শায়েস্তাগঞ্জে নছরতপুর গ্রামে স্কুলছাত্র তানভীর হত্যার রহস্য উদঘাটনের পর হবিগঞ্জ সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ রবিউল ইসলাম ঘটনার বর্ণনা দেন তার ফেসবুক পেজে। নি¤েœ দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ পত্রিকার পাঠকদের জন্য তা হুবহু তুলে ধরা হলো-
গত ২৪/০১/২০২১ খ্রিঃ তারিখে আনুমানিক রাত ১১.০০ টার দিকে ফারুক মিয়া, সাং-নসরতপুর, থানা-শায়েস্তাগঞ্জ, জেলা-হবিগঞ্জ থানায় এসে জানায় যে, তার একমাত্র সন্তান তানভীর নিখোঁজ। তার মুক্তিপণে ৮০ লাখ টাকা দাবী করা হয়েছে। তৎক্ষণাত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ রবিউল ইসলাম পিপিএম-সেবা এর নেতৃত্বে অফিসার ইনচার্জ, শায়েস্তাগঞ্জ এবং থানার একটি চৌকস দল তথ্য প্রযুক্তির সাহায্যে মুক্তিপণ দাবীকারীদের অবস্থান সনাক্ত করার চেষ্টা করেন এবং বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পরিচালনা করেন। উক্ত সময় প্রতিবেশী উজ্জলের গতিবিধি সন্দেহজনক হলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়। তার দেয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে জাহিদ এবং শান্তকে আটক করা হয়। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ রবিউল ইসলাম পিপিএম-সেবা এর নেতৃত্বে ব্যাপকভাবে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে উজ্জল, জাহিদ এবং শান্ত বর্ণনা করে সেই লোমহর্ষক হৃদয়বিদারক ঘটনার।
ঘটনার শুরু দীর্ঘ ০৬ বছর আগে। ভিকটিম তানভীরের প্রতিবেশী উজ্জল তাদের বাড়ির পাশে সবজি চাষ করত। সেই জমিতে চাষ করা কলা উজ্জল বাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে যায়। তৎক্ষণাত ভিকটিম তানভীর এর বাবা ফারুক মিয়া উজ্জলকে বলে “তুই এই কলা চুরি করে নিয়ে এসেছিস”। এই কলা বিক্রির ঘটনা নিয়ে বাজারে সালিশ হয়। উক্ত সালিশে ভিকটিমের বাবা ফারুক মিয়া অপমান করে উজ্জল এর পিতা সৈয়দ আলীকে। যা উজ্জলের মনে দাগ কাটে। সে কখনোই এই অপমানের ঘটনা মেনে নিতে পারেনি। তার মনের কোণে জমতে থাকে ক্রোধ এবং প্রতিশোধের নেশা যা একসময় বিশাল আকার ধারণ করে। এরই মাঝে সৈয়দ আলী তার পুত্র উজ্জলকে সকল ঝামেলা এড়াতে বিদেশে পাঠিয়ে দেন। যত দিন যেতে থাকে উজ্জলের মনে থাকা ক্রোধ ততই বাড়তে থাকে। তার মনে শুধু একটাই চিন্তা ঘুরপাক খায়, কিভাবে সে তার পিতার অপমানের প্রতিশোধ নিবে। এরই মাঝে দীর্ঘ ০৬ বছর পর দেশে ফিরে আসে উজ্জল। আবার মাথাচারা দিয়ে জেগে উঠে তার মনের কোনে জমে থাকা ক্রোধ এবং প্রতিশোধের নেশা। সে বিভিন্নভাবে ছক কষতে থাকে কিভাবে তার পিতার অপমানের বদলা নেয়া যায়। এরই মাঝে সে নসরতপুর রেলগেইটে একটি মোবাইল টেলিকমের দোকান দেয়। সে পরিকল্পনা করে যে, ফারুক মিয়ার একমাত্র ছেলে তানভীরকে অপহরণ করবে। সাজাতে থাকে তার নীল নকশা। উজ্জল এবং জাহিদ তানভীরকে অপহরণের চেষ্টা করে। এ যাত্রায় বেঁচে যায় ভিকটিম তানভীর। এরই মাঝে উজ্জল আরো বিভিন্ন উপায়ে প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সে কোনো ভাবেই তার পরিকল্পনা সফল করতে পারেনা। পরবর্তীতে জাহিদের মাধ্যমে নীল নকশার অংশ হয়ে উঠে শান্ত। গত ২৪/০১/২০২১ খ্রিঃ তারিখে উজ্জল, জাহিদ এবং শান্ত তানভীরকে হত্যার পুনরায় হত্যার ছক কষে। শান্ত উজ্জলকে জানায় তানভীরকে ঘরের বাহিরে আনার দায়িত্ব তার। তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক গত ২৪/০১/২০২১ খ্রিঃ সন্ধ্যার সময় শান্ত কৌশলে তানভীরকে পুকুর পাড়ে নিয়ে ডেকে আনে। তারপর জাহিদ তানভীরকে বাহিরে ডেকে আনার বিষয়টি উজ্জলকে নিশ্চিত করে। উজ্জল তার মনের কোণে জমে থাকা প্রতিশোধের নেশা মাথায় নিয়ে তার পরিকল্পনা সফল করার জন্য পুুকুর পাড়ের দিকে যায়। সেখানে উজ্জল তার পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক শান্ত এবং তানভীরের আলাপচারিতায় যোগ দেয়। আলাপচারিতার