প্রতিষ্ঠানটিতে প্রতিটি শিশুর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়া হয়। কোন শিশুর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার উপর কোন কাজ চাপিয়ে দেয়া হয় না। শুরু থেকেই সমাপনী পরীক্ষায় শতভাগ পাশসহ সাফল্য অর্জন করে আসছে স্কুলটির শিক্ষার্থীরা

মঈন উদ্দিন আহমেদ ॥ হবিগঞ্জের প্রথম ইংরেজি মাধ্যম (ইংলিশ ভার্সন) স্কুল চিলড্রেন গ্রেইস শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ২০০৩ সালে এনজিও সংস্থা সিএমএসডি প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীতে এনজিও সংস্থা তার প্রজেক্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এ প্রতিষ্ঠানেরই প্রিন্সিপাল মোঃ আব্দুছ ছাত্তার। বর্তমানে তার তত্ত্বাবধানেই স্কুলটি পরিচালিত হচ্ছে।
এ ব্যাপারে চিলড্রেন গ্রেইস স্কুলের প্রিন্সিপাল মোঃ আব্দুছ ছাত্তার বলেন, ২০০৩ সালের জানুয়ারি মাস থেকে শহরের রাজনগর এলাকায় ভাড়া বাসায় এনজিও সংস্থা সিএমএসডি স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করে। শুধু হবিগঞ্জে নয় সারা দেশেই তারা এরকম আরো অনেক স্কুল প্রতিষ্ঠা করে দীর্ঘদিন পরিচালনা করে। ওই সময় আমি এ স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। বলতে গেলে তাদের এ প্রতিষ্ঠানটি হচ্ছে হবিগঞ্জের প্রথম ইংলিশ ভার্সন স্কুল। তবে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে ২০১০ সালে ইংলিশ ভার্সন বন্ধ হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইংলিশ ভার্সনের জন্য উপযুক্ত শিক্ষার্থী পাওয়া যায় না। শিক্ষার্থীরা ৩য় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলেই সরকারি স্কুলে চলে যায়। এতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক কমে যায়। শ্রেণি কার্যক্রম চালাতে গিয়ে তাদের বেকায়দায় পড়তে হয়। তাই বাধ্য হয়ে ইংলিশ ভার্সন বন্ধ করে দেয়া হয়। শুরুতে প্লে থেকে ক্লাস ওয়ান পর্যন্ত ছাত্রছাত্রী ভর্তি করা হয়। প্রথম বছর প্লে শেণিতে ১৩ জন, নার্সারী শ্রেণিতে ১৫ জন ও ক্লাস ওয়ানে ১ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। আর তাদের নিয়েই বিদ্যালয়টির পথচলা শুরু হয়। ২০১৩ সালে প্রজেক্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপাল মোঃ আব্দুছ ছাত্তার স্কুলের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার মতো অন্যান্য স্থানেও এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাই স্কুলের দায়িত্ব নেন। প্রতিষ্ঠাকালীন এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ছিলেন ৪ জন। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানে ১০ জন শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন। আর প্লে থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত ৭টি ক্লাসে এর শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এর পাঠদান গতানুগতিক শিক্ষাদান পদ্ধতির ব্যতিক্রম। এখানে শিক্ষার্থীদের মেধা অনুসারে ৩টি দলে ভাগ করে আনন্দ, বিনোদন ও খেলাধুলার মাধ্যমে পাঠদান করানো হয়।
সকাল ৮টা ৪০ মিনিটে শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হয়। প্লে, নার্সারী ও ওয়ান এই তিন শ্রেণির ক্লাস ৮টা ৪০ মিনিট থেকে শুরু হয়ে চলে সকাল সাড়ে ১১টা পর্যন্ত। আর দ্বিতীয় থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত সকাল সাড়ে ১১টা থেকে ক্লাস শুরু হয়ে চলে বেলা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত। এ্যাসেম্বলী দুই শিফটের শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে একত্রে অনুষ্ঠিত হয়।
