মঈন উদ্দিন আহমেদ ॥ দলিত শিশুদের বিদ্যালয়মুখি করণের প্রধান সমস্যা পারিবারিক অস্বচ্ছলতা। দারিদ্রতার কারণে অনেকেই শিশুদের স্কুল মুখি না করে কর্মমুখি করতে বেশি পছন্দ করেন। আর তাই দলিত শিশুরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়। অনেকে আবার কয়েক ক্লাস লেখাপড়া করে ঝড়ে পড়ে।
এ ব্যাপারে চুনারুঘাটের জঙ্গলবাড়ি শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষক রূপক চন্দ্র দেব বলেন, পারিবারিক স্বচ্ছলতা না থাকলে শুধু দলিত নয় সকল পরিবারের শিশুদেরই স্কুলমুখি করা খুব কঠিন। কারণ আমাদের দেশে শিশু শ্রমের আধিক্য থাকায় দারিদ্রতার কারণে অনেকেই শিশুদের স্কুল মুখি করা থেকে কর্মমুখি করতে বেশি পছন্দ করেন। দলিত শিশুদের স্কুলমুখি করতে গেলে প্রথমেই তাদের পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। স্কুলে বিনামূল্যে বই দেয়ার পরও যেহেতু পারিবারিকভাবে দলিতরা শিক্ষিত হয় না, তাই পরিবারে পড়াশোনার আবহ তৈরী হয় না। তাই প্রতিটি পরিবারে পড়াশোনার আবহ তৈরী করতে হবে। চা বাগানের শ্রমিক শ্রেণি যারা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখে আসছেন সেই পরিবারের শিশুরা লেখাপড়ায় ছিল পিছিয়ে। যদিও বর্তমানে সে ধারায় ব্যতয় ঘটেছে। চা বাগানে শিক্ষার হার বাড়ছে, কিন্তু তা আশানুরূপ নয়।
তিনি বলেন, চা বাগানে যারা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন তাদের দৈনিক যে মজুরী দেয়া হয় তা একজন শ্রমিকের পরিবার পরিজন নিয়ে চলা অসম্ভব। যদি সেই পরিবারে বিদ্যালয়গামী শিশু থাকে তাহলে তারা খুব কষ্টে দিনাতিপাত করেন। পারিবারিক খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে স্কুলগামী শিশুর চাহিদা মেটানো সম্ভব হয় না। ঠিকমতো সন্তানের ভরণ পোষণ করতে না পেরে অনেকেই তার সন্তানকে উপার্জনের দিকে ধাবিত করেন। আর এতে বন্ধ হয়ে যায় ওই শিশুটির লেখাপড়া। একসময় সে ঝড়ে পড়ে। আর যদি কোন পরিবারে ২/৩ জন শিক্ষার্থী থাকে তাহলে তাদের শিক্ষা দূরে থাক ভরণ পোষণই করতে পারেন না তার অভিভাবক। এছাড়াও বাগান এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দূরবর্তী হওয়ায় শিশু শিক্ষার্থীরা ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বিদ্যালয়ে যেতে পারে না। ফলে সেখানে শিক্ষার হার কম। যদিও আজকাল সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও বাগান এলাকায় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। ফলে সেখানে দিন দিন শিক্ষার হার বাড়ছে। তিনি দলিত শিশুদের বিদ্যালয়মুখি করতে আর্থিক অস্বচ্ছলতা দূরীকরণসহ দলিত পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করার উপর গুরুত্বারোপ করেন। এ ছাড়াও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সর্বস্তরে দ্রুত বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলিত ছাত্রদের ভর্তিতে কোটা সংরক্ষণ এবং শিক্ষিত দলিতদের চাকরিতে প্রবেশে কোটা চালু রাখার দাবি জানান।
প্রভাষক গৌর শংকর দাস বলেন, পড়াশোনার ক্ষেত্রে কেবলমাত্র বই একমাত্র উপকরণ নয়। দলিত শিশুটি যে জায়গাতে কোন বিশেষ বিষয় বুঝতে অক্ষম হয়, সেক্ষেত্রে তাকে সাহায্য করার মতো পারিপাশির্^ক অবস্থা না থাকার কারণে তার পক্ষে লেখাপড়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়া বা লেখাপড়ায় উৎসাহ বোধ করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়া আর্থিক অস্বচ্ছলতা একটি বিরাট অন্তরায়। আর্থিক অস্বচ্ছলতা প্রতিপক্ষ এজন্য যে, আর্থিক অনটনের জন্য একজন শিক্ষার্থী প্রয়োজনীয় গাইড বই কেনার সামর্থ্য রাখে না। প্রাইভেট টিউটর দিয়ে পড়াশোনা করার সামর্থ্য তার থাকে না। খাতা কলমসহ প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ কেনার সামর্থ্য তার থাকে না। সেই সব সমস্যা সমাধান করতে না পারার ফলে দলিত শিশুরা লেখাপড়ায় উৎসাহ পায় না। পড়াশোনা এমনই এক বিষয় তাতে উৎসাহ না পেলে বা উৎসাহ বোধ না করলে এবং আনন্দ না পেলে চাপিয়ে দিয়ে তা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। সেই ক্ষেত্রে স্থানীয় অথবা রাষ্ট্রীয়ভাবে এদের জন্য আলাদাভাবে বরাদ্দ প্রয়োজন। যাতে তারা পড়াশোনার জন্য আনুসাঙ্গিক জিনিসপত্র কিনতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, অনেক স্কুলে ড্রেস কোড মানা হয়। সে ক্ষেত্রে একটি দলিত শিশুর পক্ষে স্কুল ড্রেস তৈরী করা কঠিন হয়ে পড়ে। সার্বিক অবস্থা এরকম যে, অনেক শিশুর পড়াশোনা করার ইচ্ছে থাকলেও পারিপাশির্^ক অবস্থার কারণে তাদের পক্ষে স্কুলমুখি হওয়া সম্ভব হয় না। আমরা যদি মনে করি যে, স্কুলে গেলে আসলেই শিক্ষা গ্রহণ হয়ে যাবে তাহলে যে শিক্ষা ব্যবস্থা বর্তমানে আছে তা সঠিক রয়েছে। আর যদি আমরা প্রকৃতপক্ষেই একটি ক্ষুদে শিশুকে শিক্ষার আবহ তৈরী করে দিতে পারি সেই ক্ষেত্রে এই শিক্ষা ব্যবস্থা যতেষ্ট অপ্রতুল। যে কারণে সার্বিকভাবে দেখা যায়, আমাদের দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ড্রপ আউটের সংখ্যা অনেক বেশি। তাই এ ব্যাপারে গবেষণা করে প্রকৃত শিক্ষার্থী তৈরীর জন্য কাজ করতে হবে। যাতে শিক্ষার্থীরা অভাব অনটনের যাতনা থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রেখে কেবলমাত্র পড়াশোনায় মনোযোগী হতে পারে। তা না হলে স্কুল বিল্ডিং তৈরী করে কিছু শিক্ষকের হয়তো চাকুরি হবে, কিন্তু যারা প্রকৃত স্টেক হোল্ডার তাদের কাজের কাজ কিছুই হবে না।