তাহমিনা বেগম গিনি
আজ বিশ্ব ভালবাসা দিবস। মানুষের যতগুলি মানবিক গুণাবলী তার মাঝে ‘ভালবাসা’ একটি। আর শুধু মানবকুল কেন পশুপাখির মাঝেও ভালবাসা দৃশ্যায়মান। ধরাধামে প্রেম, ভালবাসা বিধাতার বিস্ময়কর এক সৃষ্টি যার রহস্য আজও উদঘাটিত হয় নাই। এই মায়া, প্রেম, ¯েœহ, ভালবাসার বৃত্তের মাঝেই আমাদের জীবনের চাকা ঘুরে চলেছে-বংশ থেকে পরম্পরা, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। কিন্তু ইদানিং মানবিক গুনাবলির এমনতর বিপর্যয় হয়েছে যার প্রমাণ পত্রিকার পাতা মেললেই নজরে আসে। প্রায়ই সংবাদ হয়ে আসেন ঘনিষ্ট আত্মীয় কর্তৃক শিশু-অপহরণ, শিশু ধর্ষণ। পরকিয়ার বলি স্বামী কর্তৃক স্ত্রী, স্ত্রী কৃর্তক স্বামী, মাতা কর্তৃক সন্তান, পিতার দ্বারা সন্তান এবং সন্তানের হাতে পিতামাতার মৃত্যু। বৃদ্ধ পিতামাতার ভার বইতে না পেরে রাতের আধারে ফেলে রেখে যাওয়া, খবরে আসে চট্টগ্রাম সহ বাংলাদেশের যত্রতত্র আজকাল বহু নবজাতক পাওয়া যাচ্ছে জীবিত অথবা মৃত। তখন খুঁজি কোথায় ভালবাসা? খবরের পাতায় দেখি মোবাইলের প্রেমের টানে গৃহত্যাগ, অনশন, অতঃপর আত্মহত্যা। আর নয়তো প্রেমিকের ভালবাসার টানে দেখা করতে এসে গণধর্ষণের শিকার। মোবাইলে সেইসব দৃশ্য ধারণ করে সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ। আবার দেখি ঘনিষ্ট বন্ধু কর্তৃক বন্ধু হত্যা। মুল হলো এক নারীকে দুই বন্ধুর ভালবাসা। অহরহ পত্রিকার পাতায় দেখি বখাটের উৎপাতে ছাত্রীর আত্মহত্যা-ভালবাসার কি নির্মম প্রকাশ। ভালবাসার জন্য ঘরভাঙ্গা, গৃহত্যাগ, হত্যা, ধর্ষণ, এসবই এখন এই সমাজের নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চারিদিকে যখন ভালবাসার জন্য হত্যা তখনো কিন্তু ভালবাসার সেই কথিত নির্দিষ্ট দিন ১৪ই ফেব্রুয়ারি এসেছে। এই ভালবাসার দিনেরও সুত্রপাত হয়েছিল ভালবাসার জন্য একটি হত্যাকান্ডকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য। সে ইতিহাস সবাই জানি। আমি বরাবরের মত এবারও বলছি ভালবাসা কোনো দিনক্ষন, মাস দেখে হয় না। ভালবাসার প্রকাশ সারাবছরই থাকে। ভালবাসা কখন হবে কেউ জানেন না, পরিণাম কি হবে জেনে কেউ ভালবাসা করে না। বাংলাদেশে ১লা ফাল্গুন আর নির্দিষ্ট ভালবাসার দিন হাত ধরাধরি করে আসে। বসন্তের বাসন্তী রঙের সাথে ভালবাসার রঙ মিশিয়ে দিনটি হয়ে ওঠে বর্ণিল, রঙ্গিন। গত বছর এমন দিনে আমি ঢাকায় ছিলাম। সাথে ছিলেন আমার ভালবাসার মানুষটি। গাড়ী ছিল ঢাকা শিশুপার্কের কাছে। গাড়ী একটুও এগুতে পারছিলো না সামনে। তাই গাড়ীতে বসেই অনেক ভালবাসার প্রকাশ দেখেছি মাথা নীচু করে। কারণ পুত্রসম গাড়ীর চালক সাথে ছিল।
