মঈন উদ্দিন আহমেদ ॥ সংখ্যালঘুদের আস্থাহীনতা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে দিনের পর দিন নানা বঞ্চনা থেকে তা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে তা আমাদের সমাজ তথা রাষ্ট্রের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ আস্থাহীনতার সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে তা রাষ্ট্রের উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) হবিগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট ত্রিলোক কান্তি চৌধুরী বিজন বলেন, সংখ্যালঘুদের আস্থাহীনতার মূল সমস্যাটি শুরু হয়েছে বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে। আগে সমাজ ব্যবস্থায় সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগুরুদের মধ্যে একটি সুসম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। যা কালের বিবর্তনে আস্থাহীনতায় পর্যবসিত হয়েছে। সহজভাবে বললে একটু সুস্পষ্ট মেরুকরণ করা হয়েছে। যে মেরুকরণের ফলে কে হিন্দু, কে মুসলিম, কে খ্রিস্টান, কে বৌদ্ধ এই ভাগগুলো মানুষের মনুষ্যত্বকে ছাপিয়ে উপরে উঠে এসেছে। বিষয়টি আরো তীব্রতর হয়েছে বর্তমান ডিজিটাল যুগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাবে। আলাদা আলাদা গ্রুপ করে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ কারণে মাঝে মধ্যেই একে অপরের প্রতি শত্রুতা মেটানোর জন্য এমন পোস্ট দেয় যে, যা সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় রূপ নেয়। এ বিষয়টি সামাজিকভাবে প্রতিহত না করতে পারলে ঘটনার পর রাষ্ট্রের যেকোন কাজই আস্থাহীনতার জায়গাটিকে পূরণ করতে পারে না। এছাড়া যখন স্বার্থের প্রশ্ন আসে তখন সামাজিক সংগঠন বা রাজনৈতিক সংগঠন নিজেদের আদর্শ থেকে দূরে সরে এসে একত্রিত হয়ে যায়। এসব কারণেও আস্থাহীনতার সংকট তৈরি হয়। স্থানীয় প্রশাসনের মূলত এমন কোন ক্ষমতা নেইযে কোন আস্থাহীনতার জায়গা তৈরি হলে তা দূরীভূত করতে পারে। যে কাজটি তাদের প্রশাসনিক দায়িত্বের বাইরে কাজে লাগবে সেটি হচ্ছে স্থানীয় সরকারের সর্বনি¤œ পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি অর্থাৎ ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার ও স্থানীয় বিভিন্ন ধর্মীয় নেতাদের নিয়ে মাঝেমধ্যে সভা সমাবেশ করা এবং যে সমস্যাগুলো দেশে ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে তার আলোকে আলোচনা করা। ভবিষ্যতে এ ধরণের ঘটনা ঘটলে কি করণীয় এবং কিভাবে এ বিষয়গুলো সমাধান করা যায় এবং আইনের আওতায় থেকে কিভাবে সমাধান করা যায় এ বিষয়গুলো চিন্তা চেতনায় রাখা। তাহলে ভবিষ্যতে সমস্যা একেবারে নির্মূল করা না গেলেও সমস্যা অনেকটা সমাধান করা যাবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে বিচারহীনতা। কোন একটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটলে যদি তার সুষ্ঠু বিচার না হয় তাহলে স্বভাবতই আস্থার সংকট তৈরি হয়। বিচার হয় না বলে যেমন আস্থাহীনতা আছে তেমনি একই কারণে যারা এই আস্থাহীনতা সৃষ্টিকারী তারাও অপরাধ করতে উৎসাহিত হয়। এ বিষয়গুলো কঠোরভাবে দেখে অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। যারা বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয় অপরাধির শাস্তি নিশ্চিতের মাধ্যমে তাদের মাঝে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। না হলে দেশে আস্থার সংকট থেকেই যাবে। যা একটি গণতান্ত্রিক দেশে কখনো কাম্য নয়।
বঙ্গবন্ধু পরিষদ হবিগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি, চা বাগানের আইন উপদেষ্টা ও পূবালী ব্যাংক হবিগঞ্জ অঞ্চলের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আবুল খায়ের বলেন, পৃথিবী সৃষ্টির জন্মলগ্ন থেকেই এই আস্থাহীনতার সংকট চলে আসছে। দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার যখন মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্দি পায় তখই চরম আস্থার সংকট তৈরি হয়। কখনো কখনো এ সংকট থেকে বিদ্রোহের সৃষ্টি হয়ে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে। বর্তমান সভ্য যুগেও এই ধারা চলমান রয়েছে। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রই নিজেদেরকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ^াসী বলে বিশ^ সম্প্রদায়ের কাছে নিজেদেরকে তুলে ধরছে। তার পরও অসংখ্য রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুদের আস্থাহীনতার সংকট প্রবলভাবে বিরাজমান। সংখ্যালঘুদের আস্থাহীনতার সংকট বর্বর যুগের চেয়ে শতভাগ দূরীভূত না হলেও অনেকাংশেই তা দূরীভূত হয়েছে। আর এ থেকেই আমরা স্বপ্ন দেখছি আগামীর, যেদিন এ সমাজ থেকে আস্থার সংকট চিরতরে বিলীন হয়ে যাবে। আর সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশে^র অনুকরণীয় রোল মডেল হতে পারে।
মূলধারার জনগোষ্ঠীর সাথে দলিত সংখ্যালঘুদের অধিকার ও আস্থার সংকট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশে মূলধারার জনগোষ্ঠীর সাথে দলিত সংখ্যালঘুদের অধিকারের কোন পার্থক্য নেই। সংখ্যাগরিষ্টরা যেমন এ দেশের নাগরিক, তেমনি দলিত সংখ্যালঘুরাও এ দেশের নাগরিক। সংখ্যাগরিষ্টরা এ দেশের নাগরিক হিসেবে যে সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করছেন, তেমনি সংখ্যালঘুরাও সে সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করছেন। এ ক্ষেত্রে কোন বিভেদ নেই। যদিও পূর্বের শাসকগণের সময়ে সংখ্যালঘুদের মাঝে অধিকার ও আস্থার সংকট ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর এ সংকট নেই বললেই চলে। বরং দলিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনকে সরকার বিশেষ দৃষ্টিতে দেখে থাকে। তারা যাতে কোন প্রকার নির্যাতন বা বঞ্চনার শিকার না হয় সে বিষয়ে শেখ হাসিনার সরকার সব সময় আন্তরিক ও তৎপর। ফলে দলিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনও শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি আস্থা রেখে রাষ্ট্রের কল্যাণে সকল কাজে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসে। যা একটি কল্যাণমুখি রাষ্ট্রের জন্য ইতিবাচক।