জালাল আহমেদ,
সেই সহকারী জজ সাহেবকে কক্সবাজার জেলা জজ আদালতে কোন বিচারিক ক্ষমতা ছাড়া সংযুক্ত করা হয়
বিজয়ের মাস ডিসেম্বর এগিয়ে আসছিল। এখানে বিজয় দিবসের প্রোগ্রাম হয় পাইলট হাইস্কুলের মাঠে। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী প্রস্তুতি নিচ্ছি কিন্তু এর মাঝে ঝামেলা তৈরি করলেন সহকারী জজ মাহবুবুল আলম। উপজেলা চেয়ারম্যানের সংগে পরামর্শ করেই হয়তো তিনি বললেন যে বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজে পতাকা উত্তোলন মঞ্চে তিনি থাকবেন। আমি স্বভাবতই আপত্তি করলাম কিন্তু তিনি গেলেন উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে। উপজেলা চেয়ারম্যান আমাকে ফোন করলেন, আমি পুনরায় এটা বিধিসম্মত নয় বলে আপত্তি জানালাম। তার যুক্তি ছিল মজার, তিনি বললেন যে ঢাকায় সালামী নেবেন বিচারপতি নুরুল ইসলাম তাই তিনি স্থানীয় বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা হিসেবে থাকতেই পারেন। আমি বললাম যে বিচারপতি নুরুল ইসলাম দেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে পতাকা উত্তোলন করবেন, বিচারপতি হিসেবে নয়।
আমি ভাবলাম যে এটা শেষ কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর যখন আমরা সালামী মঞ্চের দিকে যাচ্ছি তখন চেয়ারম্যানের সংগে তিনিও উঠে গেলেন। ওখানে জনসমক্ষে বলপ্রয়োগ ছাড়া এই মান অপমান জ্ঞানবিহীন ব্যক্তিকে থামানোর আর কোন পথ ছিল না, তা করিনি। তবে বিষয়টা আরো তিক্ততায় রূপ নিলো সন্ধ্যায়, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। সেখানে তার বক্তব্যে তিনি উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে উদ্দেশ্য করে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান নিয়ন্ত্রণের অভিযোগসহ অনেক কথা বলেন। আমি স্বাভাবিকভাবে বক্তব্য রেখে আমার কথা শেষ করি। পরে পুরো বিষয়টি লিখিত ভাবে জেলা প্রশাসককে জানাই।
এরপর থেকে শুরু হল আমাকে হয়রানীর পালা। প্রথম সূত্রপাত এক মাদ্রাসার শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে দেওয়ানী মামলায় আমাকে ব্যক্তিগত হাজিরার নোটিশ দিয়ে। আমি হাজির না হয়ে হাজির হবার আইনগত প্রয়োজন নেই জানালে আদালত অবমাননা’র অভিযোগ আনা হল। এভাবে এক এক করে ৫টি আদালত অবমাননার মামলা আমার বিরুদ্ধে শুরু হল। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে এক মামলাতেও আমাকে হাজির হতে বলা হল। সরকারি কৌশুলী (জিপি)’র মাধ্যমে আমার জবাবে উল্লেখ করলাম যে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আইন শৃংখলা রক্ষা করা ছাড়া ইউএনও’র অন্য কোন দায়িত্ব ছিল না। আর আমি ব্যক্তিগতভাবে ওই নির্বাচনের সময় এই উপজেলায় ছিলাম না।
তারপরও আমার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়। আমার বন্ধু Chowdhury Munir Uddin Mahfuz তখন আইন মন্ত্রনালয়ে সিনিয়র সহকারি সচিব। তিনিও আমাকে করনীয় সম্পর্কে পরামর্শ দিলেন। জেলা প্রশাসক, চট্টগ্রামের মাধ্যমে জেলা জজ মহোদয়ের কাছ থেকে সময় নিয়ে এক শুক্রবারে আমি চট্টগ্রামে তাঁর বাসায় আসি। জেলা জজ মহোদয় অনেকখানি সময় নিয়ে পুরো ঘটনার বিস্তারিত শুনলেন, আমার প্রতিবেদনটিও পড়লেন। তিনি বললেন যে পরদিনই একজন অতিরিক্ত জেলা জজ বাঁশখালী আদালত পরিদর্শনে যাবেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন। তাই হল, পরদিন একজন অতিরিক্ত জেলা জজ বাঁশখালী এলেন, আদালত পরিদর্শন করলেন এবং সবগুলো মামলার নথি চট্টগ্রাম নিয়ে গেলেন। ঐ মামলাগুলো নিয়ে আমাকে আর কোনদিন চিন্তা করতে হয়নি। পরবর্তী সপ্তাহে সহকারী জজ সাহেবকে কক্সবাজার জেলা জজ আদালতে কোন বিচারিক ক্ষমতা ছাড়া সংযুক্ত করা হল। ঐ জেলা জজ সাহেব পরবর্তীতে বিচারপতি এবং আরো পরে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন এবং সবসময়ই আমাকে স্নেহ করতেন।
