এস এম সুরুজ আলী ॥ ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্ত হয়ে হবিগঞ্জের সিভিল সার্জন ডাঃ শাহাদাত হোসেন হাজরার মৃত্যুর কয়েকদিন যেতে না যেতেই ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের ৪৭তম ব্যাচের ছাত্রী, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অনারারি চিকিৎসক ডা. তানিয়া সুলতানা। বৃহস্পতিবার রাত ১০টায় ঢাকার ধানমন্ডি আনোয়ার খান মডার্ণ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। যাত্রবাড়ির বাসিন্দা ডাক্তার তানিয়া সুলতানার বয়স হয়েছিল মাত্র ২৮ বছর। তার সাড়ে তিন বছর বয়সী এক পুত্রসন্তান রয়েছে।
সূত্র জানায়, ডাঃ তানিয়া সুলতানা সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের ৪৭তম ব্যাচের ছাত্রী ছিলেন। এমবিবিএস শেষ করে ঢাকায় চলে আসেন তিনি। বছরখানেক বিরতি দিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন এফসিপিএস কোর্স কমপ্লিট করতে। স্বপ্ন ছিলো এফসিপিএস শেষ করবেন। বাংলাদেশি ডাক্তারের জন্য সবচেয়ে সম্মানের এই কোর্সটির প্রথম পার্ট শেষ করেছিলেন তিনি। ছিলেন পার্ট দুইয়ের শিক্ষার্থী। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না তার । ডেঙ্গু কেড়ে নিলো তার সেই স্বপ্ন। ডাক্তার তানিয়া সুলতানার সাড়ে তিন বছরের পুত্র মায়ের জন্য কান্না করছে। মৃত্যু কি না বুঝলেও মাকে দেখছে না, এটা তাকে কাঁদাচ্ছে। ডাক্তার তানিয়ার স্বামী ব্যবসায়ী আমিনুল বাহার হিমন বলেন, জ্বরের কারণে তানিয়ার এভাবে মৃত্যু হবে আমরা কল্পনাও করিনি। এত অল্প বয়সে আমার বাচ্চাকে মা হারাতে হলো। তিনি বলেন, ছেলেটি তার মাকে পাগলের মতো খুঁজছে। তাকে বলেছি, তোমার মা বেড়াতে গেছে, আসবে। একটু পরেই আসবে। কিন্তু এভাবে কতদিন বাবুকে শান্তনা দিবো। সৃষ্টিকর্তা আমাদের এই কেমন পরিক্ষা নিলেন? তানিয়ার খুব ইচ্ছে ছিলো সে এফসিপিএস করবে। সংসার, বাচ্চা সামলে প্রতিদিন হাসপাতালে যেতো সেই যাত্রাবাড়ি থেকে। তার খুব কষ্ট হতো। তারপরও তার স্বপ্নে অটল ছিলো সে।
ডাক্তার তানিয়া সুলতানা গত ২২ জুলাই থেকে জ্বরে ভুগছিলেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তার ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। ২৪ জুলাই তাকে রাজধানীর মগবাজার কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে বুধবার তাকে আনোয়ার খান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। পর দিন রাত দশটায় তার মৃত্যু হয়। ডাক্তার তানিয়ার স্বামী আমিনুল বাহার হিমন বলেন, বৃহস্পতিবার তাকে আনোয়ার খান মডার্ণ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাক্তার আব্দুল কাহার আকন্দের অধীনে ভর্তি করানো হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ১০টায় তার মৃত্যু হয়। তানিয়ার কলেজের সিনিয়র শ্যামলী টিবি হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. সামিউর রশিদ বলেন, তানিয়া যেখানে চিকিৎসা দিতেন সেই শিশু ওয়ার্ডটিতে প্রচুর পরিমান ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু ছিলো। যেহেতু সেখানে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বেশি ছিলো সেহেতু ওখান থেকেই তিনি আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এছাড়া দশ বারোদিন আগে তার শাশুড়ি মারা গেছে। এই নিয়ে তাকে বেশ কয়েক দিন নানান ঝামেলার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
এ নিয়ে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে তিনজন চিকিৎসকের মৃত্যু হলো। এর আগে রাজধানীর উত্তরায় বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নিগার নাহিদ দিপু নামে একজন চিকিৎসক, দুইদিন আগে হবিগঞ্জের সিভিল সার্জন শাহাদাত হোসেন হাজরা মারা যান।
এই প্রসঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ইমন ভুইয়া বলেন, ডেঙ্গু চিকিৎসা করতে গিয়ে ডাক্তাররা অনেক ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। যেহেতু হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী অনেক সেহেতু চিকিৎসকের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা থেকে যায়। মুগদা জেনারেল হাসপাতালে তিনজন চিকিসৎক ও দুইজন নার্স ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত। এর মধ্যে তিন ডাক্তার হাসপাতালের আইসিউতে ভর্তি রয়েছেন।
ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ছাত্রলীগ নেতা আজিজ হাসপাতালে : এদিকে হবিগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক আজিজ ঢাকায় ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্ত ঢাকা ইবনেসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তিনি ৯ দিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ছাত্রলীগ নেতা আজিজুল হক আজিজের পারিবারিক সূত্র জানায়, সম্প্রতি তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সাথে ঢাকায় দেখা করাসহ অন্যান্য কাজের জন্য ঢাকায় যান। তিনি ঢাকায় ১০/১২ অবস্থান করেন। এ সময়কালে তিনি বিভিন্ন হোটেল ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের হলে রাতযাপন করেন। তিনি গত ১৭ জুলাই অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাকে ইবনেসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করলে কর্মরত চিকিৎসক মেডিকেল টেস্ট করেন। রিপোর্ট আসে ডেঙ্গু পজিটিভ। পরে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গতকাল রাতে ছাত্রলীগ নেতা আজিজুল হক আজিজের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ৯দিন চিকিৎসা নেয়ার পর অনেকটা সুস্থ হয়েছেন। তিনি আজ হবিগঞ্জে ফিরে আসবেন।
সাংবাদিকদের সাথে ডেপুটি সিভিল সার্জন ডাঃ শোভন বসাকের মতবিনিময় : অপরদিকে বৃহস্পতিবার ডেঙ্গু প্রতিরোধে হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালের সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় করেন ডেপুটি সিভিল সার্জন ডাঃ শোভন কুমার বসাক। মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন- হবিগঞ্জে ডেঙ্গু ভাইরাস নেই। ঢাকাতে ডেঙ্গু ভাইরাস রয়েছে। যারা ঢাকায় যাবেন সতর্কতার সাথে রাতযাপন করবেন। আর ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্ত হলে তাৎক্ষনিক চিকিৎসা সেবা নিবেন। তিনি বলেন- বাসা-বাড়ির পাশে ময়লা আবর্জনা ফেলবেন না, টবে পানি জমিয়ে রাখবেন না। এগুলো থেকে মশার উৎপাদন হয়ে থাকে। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া ভাইরাস জনিত রোগ। যা এডিস মশার কামড়ে ছড়ায়। সাধারণ চিকিৎসাতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া জ¦র ভালো হয়ে যায়। তবে হেমোরেজিক ডেঙ্গু জ¦র ও ডেঙ্গু শক্ সিনড্রোম মারাত্মক হতে পারে। কেউ ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্ত হলে ১০৪-১০৫ ডিগ্রী ফা. জ¦র, মাথা ব্যথা, মাংসপেশীতে, চোখের পিছনে ও হাড়ে প্রচন্ড ব্যথা, চামড়ায় লালচে ছোপ (র্যাশ) দেখা যেতে পারে। ডেঙ্গু রোগীকে প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার খাওয়াতে হবে এবং মশারীর ভিতরে বিশ্রামে রাখতে হবে। ডেঙ্গু জ¦রে শুধুমাত্র প্যারাসিটামল ব্যবহার করা যেতে পারে, কোনো অবস্থাতেই এসপিরিন, এনএসএআইডি, জাতীয় ঔষধ সেবন করা যাবে না। হেমোরেজিক ডেঙ্গু জ¦রে ও ডেঙ্গু শক্ সিনড্রোম হলে দাঁতের মাড়ি, নাক, মুখ ও পায়খানার রাস্তা দিয়ে রক্তপাত হতে পারে। সেক্ষেত্রে রোগীকে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে নিতে হবে। চিকুনগুনিয়া জ¦রের লক্ষণও ডেঙ্গু রোগের মত। সাধারণত চিকুনগুনিয়া রোগটি এমনি এমনিই সেরে যায়। তবে কখনো গিটের ব্যথা কয়েক মাস এমনকি কয়েক বছরের বেশী সময় থাকতে পারে। গিটের ব্যথার জন্য গিটের উপরে ঠান্ডা পানির শেক এবং হালকা ব্যায়াম উপকারী হতে পারে। ডেঙ্গুর ভাইরাসবাহী এডিস মশা সাধারণত বাড়ির ভেতরে ফুলের টব, এসি ও ফ্রিজের তলায় ও আশে-পাশে পরিত্যক্ত টায়ার, ডাবের খোসায় জমাকৃত পানিতে ডিম পাড়ে। এ মশা সাধারণত দিনের বেলায়, সূর্যোদয়ের পর এবং সূর্যাস্তের পূর্বে কামড়ায়। এডিস মশার বিস্তার রোধে ফুলের টব, এসি ও ফ্রিজের তলায় ও আশে-পাশে পরিত্যক্ত টায়ার, ডাবের খোসায় পানি জমতে দেয়া যাবে না। বাড়ির আঙ্গিনায় নির্মাণধীন ভবনে পানির চৌবাচ্চা নিয়মিত পরিস্কার রাখতে হবে। দিনেও ঘুমানোর সময় মশারী ব্যবহার করতে হবে।
ডেঙ্গু থেকে সতর্ক থাকতে হবিগঞ্জের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডাঃ শোভন বসাকের পরামর্শ
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com