প্রথমতঃ আমার মনে হচ্ছিল আমি কোথায় আছি? জানি এবং মানি যুগ এগিয়ে গিয়েছে, সময় পরিবর্তন হয়েছে। ফেসবুক, ইন্টারনেট, এসএমএস এর সাথে চলছে এদেশ-দেশের নবপ্রজন্ম। বার বার মনে হচ্ছিল আমরা কি এতই আধুনিক (!) হয়ে গিয়েছি? আমাদের সন্তানদের মাতা-পিতারা মনমানসিকতায় এতখানি এগিয়ে গিয়েছেন? এসবের নামই কি ভালবাসার প্রকাশ? অসাম্প্রদায়িকতার ধুয়ো তুলে সমস্ত ধর্মের অনুশাসন কি আমাদের সন্তানেরা ভুলতে বসেছে? কোনো কোনো সময় আমি বাধ্য হয়েছি মাথা নীচু করে বসে থাকতে কারণ, আমারও সন্তান আছে। কন্যাসম পুত্রবধূরা আছে। এমন ভালবাসার দিন আমি চাই না। শ্লীলতা নেই বলে মনে হয় পাল্লা দিয়ে ভালবাসার বিপর্যয়ও নেমে এসেছে। পৃথিবী সৃষ্টির আদিকাল থেকে প্রেম ছিল, এখনও আছে। যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন ভালবাসা প্রেম থাকবে। পরিবারের একে অন্যের প্রতি ভালবাসা, প্রতিবেশীর প্রতি ভালবাসা, সন্তানের প্রতি ভালবাসা, স্বামী-স্ত্রীর প্রতি ভালবাসা, গরীবের প্রতি ধনীর ভালবাসা, শিক্ষকের ছাত্রের প্রতি ভালবাসা, সহকর্মীর প্রতি সহমর্মিতা ভালবাসা, শাসকের প্রজার প্রতি ভালবাসা যতদিন থাকবে ততদিন এই সমাজ থাকবে, গোষ্ঠী থাকবে জাত, পাত, ধর্ম থাকবে। সবকিছুর মূলেই প্রেম। শুধু ধরণ এবং প্রকাশগুলো ভিন্ন ভিন্ন। ১লা ফাল্গুন উৎসব আকারে পালন করা বাঙালির সংস্কৃতির ঐতিহ্য। ভালবাসা দিবস পালন বাঙালির সংস্কৃতি নয়। ধার করা সংস্কৃতি সমাজের জন্য মঙ্গল বয়ে আনে না। তারপরও আজকের দিনে কামনা করবো প্রেমের জন্য আর হত্যা, খুন, আত্মহত্যা নয়। সমাজে পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা, সম্মানবোধ ভালবাসা আরো বেশি প্রকাশ হোক। বাংলাদেশের ভ্যালেনটাইন ডে সবচেয়ে বেশী কার্যকর হবে যদি আমাদের সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে গোলাপ বিনিময় হয়। দেশের চালিকা শক্তিতে সৌহার্দ্য, প্রেম, প্রীতি, ভালবাসা থাকলে সমস্ত দেশ ভাল থাকবে, দেশের জনগণ ভাল থাকবে। প্রেমিক কবি ওমর খৈয়ামের কয়েকটি পংক্তি এখানে তুলে দিলাম-

“অনিত্য এই ধারায় জেনো
কিছুই বড় টিকতে নারে,
ভালবাসাই হেথায় শুধু
অমর হয়ে থাকতে পারে।
ভালবাসা দিবসে শুধু নিজের কথা না ভেবে সবার কথা ভাবুন। মনে রাখুন-

“জীবে প্রেম করে যেই জন
সেই জন সেবিছে ঈশ্বর”।