টিটু তালুকদার
অবিশ^াস্য হলেও সত্য আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে রয়েছে রূপকথার মতো একটি গ্রাম। সেই গ্রামের নাম ‘হুলহুলিয়া’। এই গ্রামে শিক্ষার হার শতভাগ। একজনও নিরক্ষর নেই। বরং অধিকাংশই উচ্চ শিক্ষায় আলোকিত। এই গ্রামে নেই চুরি, ডাকাতি বা মাদকের ছোবল। ঝগড়া-বিবাদ নেই বললেই চলে। দুঃখে পরস্পরের পাশে দাঁড়ানো আর সুখে আনন্দ ভাগাভাগি করাই তাদের বৈশিষ্ট্য। গ্রামের মানুষকে চমৎকার এই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে এনেছে ‘হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ’। এই পরিষদ হুলহুলিয়াকে আধুনিক গ্রাম হিসেবে গড়তে কাজ করে যাচ্ছে। নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলার চৌগ্রাম ইউনিয়নে হুলহুলিয় গ্রামটি এ এক আশ্চর্য গ্রাম। দেশের অনেক মিডিয়ায় এ গ্রামের কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। গ্রামের কাহিনী পড়লে মনে হবে সত্যিই এটি রূপকথার গ্রাম।
নাটোর জেলা সদর থেকে ৩৮ কিলোমিটার এবং সিংড়া থানা সদর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে ছায়া ঢাকা, পাখি ডাকা, শান্ত গ্রাম হুলহুলিয়া। ১৩টি পাড়া নিয়ে গঠিত চলন বিলবেষ্টিত গ্রামটির আয়তন প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার। গ্রামটির শিক্ষার হার ও স্যানিটেশন-ব্যবস্থা প্রায় শতভাগ। একটা সময় ছিল, যখন বর্ষা মৌসুমে এই গ্রামে তেমন কোনো ফসল হতো না। ওই সময়ে মানুষের হাতে কোনো কাজও থাকত না। তাই অভাব লেগেই থাকত।
১৯১৪-১৫ সালের দিকে একবার প্রবল বন্যায় ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় গ্রামে অভাব দেখা দেয়। বন্যার পর গ্রামের অনেক চাষি ধানবীজের অভাবে জমি ফেলে রাখতে বাধ্য হন। সবার মনে কষ্ট, হতাশা। বিষয়টি গ্রামের মাতবর মছির উদ্দিন মৃধার মনে দাগ কাটে। একদিন গ্রামের প্রতিটি পরিবার থেকে একজন করে লোক ডেকে নিয়ে সভায় বসেন মৃধা সাহেব। সিদ্ধান্ত হয়, যাঁদের ঘরে অতিরিক্ত ধানবীজ আছে, তাঁরা বিনা শর্তে অন্যদের ধার দেবেন।
সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়, খালি জমি ফসলে ভরে ওঠে। এতে উদ্বুদ্ধ হয়েই গ্রামের উন্নয়নে সবাইকে নিয়ে একটি পরিষদ গঠিত হয়। ১৯৪০ সালের পহেলা জানুয়ারি সেই পরিষদ হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ নামে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। পরিষদ গঠন করার আদিকথা এভাবেই বর্ণনা করলেন হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের সহ-সভাপতি মো. আলমগীর কবীর শাহ।
গ্রামের শাসন ব্যবস্থা: এই পরিষদের মাধ্যমে গ্রামের ‘শাসনব্যবস্থা’ পরিচালিত হয়। ২৩ সদস্যের সামাজিক উন্নয়ন পরিষদে একজন সভাপতি, একজন সহ-সভাপতি ও ২১ জন নির্বাহী সদস্য থাকেন। এছাড়াও ৫ জন উপদেষ্টা থাকেন। দুই বছর পর পর গ্রামবাসীর প্রত্যক্ষ ভোটে পরিষদ নির্বাচিত হয়। পরিষদ গ্রামের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও বিচারব্যবস্থা পরিচালনা করে। ১৯৫৭ সাল থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে পরিষদের সদস্যদের মধ্য থেকে বিচারক প্যানেল গঠিত হয়ে আসছে। গ্রামে কোনো বিরোধ হলে এই প্যানেল আলোচনার মাধ্যমেই তা মীমাংসা করে। বড় কোনো অপরাধ সংগঠিত না হলে থানা বা আদালতে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। আর বিচারক প্যানেল ও পরিষদের ওপর গ্রামবাসীর আস্থা আছে বলে তারা পরিষদের ওপরই নির্ভর করে। এই আস্থাই পরিষদের বড় সাফল্য বলে মনে করে গ্রামের বাসিন্দারা।
