আসামীদের হুমকিতে রউফের পরিবার ভীতসন্ত্রস্ত
এসএম সুরুজ আলী ॥ হাওরে পনিতে ভাসমান অবস্থায় মরদেহ উদ্ধারের ৫ মাস পরও হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার কাগাপাশা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আব্দুর রউফের মৃত্যু রহস্য উদঘাটন হয়নি। এ ঘটনায় হত্যা মামলা দায়ের করলেও আসামীরা প্রকাশ্যে ঘুরছে। ফলে মামলার সুষ্ঠু বিচার নিয়ে শঙ্কিত নিহতের মা জরিনা বেগমসহ তার পরিবার।
এলাকাবাসী ও নিহতের পারিবারিক সূত্র জানায়, হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার কাগাপাশা ইউনিয়নের বাগহাতা গ্রামের সৌদি প্রবাসী আব্দুর রহমানের একমাত্র ছেলে আব্দুর রউফ শচীন্দ্র কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তিনি কাগাপাশা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। গত বছর স্থানীয় আনন্দ বাজারে দু’দল গ্রামবাসীর সংঘর্ষের সময় পুলিশ আহত হওয়ার ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে যে মামলা করা হয়েছে সেই মামলার প্রধান আসামী করা হয় আব্দুর রউফকে। উক্ত পুলিশ এসল্ট মামলায় তিনি কিছুদিন কারাগারে ছিলেন। তাকে জামিন করানো ও রিমান্ড থেকে বাঁচানোর কথা বলে তার মায়ের কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেন তার চাচা তৈয়ব আলী। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করেননি। এদিকে আব্দুর রউফ জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর তৈয়ব আলীর কাছে গিয়ে তার মায়ের কাছ থেকে নেয়া টাকা ফেরত চান। এ নিয়ে চাচা ভাতিজার মধ্যে মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়। চেপটি বিল ইজারা নিয়েও চাচা তৈয়ব আলীর সাথে আব্দুর রউফের বিরোধ ছিল। এর মধ্যে গত ১১ জুলাই রাতে বিল লিজ দেয়া সংক্রান্ত কথা বলার জন্য তাকে তৈয়ব আলীর বাড়িতে নিয়ে যান সাহাজ উদ্দিন। কিন্তু রাতে আর বাড়িতে ফিরেননি রউফ। ১২ জুলাই হাওরে পানিতে ভাসমান অবস্থায় তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে ময়না তদন্ত শেষে পারিবারিক কবরস্থানে আব্দুর রউফের দাফন সম্পন্ন করা হয়।
এ ব্যাপারে ১৬ জুলাই নিহত আব্দুর রউফের মা জরিনা বেগম বানিয়াচং থানায় ৪ জনকে আসামী করে হত্যা দায়ের করেন। মামলার আসামীরা হলেন- নিহত আব্দুর রউফের চাচা তৈয়ব আলী, রফিকুল ইসলাম রবি, শুকুর আলী ও সাহাজ উদ্দি সাহা। এর মধ্যে পুলিশ তৈয়ব আলী ও রফিকুল ইসলাম রবিকে গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে তারা জামিনে ছাড়া পায়। সম্প্রতি আব্দুর রউফের লাশ উদ্ধারের কাছাকাছি স্থানের একটি পুকুর থেকে আব্দুর রউফের পায়ে ব্যবহৃত গানবোট ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করে এলাকাবাসী। পরে এগুলো মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি’র এসআই রকিবুল হাসানের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
সম্প্রতি সরেজমিনে বাগহাতা গ্রামে গিয়ে আব্দুর রউফ কিভাবে মারা গেছে এসব বিষয়ে গ্রামের লোকজন ও নিহতের পরিবারের সদস্যদের সাথে এ প্রতিনিধির কথা হয়। এ ব্যাপারে গ্রামের অনেকেই জানান, আব্দুর রউফের পরিবারের সাথে তার চাচা তৈয়ব আলী, রকিফুল ইসলাম রবি গংদের সম্পত্তি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ রয়েছে। ১১ জুলাই রাতে আব্দুর রউফকে তার নিকটতম আত্মীয় সাহাজ উদ্দিন সাহা খবর দিয়ে তৈয়ব আলীর বাড়িতে নিয়ে যায়। সাহাজ উদ্দিন সাহা ২টি হত্যা মামলার আসামী। সাহাজ উদ্দিনের ভয়ে কেউ মুখ খুলে কথা বলতে সাহস পায় না। যারা কথা বলেন তাদের মামলা মোকাদ্দমা নিয়ে হয়রানী করা হয়। আব্দুর রউফ তৈয়ব আলীর বাড়িতে যান বৃষ্টি থাকার কারণে পায়ে গানবোট পরে। পরের দিন সকালে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। এলাকাবাসীর ভাষ্য অনুযায়ী আব্দুর রউফের বন্ধু তাজুল ইসলাম তার সাথে ছিল। তাজুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আব্দুর রউফ হত্যা রহস্য উদঘাটন হতে পারে বলে তাদের ধারণা।