১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে আম্মা আসলেন বাঁশখালী। আম্মা এর আগেও এসেছেন এবং উপজেলার বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখেছেন। বিশেষ করে চট্টগ্রামের আতিথেয়তা’র নমুনাও তখন পেয়েছিলাম যা আম্মা এখনো বলেন। সংসদ সদস্য মাহমুদুল ইসলামের বাড়িতে দাওয়াত দেয়া হলে আমরা যাই। আমার দুলাভাইও ছিলেন সঙ্গে। সেখানে যখন খাবার ঘরে নিয়ে যাওয়া হল তখন দেখি যে বিশাল টেবিল ভর্তি খাবার। শুমারীর পর দেখা গেল যে ভাত ছাড়া ২৯ টি আইটেম ছিল ওই টেবিলে। আমার একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল ছনুয়া ও পুইছড়িতে। যাই হোক এবার যখন আম্মা আসলেন ততদিনে মোশাররফ মিয়ার হাটের সেতুর ডেকিং মেরামত হয়ে গেছিল তাই উপজেলা পরিষদ এর পিকনিক করে ফেললাম বাহারছড়া সি বীচে। চট্টগ্রাম শহরের ২০ মাইলের মধ্যে চমৎকার এই বীচ আমার কাছে খুব সম্ভাবনাময় মনে হয়েছিল। আমি চেষ্টাও করেছিলাম পরে একে প্রমোট করার। বাঁধা ছিল শঙ্খ নদী যার উপর তখন সেতু ছিল না, এখন হয়েছে। আনোয়ারা উপজেলার পারকি বিচ কিছুটা জনপ্রিয়তা পেলেও বাহারছড়া বিচ এখনো সেই তিমিরেই আছে।
মার্চের ১ তারিখে আম্মাকে নিয়ে চট্টগ্রাম এলাম, আম্মা বাড়ি চলে যাবেন। এডিসি (জেনারেল) মোঃ আফজাল হোসাইন এর বাসায় গেলাম। আম্মা ভাবি Nasrin Hossain এর সংগে আমার বিয়ে নিয়ে আলাপ করছিলেন। আমি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের দোতলা বাসায় একলা থাকি, আমার একটু অসুস্থতা ছিল যা আম্মাকে ভাবাচ্ছিল। ভাবি বললেন যে চাঁদপুর এর যে মেয়ে নিয়ে একবার কথা হয়েছিল তাঁকে বিয়ে করাবেন কি না? আম্মা বললেন যে আমি তো মেয়ে দেখি নাই। ভাবি বললেন যে তিনি দেখানোর ব্যবস্থা করবেন। ভাবি চাঁদপুরে আমার শ্বশুরের সংগে কথা বললেন তিনি আমার স্ত্রীকে নিয়ে চট্টগ্রামে আসতে রাজী হলেন। দু’দিনের মধ্যে আমার শ্বশুর সপরিবারে চট্টগ্রাম এলেন, আফজাল স্যারের বাসাতেই আম্মা ৩ মার্চ ১৯৮৯ আমার স্ত্রী ফারাহ দিবা আহমেদকে দেখলেন ও পছন্দ করলেন। হবিগঞ্জে আব্বার সংগে কথা বললেন এবং আব্বা বলে দিলেন বিয়ের কাজ শেষ করে ফেলতে।
৬ মার্চ ১৯৮৯ তারিখ নির্ধারণ করা হল, স্থান চট্টগ্রাম পুরাতন সার্কিট হাউস। আমরা উঠেছিলাম আমার এক মামাতো বোনের বাসায়। বিয়ের শাড়ি কেনা হয় চট্টগ্রাম নিউ মার্কেট থেকে যে শাড়ি আমার স্ত্রী ২০২০ সালের ডিসেম্বরে তাঁর বড় ছেলের বিয়েতে তাঁর স্ত্রী’র গায়ে জড়িয়ে দেন বিয়ে পড়ানোর সময়। ৬ মার্চ ১৯৮৯ বিয়ে হয়ে গেল, হবিগঞ্জ থেকে আমার ছোট ভাইয়েরা সহ ১০ জন এলো, আব্বা আসতে পারেননি অসুস্থ থাকায়। বিভাগীয় কমিশনার আলী হায়দার খান, জেলা প্রশাসক এম এ মান্নানসহ অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকবৃন্দ শামসুল হক, মোহাম্মদ হাসান, এএফএম আবদুল হক চৌধুরী, জুলহাসউদ্দিন আহমদ ও ১৪ উপজেলার নির্বাহী অফিসারদের অনেকে এবং বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। বিয়ে উপলক্ষে বিশ শতকের শুরুর দিকে বানানো এই সার্কিট হাউসে আলোকসজ্জা করা হয়। আমার বাসররাত কাটে চট্টগ্রাম পুরাতন সার্কিট হাউসের দোতলায় এখন যা জিয়া যাদুঘরের ১নং গ্যালারী, সেই কক্ষে। এর কিছুদিন পরেই সেই সার্কিট হাউজ যাদুঘর হয়ে যায়। বিয়ের অনুষ্ঠানের পুরো দায়িত্ব পালন করেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোঃ আফজাল হোসেইন স্যার এবং ভাবি নাসরিন হোসেইন।