এই গ্রামে ব্রিটিশ আমল থেকে নিজস্ব শাসনব্যবস্থা চালু আছে। এই ব্যবস্থা নিয়ে গ্রামবাসীর মধ্যে কখনো বিরোধ সৃষ্টি হয়নি। গ্রামের বিচারব্যবস্থায় ধর্মীয় গোঁড়ামির কোনো ঘটনা নেই। বললেন গ্রামের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মালেক প্রামাণিক।
উন্নয়ন: ১৮৬৯ সালে হুলহুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়। কিন্তু উচ্চ বিদ্যালয় না থাকায় প্রাথমিকের পর অনেকেই ঝরে পড়ত। পরিষদের উদ্যোগ আর গ্রামের মানুষের চেষ্টায় ১৯৬৬ সালে হুলহুলিয়া উচ্চবিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়। শুরুতে শিক্ষকদের অনেকেই বিনা বেতনে বা অর্ধেক বেতনে শিক্ষাদান করেছেন। পরে এখানে একটি মাদ্রাসাও প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি একটি বেসরকারি সংস্থার পরিচালনায় দুটি স্কুল চলছে।
চলন বিলবেষ্টিত হওয়ায় আগে বর্ষা মৌসুমে নৌকাই ছিল গ্রামটির যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। তবে পরিষদের চেষ্টায় এখন সারা বছর সড়কপথেও যাওয়া যায় এই গ্রামে। সবার সহযোগিতায় হুলহুলিয়ায় গড়ে উঠেছে মসজিদ, মন্দিরসহ বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান। গড়ে উঠেছে ডাকঘর ও দাতব্য চিকিৎসালয়ও।
গ্রামের চিকিৎসক সন্তানেরা বিভিন্ন সময়ে বিনা মূল্যে গ্রামবাসীকে চিকিৎসাসেবা দেন। গ্রামে ১৯৪৪ সালে ‘দ্য হুলহুলিয়া ডায়মন্ড ক্লাব’ গঠন করা হয়। ক্লাবের উদ্যোগে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ১৩ সদস্যের একটি কমিটি এই ক্লাব পরিচালনা করে। হুলহুলিয়ায় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে আসছে শেকড় ও বটবৃক্ষ নামের দুটি অরাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন। এই প্রতিষ্ঠানের সদস্য সবাই চাকরিজীবী। তাঁদের অনুদানে গ্রামের অভাবী ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি, অসহায় মানুষকে সহায়তা ও বেকারত্বদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হয়।
একটা সময় এই গ্রামে কোনো কবরস্থান ছিল না। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে কেউ মারা গেলে পুকুরপাড় ও কোনো উঁচু স্থানে তাঁকে কবর দেওয়া হতো। পরিষদের চেষ্টায় প্রায় ৩৫ বিঘা জমির ওপর একটি স্থায়ী কবরস্থান করা হয়েছে। কবরস্থানের দেখভালের জন্য আছে ছয় সদস্যের একটি কমিটি।
সামাজিক সচেতনতা: গ্রামে বাল্যবিবাহ, যৌতুক, মাদক ব্যবসা নেই। সবাই শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সচেতন। এর প্রতিফলন দেখা যায় এই গ্রাম থেকে বেরিয়ে আসা মেধাবীদের পরিসংখ্যান দেখে। গ্রামের দেড় শতাধিক সন্তান প্রকৌশলী ও শতাধিক চিকিৎসকও হয়েছেন। আছেন কৃষিবিদ, আইনবিদ, প্রতিরক্ষা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও।
