স্কুলছাত্র তানভীর হত্যার ঘটনায় ৫ জনের বিরুদ্ধে পিতার মামলা
নিজস্ব প্রতিনিধি ॥ শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম নছরতপুর গ্রামে দশম শ্রেণীর ছাত্র তানভীর হত্যার ঘটনায় পাঁচ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামী করে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। গতকাল বুধবার (২৭ জানুয়ারি) বিকেলে নিহত তানভীরের পিতা ফারুক মিয়া বাদী হয়ে শায়েস্তাগঞ্জ থানায় মামলাটি দায়ের করেন। মামলা নং-১১, তারিখ ২৭/০১/২০২১ ইং। ইতোমধ্যে মামলার তিন আসামীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা হলো- পশ্চিম নছরতপুর গ্রামের সৈয়দ আলীর পুত্র উজ্জল মিয়া (২৫), নুরপুর গ্রামের মলাই মিয়ার পুত্র শান্ত (২৬), বাছিরগঞ্জ বাজারের জলিল কবিরাজের পুত্র জাহিদ মিয়া (২৮) সহ আরো দুই জন। মামলার তদন্তের স্বার্থে অন্য আসামীদের পরিচয় জানায়নি পুলিশ।
এর আগে গত মঙ্গলবার (২৬ জানুয়ারি) দুপুর ১টায় উপজেলার নুরপুর ইউনিয়নের পশ্চিম নছরতপুর গ্রামে সৈয়দ আলীর পুত্র আসামী উজ্জলের বাড়ির পরিত্যক্ত একটি পুকুর থেকে তানভীরের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত তানভীর একই গ্রামের ফারুক মিয়ার পুত্র। সে স্থানীয় আফরাজ আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র।
পুলিশ সূত্র জানায়, মামলার গ্রেফতারকৃত তিন আসামীর মাঝে শান্ত ও জাহিদ মিয়াকে বুধবার বিকেলে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। মূল আসামী উজ্জল মিয়াকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়নি। তাকে নিয়ে অন্য আসামীদেরকে গ্রেফতার এবং আলামত উদ্ধারে অভিযান পরিচালনা করছে পুলিশ। যে রশি দিয়ে গলায় প্যাচ দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল সেই রশিটি জব্দ করেছে পুলিশ।
শায়েস্তাগঞ্জ থানার ওসি অজয় চন্দ্র দেব মামলা দায়েরের তথ্য নিশ্চিত করে জানান, দুইজনকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডের আবেদন করা হবে। হত্যার সাথে জড়িত অন্য আসামীদেরকে গ্রেফতার করতে এবং আলমত জব্দ করতে প্রধান আসামী উজ্জল মিয়াকে নিয়ে অভিযান চলমান রয়েছে।
এদিকে আলোচিত এই হত্যাকান্ড নিয়ে উপজেলার সর্বত্র আলোচনা চলছে। নিহত স্কুলছাত্র তানভীর স্থানীয় হাজী আফরাজ আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণীর ছাত্র ছিল। তানভীর ছিল বাবা মায়ের একমাত্র পুত্র সন্তান। বাবা ফারুক মিয়া ধান-চাউল ব্যবসায়ী। মা উজ্জলা বেগম একজন গৃহিনী। একমাত্র ছেলে সন্তানকে হারিয়ে মা উজ্জলা বেগম মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন। তিনদিন ধরে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে এখন বিছানায় শয্যাশায়ী। আর বাবা ফারুক মিয়া শোকে কাতর হয়ে গেছেন। কেবলই ফ্যাল ফ্যাল করে নির্বাক তাকিয়ে থাকেন। তাদের সকল স্বপ্ন ছিল একমাত্র ছেলে তানভীরকে ঘিরে। এখন কি নিয়ে বেঁচে থাকবেন বাবা-মা। তানভীরের শোকে স্তব্ধ এলাকাবাসী। পুরো এলাকার বাতাস যেন শোকে ভারী হয়ে গেছে। কান্না থামাতে পারছেন না তানভীরের সহপাঠীরাও। ফারুক মিয়া বুধবার এই ঘটনায় মামলা দায়েরের জন্য আদালতে তার আইনজীবীর কাছে অন্যান্য স্বজনদের নিয়ে আসলেও তার চোখ ছিল অশ্রুসজল। কোন কথা না বলে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছিলেন।
প্রসঙ্গত, গত ২৪ জানুয়ারি রাত সাড়ে ৭টায় তানভীর নিখোঁজ হয়েছিল। ঘটনার রাতেই তানভীরের মোবাইল থেকেই তার বাবা ফারুক মিয়ার কাছে ফোন করে ৮০ লাখ টাকা চাওয়া হয়, না হলে ছেলেকে মেরে ফেলবে বলে হত্যাকারীরা হুমকি দেয়। এর পরই হত্যাকারীরা ফোনটি বন্ধ করে দেয়। পরে এই বিষয়টি তানভীরের বাবা পুলিশকে অবগত করলে পুলিশ মোবাইল নাম্বার ট্র্যাক করে অবস্থান বের করে। এই অবস্থান দেখা যায় চুনারুঘাট উপজেলায়। মূলত হত্যাকারীরা তানভীরকে হত্যার পর লাশ গুম করে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য চুনারুঘাট গিয়ে এই কল দিয়ে ফোন বন্ধ করে বাড়িতে এসে অবস্থান নেয়। পুলিশ সন্দেহজনকভাবে রবিবার রাতেই নুরপুর গ্রামের জলিল মিয়ার ছেলে জাহেদ ও নুরপুরের মালাই মিয়ার ছেলে শান্তকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে। ব্যাপকভাবে জিজ্ঞাসাবাদের পরে ঘটনার মুল হোতা মাস্টারমাইন্ড উজ্জলকে মঙ্গলবার সকালে গ্রেফতার করে পুলিশ এবং ওইদিনই দুপুরে পশ্চিম নছরতপুর গ্রামের সৈয়দ আলীর বাড়ির পুকার থেকে তানভীরের লাশ উদ্ধার করা হয়।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকারীরা জানায়, তানভীরকে আগেই গলায় ফাঁস ও বুকে ছুরি দিয়ে মেরে ফেলে রেখে দেয়, পরে অবস্থান বদলিয়ে টাকা খোঁজে তানভীরের বাবার কাছে।
স্থানীয়ভাবে ধারণা করা হচ্ছে সম্প্রতি তানভীরের বাবা ফারুক মিয়া বেশকিছু জায়গা বিক্রি করেছিলেন। তার বাবার ব্যাংকে টাকা আছে এই বিষয়টি ঘাতক উজ্জল, শান্ত ও জাহেদ জানত। এই টাকাই কাল হয়ে নেমে আসল তানভীরের বাবা মায়ের জীবনে। তবে পুলিশের কাছে প্রধান হত্যাকারী পশ্চিম নছরতপুর গ্রামের উজ্জল জানায়, সে দীর্ঘদিন বিদেশে ছিল। ৬ বছর পূর্বে তার পিতা সৈয়দ আলীকে এক চুরির বিচারে তানভীরের বাবা ফারুক মিয়া অপমান করেছিল। এতদিন সে সেই রাগ ভিতরে পুষে রাখে। ৬ বছর পূর্বের ঘটনার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে সে এই হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটিয়েছে। কিন্তু ফারুক মিয়ার পরিবার কোন পারিবারিক বিরোধ ছিল না বলে জানায়।