এ ব্যাপারে নিহত আব্দুর রউফের বড় বোন পারভীন আক্তার জানান, পরিকল্পিতভাবে তৈয়ব আলী, সাহাজ মিয়া গং আমার ভাইকে হত্যা করেছে। হত্যা করার পর সাহাজ উদ্দিন আমার ভাইয়ের হত্যার ঘটনায় অন্য কাউকে ফাঁসানোর চেষ্টা করেন। এতে ব্যর্থ হয়ে সাহাজ উদ্দিন ও তৈয়ব আলী আমার ভাই’র লাশের ময়না তদন্তে বাধা প্রদান করেন। এতে আমরা যখন নিশ্চিত হয়েছি তৈয়ব আলী, সাহাজ উদ্দিন সাহা গং আমার ভাইকে হত্যা করেছে, তখন আমার ভাই হত্যার বিচার চেয়ে মামলা দায়ের করা হয়। পুলিশ এ ঘটনায় দু’জনকে গ্রেফতার করলেও মামলার অনত্যম আসামী সাহাজ উদ্দিন ও শুকুর আলীকে গ্রেফতার করতে পারছে না। তারা দু’জন এলাকায় প্রকাশ্যে ঘুরাফেরা করছে এবং সাহাজ উদ্দিন সাহা মামলা তুলে নিতে আমাদের হত্যার হুমকি দিচ্ছে। এতে আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।
নিহত আব্দুর রউফের মা জরিনা বেগম জানান, চেপটি বিলটি দীর্ঘদিন ধরে তৈয়ব আলী ও সাহাজ উদ্দিন দখলে নিয়ে যাওয়ার জন্য পরিকল্পনা করে আসছিল। আমার ছেলের জন্য আমাদের অংশ দখলে নিতে পারেনি। এরই অংশ হিসেবে তারা বিল ইজারা নেয়ার বিষয়ে কথা বলার জন্য আমার ছেলে রউফকে তৈয়ব আলীর বাড়িতে নিয়ে যায় সাহাজ উদ্দিন। ওই দিন তার সাথে তাজুল ইসলাম ছিল। পরিকল্পিতভাবে তৈয়ব আলী, সাহাজ উদ্দিন গং আমার ছেলেকে হত্যা করেছে। তারা আমার একমাত্র ছেলেকে হত্যা করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি, এখন আমাদেরকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে সাহাজ উদ্দিন ও তৈয়ব আলী।
জরিনা বেগম আরো বলেন- সাহাজ উদ্দিন নিজের চাচাত বোনসহ আরো ২জনকে হত্যা করেছে। পরবর্তীতে সেই হত্যার মামলায় সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান নূরুল ইসলামের ভাইদের আসামী করায়। সাহাজ উদ্দিন ও তাজুল ইসলামকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই আমার ছেলে আব্দুর রউফ হত্যার প্রকৃত রহস্য উদঘাটন হবে। তিনি প্রশাসনের কাছে ছেলে হত্যার সুষ্ঠু বিচার দাবি করে বলেন- আমার ছেলে আব্দুর রউফকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করাবো কিন্তু সাহাজ উদ্দিন, তৈয়ব আলী বাহিনী আমার সেই স্বপ্ন ধ্বংস করে দিল।
এ ব্যাপারে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান এরশাদ আলী জানান, ৫মাস পর আব্দুর রউফের গানবোটের ভিতর থেকে মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। এতে বোঝা যায় এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। খুনীরা ঠান্ডা মাথায় আব্দুর রউফ হত্যা করেছে। তিনি আব্দুর রউফ হত্যার প্রকৃত আসামীদের খুঁজে বের করে গ্রেফতারের মাধ্যমে শাস্তির দাবি জানান।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি’র এসআই রকিবুল হাসান জানান, আব্দুর রউফ হত্যা মামলাটির তদন্ত চলমান রয়েছে। তদন্ত শেষে এর চুড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হবে। পুলিশের একটি সূত্র জানায়, নিহত আব্দুর রউফের ময়না তদন্তের ভিসেরা রিপোর্ট আসলেই আব্দুর রউফ হত্যার রহস্য উদঘাটন হবে। ছাত্রলীগ নেতা আব্দুর রউফ হত্যার রহস্য উদঘাটন করে দোষীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।