এক পর্যায়ে উজ্জল কৌশলে তানভীরের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি তার কাছে নিয়ে নেয়। তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক উজ্জল তানভীরের গলায় সুতা দিয়ে ফাঁস দেয়। শান্ত এবং জাহিদ উভয়েই তানভীরের মুখ চেপে ধরে রাখে যেন সে চিৎকার করতে না পারে। শুরু হয় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের। কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে তানভীর। চরিতার্থ হয় তাদের তিন জনের আকাঁ নীল নকশা। তাদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মৃত দেহটি পাশের মজা পুকুরে তানভীরের হাত পা বাধা অবস্থায় লুকিয়ে রাখে। তৎক্ষণাত উজ্জল লক্ষ্য করে মৃত দেহটি বার বার পানিতে ভেসে উঠছে। তখন উজ্জল মৃতদেহের পেটে ছুরিকাঘাত করে যাতে মৃত দেহটি ভেসে না উঠে। পরবর্তীতে মৃতদেহটি তারা তিন জন পুকুরে কাদাঁর নিচে মাটি চাপা দিয়ে রাখে। উক্ত স্থানে অনেক কচুরিপানা দিয়ে রাখে যাতে লাশের সন্ধান কেউ না পায়। লাশ গুম করা শেষে উজ্জল এবং জাহিদ তাদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অপহরণের নাটক সাজায়। জাহিদ তানভীরের ব্যবহৃত সিম থেকে তানভীরের বাবার নাম্বার সংগ্রহ করে এবং উজ্জলের পরামর্শ অনুযায়ী মুক্তিপণের জন্য ৮০ লাখ টাকা দাবী করে। যা ছিল তাদেরই পরিকল্পনার অংশ বিশেষ। যাতে করে এই হৃদয়বিদারক ঘটনার কথা কেউ জানতে না পারে। তারা নিজেদের মত করে যার যার বাড়িতে চলে যায় এবং স্বাভাবিক জীবন যাপন চালিয়ে যায়। যাতে করে সন্দেহের তীর তাদের দিকে না যায়। অপহরণের নাটকটি উজ্জল, শান্ত এবং জাহিদ সাজায় যাতে ঘটনাটি অন্য দিকে মোড় নেয়।
গত ২৬/০১/২০২১ খ্রিঃ তারিখে আনুমানিক দুপুর ১ ঘটিকার সময় আসামী উজ্জল, জাহিদ এবং শান্তর দেয়া তথ্য মতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ রবিউল ইসলাম পিপিএম-সেবা এর নেতৃত্বে অফিসার ইনচার্জ, শায়েস্তাগঞ্জ এবং থানার একটি চৌকস দল উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করেন এবং ভিকটিম তানভীরের লাশ উদ্ধার করতে সক্ষম হন। তখন আশেপাশে তৈরী এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের। স্বজনদের কান্না আর আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠে নসরতপুরের আকাশ।
আমাদের সমাজে অধিকাংশ অপরাধ হয়ে থাকে ক্রোধ এবং প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে। ক্রোধ কখনোই কারো জন্য সুফল বয়ে আনে না। আর প্রতিহিংসা মানুষকে অপরাধ প্রবণ করে তোলে। যার ফলে মানুষ তার স্বাভাবিক হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে এবং সৃষ্টি হয় নানাবিধ সামাজিক অপরাধ, যা আমাদের কারোই কাম্য নয়।
আমাদের সমাজে বর্তমানে মূর্তমান এক আতঙ্কের নাম কিশোর গ্যাং। যার ফলে আমাদের সমাজে প্রতিনিয়তই ঘটছে অনাকাক্ষিত হৃদয়বিদারক ঘটনা। এর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে আমাদের বর্তমান সমাজে যা খুবই ভীতিকর। এর প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে আমাদের সকলকে। বিশেষ করে আরো বেশি সচেতন হতে হবে আমাদের সকল অভিভাবকদের। খেয়াল রাখতে হবে সন্তানদের গতিবিধি। প্রত্যেক অভিভাবককে খোঁজ রাখতে হবে তার সন্তানটি কার সাথে মিশছে এবং সহপাঠি কারা। খোঁজ খবর রাখতে হবে আপনার সন্তানটি সঠিক পথে হাটছে কিনা। নিশ্চিত করতে হবে আপনার সন্তানটি সন্ধ্যার পূর্বে বাসায় ফিরছে কি-না। যদি সন্ধ্যার আগে বাসায় না ফিরে, তার সঠিক কারণ নির্ণয় করতে হবে। আমাদের সকলের সচেতনতাই তৈরী করবে এক নতুন আগামীর। যা হবে উন্নত বাংলাদেশের পাথেয়। দিগন্তের সীমা রেখায় সকল অন্যার ও অপরাধ ভেদ করে উদয় হোক নতুন সূর্যের। এই আশাই আমাদের সকলের কাম্য।
মো: রবিউল ইসলাম পিপিএম-সেবা
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার
হবিগঞ্জ সার্কেল, হবিগঞ্জ