জালাল আহমেদ
এক বৃষ্টির রাতে একটা আওয়াজে ঘুম থেকে উঠে বেডরুমের দরজা খুলতে গিয়ে দেখি দরজা বাহির থেকে বন্ধ ॥ তখন আমি ভয় পেয়ে গেলাম

অপারেশন সি এঞ্জেলস শুরুর দিকে সবচেয়ে কাজে লেগেছিল তাঁদের বিশাল বিশাল পানি বিশুদ্ধকরণ প্লান্টগুলো। প্রায় ৭ হাজার মার্কিন সৈন্য এই অপারেশনে নিয়োজিত ছিল। শুরু থেকেই জেডআরসি মোকাম্মেল হকের সংগে স্ট্যাকপোল এর রসায়ন খুব মিলে যায়। এর প্রভাব পড়ে আমাদের সামরিক বাহিনীর উপর জেডআরসি’র প্রভাবে। জিওসি মাহমুদুল হাসান বেশির ভাগ সময় জেডআরসিকে নিজে গাড়ি চালিয়ে রেলওয়ে রেস্ট হাউসে নামিয়ে দিয়ে যেত। সব উপজেলায় সমন্বয়কারী নিয়োগ হয়ে যাবার পর ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজে গতি আসে, তথ্য আসতে থাকে। প্রথম দিকে মূলদায়িত্ব ছিল মৃতদেহ সৎকার, খাবার পানি এবং খাবারের ব্যবস্থা করা। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলাগুলো ছিল কুতুবদিয়া, বাঁশখালী, আনোয়ারা, সন্দীপ ও চকোরিয়া। ১৯৮৮-৯০ সালে বাঁশখালী উপজেলায় আমি ইউএনও ছিলাম ফলে সেখানকার অনেক খবরই পেতাম। অনেক চেনা লোকের মৃত্যু সংবাদ ও প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি মৌলভী সাবের সহ অনেকের বেঁচে যাবার অলৌকিক ঘটনা শুনেছি। তখনো আজিমউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী সেখানে উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট। দিনরাত এক করে শত শত মৃতদেহ সৎকারে তাঁর ভূমিকা বাঁশখালীর লোক কখনো ভুলবে না।
মে মাসে একদিন জেনারেল স্ট্যাকপোল জেডআরসি সাহেবসহ আমাদের কয়েকজনকে তাঁদের জাহাজে দাওয়াত দিল। মেরিনরা মূলত জাহাজেই থাকতো, একটা ছোট সংখ্যা সম্ভবত এয়ারপোর্টে থাকতো। তাঁরা উভচর যান নিয়ে বিভিন্ন দ্বীপ ও উপকূলীয় এলাকায় যেত। নির্দিষ্ট দিনে আমরা এয়ারপোর্টে গেলাম, একাধিক হেলিকপ্টারে চড়তে হবে। আমার জীবনে প্রথম হেলিকপ্টারে চড়া। হেলকপ্টারে উঠে সিট বেল্ট বাঁধতে হবে, ঠিক মত বাঁধতেও পারি নাই। হেলিকপ্টারের দুই দিকের স্লাইডিং ডোর পুরাই খোলা, তারমধ্যে হেলিকপ্টার আকাশে, ইউএস মেরিন বলে কথা! আমারতো কলিজায় নাই পানি। কোনরকমে উপরে কিছু একটা ধরে আছি, সিটবেল্ট লাগাতে পেরেছিলাম কিনা এখনো আমার সন্দেহ আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হেলিকপ্টার জাহাজের উপরে, ইউএসএস সেইন্ট লুইস। এই নামে অনেকগুলো জাহাজ আছে। আমি যে জাহাজে গিয়েছিলাম তা এলকেএ ১১৬ এম্ফিবিয়ান কার্গো শীপ, ১৯ হাজার টন, ১৯৬৮ তে কমিশন্ড, ১৯৯২ তে ডিকমিশন্ড। জাহাজের উপর এসে হেলিকপ্টার জাহাজ ঘিরে একেবারে ৪৫” কাত হয়ে চক্কর কাটতে লাগলো, আর দরজার পাশে বসা আমি খোলা দরজার উপরে ঝুলে আছি, সিট বেল্ট ফেইল করা মানে পাকা ফলের মত টুপ করে পানিতে বা জাহাজের ডেকে! যাই হোক ভালোয় ভালোয় হেলিকপ্টার জাহাজের হেলিপ্যাডে নামলো। আমাদের নিয়ে যাওয়া হল জাহাজের ভেতরে, সামান্য আনুষ্ঠানিকতার পর সরাসরি ডাইনিং হলে। একটু ভালো খবার দাবারের আশায় ছিলাম। দিলো হটডগ আর জ্যাকেট পটেটো। হতাশ হয়ে তাই খেলাম উইথ আমেরিকান কোক। ফেরার পথে আর সিট বেল্ট নিয়ে কোন ঝামেলা হল না। জীবনের দ্বিতীয় হেলিকপ্টার যাত্রা নির্বিঘœই হল।
মে মাসের শুরুতেই যুক্তরাজ্যের উন্নয়ন সংক্রান্ত মন্ত্রী লিন্ডা টকার এলেন ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম দেখতে। অপারেশন সি এঞ্জেলে বৃটিশরাও যোগ দিয়েছিল। তিনি গেলেন সন্দীপে। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) গেলেন আগের দিন। ফিরে এসে তিনি বললেন যে যখন জেডআরসি মোকাম্মেল হক ও জেনারেল স্ট্যাকপোল গিয়ে পৌঁছালেন তখন জিওসি কুমিল্লা ও তাঁর লোকজন তাঁদের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে বোর্ড – টোর্ড সাজাচ্ছেন। জেডআরসি বললেন যে ‘ইট উইল নট বি এ মিলিটারী শো, সিভিল এডমিনিস্ট্রেশন উইল প্রেজেন্ট এন্ড মিলিটারী উড প্লে এ সার্পোটিভ রোল’। জিওসি মেনে নিলেন এবং জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেই প্রাথমিক উপস্থাপনা করা হল।
