এসএম সুরুজ আলী ॥ স্ত্রীর পরকিয়া প্রেমের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পারিবারিক কলহে অতিষ্ঠ হয়ে স্ত্রী ও শাশুড়িকে হত্যা করেছে সবজি ব্যবসায়ী সেলু মিয়া। গতকাল বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলামের আদালতে ১৬৪ ধারায় মা-মেয়ে হত্যাকান্ডের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে সেলু মিয়া। সে হবিগঞ্জ শহরের উমেদনগরের নুর মিয়া ছেলে। গতরাত ১১টায় হবিগঞ্জের পুলিশ সুপারের সম্মেলন কক্ষে এ নিয়ে প্রেসব্রিফিং করেন পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা।
স্বীকারোক্তিতে সেলু মিয়া জানায়, প্রায় দেড় বছর পূর্বে ঘরে স্ত্রীসহ ২ সন্তান থাকাবস্থায় তিনি বানিয়াচং উপজেলার তারাসই গ্রামের লিল মিয়ার মেয়ে ফুলবরন নেছার (৩০) সাথে পরকিয়া প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলেন। এক পর্যায়ে সেলু মিয়া এফিডেভিট করে ফুলবরন নেছাকে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। ফুলবরন নেছাকে বিয়ে করার সংবাদ তার ১ম স্ত্রীর কাছে পৌঁছার পর পরিবারে অশান্তি নেমে আসে। এক পর্যায়ে সেলু মিয়ার ১ম স্ত্রী তার বাবার বাড়ি নোয়াগাও গ্রামে চলে যায়। এদিকে ২য় স্ত্রী ফুলবরন নেছাকে বাড়িতে এনে সংসার শুরু করেন সেলু মিয়া। পাশাপাশি হবিগঞ্জ শহরের চৌধুরী বাজার কাঁচামাল হাটায় সবজি ব্যবসা করেন তিনি। ২য় স্ত্রীকে নিয়ে কিছুদিন তার সংসার সুখে চললেও হঠাৎ করে সুখের সংসারে দুঃখের আগুন জ¦লে উঠে। স্ত্রী ফুলবরন নেছাকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেন সেলু মিয়া। তার বাড়িতে পরপুরুষের আগমন ও স্ত্রীর ফোনে আলাপে তিনি দ্বিতীয় স্ত্রীর বিরুদ্ধে পরকিয়া প্রেমের অভিযোগ তুলেন। এ নিয়ে সেলু মিয়া ও তার স্ত্রী ফুলবরন নেছার মধ্যে কলহ শুরু হয়। এক পর্যায়ে ফুলবরন নেছা গর্ভবতী হয়ে পড়লে সেলু মিয়া তার পেটের সন্তান নষ্ট করান। এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর পারিবারিক কলহ চরম আকার ধারণ করে। এর মধ্যে আত্মীয় স্বজনসহ স্থানীয় মুরুব্বীয়ান তাদের দ্বন্দ্ব নিরসনও করে দেন। এ পরিস্থিতিতে সেলু মিয়া তার ১ম স্ত্রীকে বাড়িতে নিয়ে আসে। দুই স্ত্রীকে নিয়ে সংসার জীবন করায় সেলু মিয়ার সংসারে অশান্তি আরো বৃদ্ধি পায়। এক পর্যায়ে পরকিয়ার অভিযোগ এনে সেলু মিয়া তার ২য় স্ত্রীকে মারধোর করে তার বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে সেলু মিয়ার ২য় স্ত্রী তার বিরুদ্ধে হবিগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করেন। গত ৫ সেপ্টেম্বর মামলা সংক্রান্ত কাজে হবিগঞ্জ আদালতে আসার জন্য ফুলবরন নেছা ও তার মা জমিলা বেগম প্রস্তুতি নেন। ফুলবরন নেছা আগের দিনই বাড়ি থেকে তার মাকে নিয়ে উমেদনগরস্থ চাচাতো ভাই এনামুল হকের ভাড়া বাসায় রাত্রিযাপন করেন। ৫ সেপ্টেম্বর সকালে সেলু মিয়া ফোন পেয়ে এনামুল এর বাসায় চলে আসে। পরে তার স্ত্রী, শাশুড়ি, এনামুলসহ মামলা মোকদ্দমা নিষ্পত্তির বিষয়ে কথাবার্তা বলে। এক পর্যায়ে সেলু চৌধুরী বাজারস্থ তার পিতার দোকানে চলে যায়। ওইদিন বিকালে আবারও