স্কুলের প্রিন্সিপাল মোঃ আব্দুছ ছাত্তার আরও বলেন, স্কুলটিতে প্রতিটি ক্লাসে শিক্ষার্থী সর্বোচ্চ ২০ জন। আর তাদের পাঠদান করাতে দায়িত্ব পালন করেন ২ জন শিক্ষক। এ প্রতিষ্ঠানের পাঠদান পদ্ধতি একটু ভিন্ন আঙ্গিকের। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের ইউ আকৃতির করে মুখোমুখি বসানো হয়। শিক্ষক প্রথমে শিক্ষার্থীদের সাথে কুশল বিনিময় করে তাদের বাড়ির খবরাখবর নেন। ১০ মিনিট বিভিন্ন বিনোদনমূল গল্প গান করেন। পরবর্তীতে ২০ মিনিট বাংলা, অংক, ইংরেজি বুঝানো হয়। পরে তাদের বিষয় ভিত্তিক নির্ধারিত টেবিলে প্রেরণ করা হয়। ৩টি গ্রুপে তাদের ভাগ করে বসানো হয়। পরে নির্ধারিত বিষয় তাদের বুঝানো হয় এবং সেই অনুযায়ী কাজ করতে বলা হয়। তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেন, তাদের পাঠদান পদ্ধতি সৃজনশীল পদ্ধতির, যা শহরের অন্যকোন প্রতিষ্ঠানে নেই। তাদের প্রতিষ্ঠানে প্রতিটি শিশুর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়া হয়। কোন শিশুর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার উপর কোন কাজ চাপিয়ে দেয়া হয় না। স্কুলের প্রত্যেক শিক্ষক শিক্ষার্থীর ইচ্ছাকে সমর্থন করে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এ ব্যাপারে শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রতিটি শিশুকে বিদ্যালয়ে ৩ ধাপে শিক্ষা প্রদান করা হয়।
স্কুলে বর্তমানে ১৫০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বেসিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে প্রতিমাসে প্রশিক্ষণ পরিচালনা করা হয়। হবিগঞ্জ কিন্ডারগার্টেন ফোরামের নিয়মিত সভায় তার প্রস্তাবেই শিক্ষকদের দক্ষ করতে প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। এ পর্যন্ত হবিগঞ্জের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৭৫ জন শিক্ষককে হবিগঞ্জ কিন্ডারগার্টেন ফোরামের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।
বিদ্যালয়ের সাফল্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্কুলটি শুরু থেকেই সমাপনী পরীক্ষায় শতভাগ পাশসহ সাফল্য অর্জন করে আসছে। যার শতকরা ৮০ ভাগ শিক্ষার্থী এ-প্লাস পেয়ে থাকে। হবিগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও বিকেজিসি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়া এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ৬০ ভাগই মেধা তালিকায় স্থান লাভসহ কৃতিত্ব অর্জন করে থাকে। হবিগঞ্জ কিন্ডারগার্টেন ফোরাম আয়োজিত বৃত্তি পরীক্ষায় ২০১৭ সালে ৫৬ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে পাশ করে ৪৮ জন, ২০১৮ সালে ৫৭ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে পাশ করে ৫০ জন ও ২০১৯ সালে ৯৯ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে পাশ করেছে ৬৫ জন। তাছাড়া এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়সহ দেশ বিদেশের বিভিন্ন নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করছে। এ ছাড়াও এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশ টেলিভিশনের আনন্দ ভূবন অনুষ্ঠানে নৃত্যে অংশগ্রহণ করে হবিগঞ্জের মুখ উজ্জল করে।
বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাতে কলমে শিক্ষা দিতে আউটডোরে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রজেক্টেরের মাধ্যমে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালিত হয়। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার মান যাচাই করতে সাপ্তাহিক ও মাসিক মডেল টেস্ট অনুষ্ঠিত হয়। এপ্রিল মাসে ১ম সাময়িক, জুলাই মাসে ২য় সাময়িক এবং ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে বার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরে তিন পরীক্ষার ফলাফল একত্রে সমন্বয় করে চুড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করা হয়। এখানে সরকার নির্ধারিত পাঠ্যবই ছাড়াও শিশুর মেধা বিকাশে কম্পিউটার, সাধারণ জ্ঞান, চিত্রাংকন ও সঙ্গীত প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে থাকে। আর কোন শিক্ষার্থী তার ক্লাসে ৬ মাসের মধ্যে কোর্স সম্পন্ন করলে তাকে অটো প্রমোশন দেয়া হয়।
চিলড্রেন গ্রেইস স্কুলের প্রিন্সিপাল মোঃ আব্দুছ ছাত্তার স্বপ্ন দেখেন বিদ্যালয়টিকে ভবিষ্যতে হাই স্কুলে উন্নীত করা। এজন্য তিনি সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।