দিন যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অফিসও কিছুটা নরমাল রুটিনে ফিরে আসছিল। সকাল ৭টা রাত ২টা’র অফিস আস্তে আস্তে সকাল ৯টা রাত ৯টায় এসে ঠেকেছিল। প্রতিদিনের প্রতিবেদন তখনো চলছিল। যে জিনিসটা আমাকে মুগ্ধ করতো তা হল মোকাম্মেল হকের প্রকাশ ক্ষমতা। আমি যে রিপোর্টই রেডি করতাম তাই তিনি ‘ইন এ ফিউ পেনস্ট্রোক’ বদলে দিতেন। অর্থাৎ কলমের কয়েক খোঁচাতেই আমার রিপোর্ট হয়ে যেত ‘মোকাম্মেলীয় রিপোর্ট’। এটা যে কারো পক্ষে সম্ভব নয় আর মোকাম্মেল হক ছাড়া আর কারো আমি এ ক্ষমতা দেখিওনি। ২৯ এপ্রিলের সপ্তাহখানেক পর এক রাতে হৈ চৈ এ ঘুম ভেঙ্গে গেল। বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দায় গেলাম দেখি যে সব বাসার মানুষ রাস্তায় আর তারা চীৎকার করছে ভূমিকম্প ভূমিকম্প! ছোট্ট ভিক্টরকে কোলে নিয়ে মুহূর্তে আমরা সদর রাস্তা থেকে পাহাড়ে উঠে যাওয়ার রাস্তায়। সব বাসার লোকজনই ওখানে। কিছুক্ষণ পার হওয়ার পর উপলব্ধিতে আসলো যে ভূমিকম্প তো হয় নাই, হবে এটা কে জানালো? কোথা থেকে শুরু কিছুই জানা গেল না, আমরা সব বোকা রাস্তায়! সবাই শাপ শাপান্ত করে ঘরে ফিরলো।
ইতোমধ্যে আমি লালখান বাজার সরকারি কলোনীতে পুরনো ভবনে একটা ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেয়েছি। যে বাসায় ছিলাম তা লোকেশন ওয়াইজ, ভাড়া বিবেচনায় এবং প্রতিবেশীদের কারণে খুবই ভালো ছিল। কিন্তু আমি কেন জানি কখনোই ভাড়া বাসায় স্বাচ্ছন্দ বোধ করিনি। মাসের শুরুতেই নুরুল ইসলাম সওদাগরের পক্ষে ছাতি হাতে এক লোক ভাড়া আদায়ে হাজির হতো, রশিদ ধরিয়ে দিত আর আমাকেও রেজিস্ট্রারে স্বাক্ষর করতে হতো। এটা ছিল আমার জন্য অসহ্য। নইলে আরজু ভাই ও তাঁর মায়ের মত মুরুব্বী রেখে যাওয়া ছিল কষ্টকর। বাসা বদলের আগেই এক বৃষ্টির রাতে ঘুম ভেংগে গেল কিচেনে কোন একটা আওয়াজে। ঘুম থেকে উঠে কে কে বলে বেডরুমের দরজা খুলতে গেছি, দেখি দরজা বাহির থেকে বন্ধ। তখন বাসায় আমি একা, আমার স্ত্রী পুত্রসহ চাঁদপুরে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম এবং ভয় পেলে যা হয় ‘মাথামুতা’ কাজ করে না। আমি ধরজা ভেতর থেকে টেনে খোলার চেষ্টা করতে লাগলাম। এদিকে দোতলার ফ্ল্যাটের এক মার্চেন্ট নেভী’র ভদ্রলোক আমার চীৎকার শুনে পাশের বিল্ডিং এর আরজু ভাইকে জাগালেন। তাঁরা এসে বাসায় ঢুকে আমার বেডরুমের বেঁকে যাওয়া হ্যাচবোল্ট বহুকষ্টে শীল দিয়ে আঘাত করে সোজা করে খুলে আমাকে বের করলেন। বের হয়ে দেখি ড্রয়িং রুম থেকে টিভিসহ অনেক জিনিসই নেই, চোর নিয়ে গিয়েছে। বারান্দায় এসে দেখলাম যে এসিড বা এমন কিছু দিয়ে গ্রীল গলিয়ে তারপর বাসায় ঢুকেছে, বারান্দার তালা খুলেছে এবং তারপর আমাকে আটকে জিনিসপত্র নিয়ে গিয়েছে। কথা বলতে বলতে এরমধ্যে পূবাকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে। এক ছেলে দৌঁড়ে এসে বললো যে আমার সব জিনিসপত্র সামনের এক বাসায়। সবাই দ্রুত গেলাম, গিয়ে দেখি ওই বাসার গ্যারেজে আমার সব জিনিসপত্র। গ্যারেজ থেকে গাড়িটা বের করে ঢালুতে রেখেছে, হয়তো ইচ্ছে ছিল গাড়ি গড়িয়ে নীচে সদর রাস্তায় নামিয়ে পর স্টার্ট দিয়ে চলে যাবে। কিন্তু তাদের জন্য বিধি বাম, আমার সব জিনিস যেমন গ্যারেজে, গ্যারেজের গাড়ি বাইরে আর টিপ টিপ বৃষ্টির এই রাতে কেবল আমার এক খানা ছাতা মাথায় চোরের প্রস্থান!