সেলু মিয়া তার স্ত্রী ও শাশুড়িকে ফোন দিয়ে চৌধুরী বাজারস্থ মায়া হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্টে এনে কথাবর্তা বলে। তারপর সে আছরের নামাজের পর তাদেরকে নিয়ে শহরের উমেদনগরস্থ তার নিজ বাড়িতে যায়। সেখানে তার বাবার সাথে শাশুড়ির মামলা নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে তার বাবা সেলু’কে বলে “তুই আমার মুখে চুনকালী দিছস্। হয় তুই বিষ খাইয়া মর – না হয় আমাকে বিষ দে খাইয়ালামু।” তখন সেলু মিয়া মনের দুঃখে বাড়ি থেকে বের হয়ে তার শ্যালক ও শ^শুর লিল মিয়াকে ফোন করে তার স্ত্রী’র বিষয়ে নালিশ করে। কিন্তু সে তাদের কাছ থেকে কোন শান্তনামূলক জবাব পায়নি। তারপর স্ত্রী ও শাশুড়িকে নিয়ে পায়ে হেঁটে কিবরিয়া ব্রীজের চায়ের দোকানে তাদের রেখে সে বের হয়ে যায় এবং ১ম স্ত্রীর পিতা তাজুল মিয়াকে ফোনে তার শ্যালক আনোয়ার (২০) সহ তার সবজির দোকানের লাউ কাটার দা নিয়ে আসতে বলে। সেলু মিয়া তখন একটি সিএনজি খোঁজলে তার পরিচিত চালককে পেয়ে ১২০ টাকা ভাড়ায় ঘটনাস্থল গোবিন্দপুর এলাকাস্থ খোয়াই নদীর পাড়ে চলে যাওয়ার জন্য ঠিক করে। সিএনজি নিয়ে বাড়িতে এসে সেলু মিয়া তার ২য় স্ত্রী ও শাশুড়িকে বলে তোমাদের জন্য নতুন একটি বাসা ভাড়া ঠিক করেছি সেটা দেখতে যাব। এই বলে তাদেরকে সিএনজিতে নিয়ে আসে। ইতোমধ্যে তার ১ম স্ত্রীর পিতা ও শ্যালক সিএনজি’র কাছে চলে আসলে সেলু তার স্ত্রী ও শাশুড়িকে নিয়ে পিছনে বসে, শ্বশুর ও শ্যালক সামনে ড্রাইভারের পাশে বসে গোবিন্দপুর এলাকাস্থ খোয়াই নদীর পাড়ের উদ্দেশে রওনা হয়। ঘটনাস্থলে পৌঁছার ৫০ গজ আগে সিএনজি থামিয়ে তারা সবাই নেমে ড্রাইভারকে গাড়ী ঘুরিয়ে তাকে সিএনজিতে থাকতে বলে। এরপর তারা বেড়ি বাঁধ ধরে কিছু দূর সামনে নির্জন অন্ধকারে গিয়ে নদীর চরে পৌছামাত্র তারা সবাই মিলে তার ফুলবরন নেছা ও জমিলা বেগমকে এলোপাতাড়ি গাছের ডাল দিয়ে বেধড়ক মারপিট শুরু করে। এক পর্যায়ে প্রথমে শাশুড়ি জমিলা ও পরে স্ত্রী ফুলবরন অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। তখন তার শ্বশুর দা দিয়ে জমিলাকে কুপিয়ে আঘাত করে। সেলু তার শ্বশুরের কাছ থেকে দা নিয়ে তার শ্যালক মিলে স্ত্রী’কে কুপিয়ে আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। এদিকে তাদের সিএনজিতে ফিরতে দেরি হওয়ার কারণে ড্রাইভার সামনে এগিয়ে আসলে তাদের সামনে দুই জনের মৃতদেহ দেখে সে ফিরে যাওয়ার চেষ্টাকালে সেলু তাকে দেখে ফেলে এবং হত্যাকান্ডে ফাঁসানোর হুমকি দিয়ে তাকে মৃতদেহ নদীতে ফেলতে সহায়তা করতে বাধ্য করে। মৃতদেহ দুটি তার শ্বশুর, শ্যালক, সিএনজি ড্রাইভার ও সেলু মিলে খোয়াই নদীতে ফেলে দিয়ে উক্ত সিএনজি দিয়ে ফিরে কিবরিয়া ব্রীজে নেমে যে যার মত করে বাসায় চলে যায়।