যাঁদের হাতে গড়া: আধুনিক হুলহুলিয়া গঠনের উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু থেকে নিজেদের মেধা, অর্থ ও শ্রম দিয়ে গেছেন অনেকেই। তবে যাঁদের ভোলার নয় তাঁরা হলেন: শিক্ষাবিদ মরহুম মছির উদ্দিন মৃধা, মরহুম মফিজ উদ্দিন, মরহুম ফরিদ উদ্দিন শাহ, আণবিক শক্তি কমিশনের পরিচালক মরহুম হানিফ উদ্দিন মিঞা, আইন মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব মরহুম এ কে তালুকদার, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম এম এম রহমত উল্লাহ প্রমুখ। এছাড়া বর্তমানে নৌবাহিনীর কমান্ডার জামসেদ আলী, সেনাবাহিনীর কর্নেল মঞ্জুরুল কাদির, পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন (পিবিডিএফ) এর যুগ্ম পরিচালক ড. মো: মনারুল ইসলাম মনাক্কা, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেন্টাল বিভাগের চেয়ারম্যান ডা. মাহাবুবুর রহমান সহ গ্রামের শতাধিক ব্যক্তি উচ্চতর শিক্ষা শেষে বিভিন্ন দেশে বড় বড় চাকরিতে নিয়োজিত থেকে গ্রামের সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
“হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. আল তৌফিক পরশ বলেন, পূর্ব পুরুষদের ঐতিহ্য ধরে রেখে সবাই মিলেমিশে গ্রামে সুশিক্ষা, সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি আধুনিক হুলহুলিয়া গঠনই আমাদের মূল লক্ষ্য। কোনো কারণে পরিষদের বিচার কারও মনমতো না হলে তাঁদের থানা বা আদালতের আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে এ ধরনের ঘটনা নেই বললেই চলে। বিচারকাজ ছাড়াও দুঃস্থ-মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তি প্রদান করে পরিষদ। রয়েছে হত দরিদ্রদের সহযোগিতার জন্য দারিদ্র তহবিল।
পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন এর যুগ্ম পরিচালক ও হুলহুলিয়া শেকড় এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ড. মো: মনারুল ইসলাম মনাক্কা বলেন, গ্রামে ২০০০ সাল থেকে হুলহুলিয়া শেকড় নামের সামাজিক সংগঠন বেকারদের কর্মসংস্থান নিয়ে কাজ শুরু করে। বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ২৬৫ জন। ইতিমধ্যে হুলহুলিয়া গ্রামকে বেকার মুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
চৌগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাহেদুল ইসলাম ভোলা বলেন, হুলহুলিয়া গ্রাম একটি আদর্শ গ্রাম। ইতোমধ্যে স্থানীয় আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের ছোঁয়ায় একটি রোল মডেল গ্রামে পরিণত হয়েছে। আর পরিষদ থাকায় হুলহুলিয়া গ্রামে কোন বিবাদ বা সংঘর্ষ হয় না বললেই চলে। দেশের সব গ্রামেই এমন পরিষদ চালু হলে দেশ অনেক এগিয়ে যেত বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সিংড়া থানার তদন্ত ওসি নেয়ামুল হক বলেন, থানার পরিসংখ্যানই বলে- হুলহুলিয়া গ্রামের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই ভালো। জমিজমা নিয়ে বিরোধ হলেও গ্রামের পরিষদই তা সমাধান করে।
সিংড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুশান্ত কুমার মাহাতো বলেন, ‘হুলহুলিয়া গ্রাম দেশের আর দশটা গ্রাম থেকে অনেকটা আলাদা। এই গ্রামের মানুষ সামাজিক বন্ধনকে বেশি গুরুত্ব দেয়। এমন আদর্শ গ্রাম যেন প্রতিটা জায়গায় হয়।’
আমরা প্রত্যাশা করি বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম হয়ে উঠুক হুলহুলিয়া গ্রামের মতো।
-টিটু তালুকদার
সালমান মটরস্, ফায়ার সার্ভিস রোড, বেবিস্ট্যান্ড, হবিগঞ্জ।