জালাল আহমেদ
মহান আল্লাহ্র কাছে শুকরিয়া তিনি আমাদের সারাজীবন নিরাপদে রেখেছেন ও এখনো রাখছেন
এর মাঝেই সেই খুদুকখালী ইস্যু খুঁচিয়েই যাচ্ছিল। যেহেতু আমি সরেজমিনে জায়গাটি দেখে এসেছি এবং স্থানীয় জনসাধারণসহ মোহাজেরদের সংগে কথা বলে এসেছি আমার অনুভব ছিল এখানকার স্থানীয়দের ক্ষোভ অপনোদন বিষয়টির স্থায়ী সমাধানে সহায়ক হবে। কারণ ৪০ বছর আগে এই মোহাজেররা এখানে এলেও তাদের মোহাজের তকমা মুছে তারা স্থানীয়দের সাথে মিশে যেতে পারেনি। উপকূলীয় মোহাজের সমিতি নামটিও এই মিশে যাবার বিপক্ষে কাজ করেছে। এই চিন্তা থেকে আমি ১৩৩ একর কৃষি জমি বাদ দিয়ে ৪১ একর চিংড়ি-লবন জমি স্থানীয়দের মধ্যে বিলিবন্টনের প্রস্তাব ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পাঠাই। মোহাজেররা কেউ আমার কাছে না এলেও খবর পাই যে স্বাভাবিকভাবেই তারা অসন্তুষ্ট এবং তারা মনে করছে যে আমি স্থানীয় সংসদ সদস্যের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছি। তারা আমার বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করলো। আমি এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে দীর্ঘ প্রতিবেদন দিলাম যার কপি আমার কাছে এখনো রয়েছে। কর্তৃপক্ষ আমার প্রস্তাব অনুযায়ীই সিদ্ধান্ত নিলেন। তবে আমার কর্মকালীন সময়ে একাধিক চিংড়ি ও লবন মৌসুম পার হলেও খুদুকখালী নিয়ে কোন দাংগা বা প্রাণহানি হয়নি। আর এক্ষেত্রে যে আমার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল তার প্রমাণ আমি পাই আরো পাঁচ বছর পরে।
বাঁশখালী উপকূলীয় উপজেলা এবং তখন সমুদ্রপথে চোরাচালান ছিল সর্বব্যাপী। চট্টগ্রাম দিয়ে মূলতঃ দেশে ঢুকতো বেনসন এন্ড হেজেস ও ট্রিপল ফাইভ জাতীয় বিলাসী সিগারেট, কম্বল, কাটলারিজ, গ্লাস অয়্যারস, সিরামিকস এবং ভিসিআর-ভিসিপি। মূলতঃ চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষিণ পাড়ের আনোয়ারা এজন্য কুখ্যাত ছিল, বাঁশখালী’র নামও একসংগেই উচ্চারিত হত। কারণ শঙ্খ নদী ছিল দুটি উপজেলার অভিন্ন সীমানা। একদিন সন্ধ্যায় খবর পাওয়া গেল যে শঙ্খ নদীর মোহনায়, বাঁশখালী অংশে চোরাচালানীদের একটি বোট আটকানো হয়েছে এবং এতে কিছু লুটপাটও হয়েছে। খবর পেয়ে আমি ও উপজেলা চেয়ারম্যান সুজিত কান্তি শিকদার রওয়ানা দিলাম। পুকুরিয়া ও খানখানাবাদ ইউনিয়নের সীমানায় এই ঘটনা। গিয়ে দেখি দুই চেয়ারম্যান মোস্তাকিমুল হায়দার চৌধুরী এবং আবদুল হামিদ সেখানে উপস্থিত আছেন, পুলিশও আছে। ছোট নৌকা করে গিয়ে ওই কোস্টাল ভেসেলে উঠলাম, বিশাল কাঠের ধাউ জাতীয় বোট, বিশাল তার হোল্ড এবং হোল্ড ভর্তি ভিসিআর, ভিসিপি আর সিগারেট। প্রশ্ন হলো যে মালামাল সেখানেই জব্দ তলিকা করে জব্দ করা হবে কি না? এতে ঝুঁকি আছে, ঝুঁকি আছে সমুদ্রে বের হয়ে থানার ঘাটে আসারও। কিন্তু আমি ওই সিদ্ধান্তই দিলাম। কেউ একজন আমাকে পরামর্শ দিল ওই বোটে চড়ে ফিরে আসার। আমি ভাবলাম কেটে সমুদ্রে ফেলে দিয়ে বোট চলে যাবে মায়ানমার! বললাম যে আমি মালামালের স্টেক দেখে গেলাম, থানার ঘাটে আমি এই মাল বুঝে নেব। ফিরে এলাম সদরে, বোটও এলো মাঝরাতের পর। সকালে গিয়ে স্টক দেখে মন-ছবি মিলিয়ে নিলাম। দুদিন পর কিন্তু ঠিকই ঠেলাগাড়িতে করে ভিসিপি নিয়ে যাবার সময় উপজেলা সদরেই ধরা পড়লো। অর্থাৎ জব্দনামায় উল্লিখিত পরিমাণ আর বাস্তব উদ্ধারে গরমিল ছিল।