এ ঘটনার পরদিন ফুলবরন নেছার ভাই ফুল মিয়া তার বোন ও মায়ের কোন সন্ধান না পেয়ে বিষয়টি বানিয়াচং থানা পুলিশকে অবগত করেন। গত ৮ সেপ্টেম্বর বানিয়াচং উপজেলার সুজাতপুর ইউনিয়নের শতমুখা এলাকায় খোয়াই নদীতে ভাসমান অবস্থায় অর্ধগলিত অজ্ঞাত মহিলার লাশ পাওয়া যায়। তাৎক্ষণিক মৃতদেহটি সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। মৃতের সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুতকালে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন পরিলক্ষিত হওয়ায় ১১ সেপ্টেম্বর এসআই ধ্রুবেশ চক্রবর্তী বাদী হয়ে অজ্ঞাত আসামীর বিরুদ্ধে বানিয়াচং থানার মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই এমএ ফারুক আহমেদ মৃতদেহটি সনাক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রকার উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং অজ্ঞাত লাশ হিসেবে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর করেন। পরবর্তীতে গত ১৮ সেপ্টেম্বর বানিয়াচং উপজেলার সুজাতপুর ইউনিয়নের পূর্ব বাজুকা গ্রামের অংশে খোয়াই নদীতে ভাসমান অবস্থায় পঁচাগলা অজ্ঞাত মহিলার লাশ দেখতে পান এলাকাবাসী। পরে পুলিশ অজ্ঞাত লাশটি উদ্ধার করে। প্রাথমিকভাবে উদ্ধারকৃত সেলু মিয়ার সমন্ধি মোঃ ফুল মিয়া সনাক্ত করেন সেটি তার মা জমিলা বেগমের লাশ। পরে জমিলার বেগমের ছেলে ফুল মিয়া ও তার স্বজনরা লাশ বাড়িতে নিয়ে দাফন করে। এদিকে ঘটনার পর পরই ঘাতক সেলু মিয়া আত্মাগোপন করে। পুলিশের দায়েরকৃত মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশ সুপারের কাছে প্রেরণ করা হয়। পরবর্তীতে পুলিশ সুপার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শৈলেন্দ্র চাকমা, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এসএম রাজু আহমেদকে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নিহত ফুলবরন নেছার স্বামীকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। এক পর্যায়ে ফুলবরন নেছার মোবাইল ফোনটির অবস্থান স্থান নির্ধারণ করেন। পরে পুলিশ সুপারের নির্দেশে ডিবির ওসি মানিকুল ইসলাম ও এসআই আবুল কালাম আজাদ মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করেন। মোবাইলটি ঘাতক সেলু মিয়া এক ভিক্ষুকের কাছে বিক্রি করেছিল। মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে ১ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটার দিকে পুলিশ সুপারের নির্দেশে ডিবি’র ওসি মানিকুল ইসলাম ও এসআই আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে একদল পুলিশ নবীগঞ্জ উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের ইউনুছ মিয়া ওরপে সাজুর বাড়ি থেকে সেলু মিয়াকে গ্রেফতার করেন। ইউনূছ মিয়া ওরফে সাজু মিয়া সেলু মিয়ার সম্পর্কে মামা। প্রেস বিফিংয়ে পুলিশ সুপার বলেন- ঘটনার পর পরই পুলিশ ঘাতক সেলু মিয়াকে গ্রেফতারের জন্য পুলিশ বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করেছে। অবশেষে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। প্রেস ব্রিফিংকালে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বানিয়াচং সার্কেল) শৈলেন চাকমা, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এসএম রাজু আহমেদ, ডিবির ওসি মানিকুল ইসলাম, ডিবির ওসি এমরান হোসেন প্রমূখ।
নদী থেকে অজ্ঞাত অবস্থায় উদ্ধার হওয়া মা-মেয়ের লাশের রহস্য উদঘাটন
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com