিনের চেষ্টায় এটা সম্ভব হয়েছিল। আমার তিনবছর সিএমএম থাকাকালীন বিকেল ৫টার পর কোন আদালত চালু থাকেনি। “ইচ্ছাতে কি না হয়, কি না হয় চেষ্টায়!”