আমার স্ত্রী ছিলেন তখন সন্তান সম্ভবা। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বাসা আপনারা অনেকেই দেখেছেন, ১৯৬০ সালের পর বানানো, ডুপ্লেক্স, সিড়ি ছিল খাড়া, একদিন সিঁড়ির নীচের কোন ধাপে তাঁর পা ফসকালো। গুরুতর কোন অসুবিধা না হলেও ব্যাথা পেয়েছিলেন। বাঁশখালী সদরে যে মাদ্রাসা ছিল তার প্রধান ছিলেন পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামে শ্রদ্ধেয় মৌলানা এলাহী বখশ। তিনি বাসায় আসলেন, দোয়া করে গেলেন। সিদ্ধান্ত হল যে আমার স্ত্রী চলে যাবেন পিত্রালয়, চাঁদপুরে। আমার শ্বশুরের ইচ্ছা তাঁর প্রথম নাতির জন্ম হবে ঢাকায়, কোন ভালো সুযোগ সুবিধাযুক্ত স্থানে। আমার শর্ত হল ঢাকায় হোক, কিন্তু আমার সন্তানের জন্ম হবে সরকারি হাসপাতালে কারণ নামী ক্লিনিকের বিল প্রদানের সামর্থ্য আমার নেই।
বাঁশখালী থেকে চট্টগ্রাম রওয়ানা হলাম উপজেলা পরিষদের সবুজ মিতসুবিশি জীপ নিয়ে। আমি চালাচ্ছি, ফ্রন্ট সিটে আমার স্ত্রী, আমার শাশুড়ি ও আমার আম্মা। পেছনে আমার শ্বশুর, আমার ভাগ্নি নিতু, ড্রাইভার জামাল, আরো কেউ।
আমি তখন নিয়মিত গাড়ি চালাই। চট্টগ্রাম থেকে মিটিং করে ফেরার পথে জামাল পেছনে রেস্ট নিতো আর আমি চালিয়ে ফিরতাম। ঐদিনও নরমাল সানি ডে, সেপ্টেম্বর মাস, বোয়ালখালী রাস্তার মুখ পার হবার পর কিছু জায়গায় রাস্তা ভেজা, মূলতঃ খাল থেকে অপরিশোধিত লবন নিয়ে ট্রাকগুলো পাটিয়া লবন মিলগুলোতে যায়, সেগুলোর চুয়ানো পানি। সামনে একটা ট্রাক, ওভারটেক করতে যাবো, ডান পাশে একটা মিনিবাস আসছে। ব্রেক চেপে গাড়ি ট্রাকের পেছনে নিয়ে আসলাম। মিনিবাসটা চলে যাবার পর যখন আবার এক্সেলেটরে চাপ দিলাম গাড়ি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। সে একবার ডানে একবার বামে ঘুরে যেতে লাগলো। আমি এক্সেলেটর থেকে পা তুলে বেক চেপে আর ব্রেক ছেড়ে কয়েক চক্করের পর গাড়ি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হলাম। পেছনে ড্রাইভার জামাল দরজা খুলে ফেলেছিল বাইরে লাফ দেবার জন্য। ভাগ্য ভালো ছিলে যে তখন সড়কে উল্টোদিক থেকে কোন গাড়ি আসছিল না, একদম নিকট পেছন থেকেও না। বামপাশে ছিল গভীর খাল যদিও তখন ছিল ভাটার সময়। আমি ইঞ্জিন বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম, তারপর আবার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চট্টগ্রামে চালিয়ে এলাম। এই সম্ভাব্য দুর্ঘটনার কোন কারণ আমি এখনো খুঁজে পাই না। তবে মহান আল্লাহ্র কাছে শুকরিয়া যে তিনি আমাদের সারাজীবন নিরাপদে রেখেছিলেন ও এখনো রাখছেন।