সমাজ দর্পন...

তাহমিনা বেগম গিনি
নিজের গতিতে সময় এগিয়ে গেলেও সভ্যতার চাকা কখনো দাবি করে আরও গতি। আর এ জন্যই জন্ম হয়েছিল বেগম রোকেয়ার মত মানুষদের-যারা একধাপেই সময়কে এগিয়ে দিতে পারেন আলোকবর্ষ দূর। তিনি শুধু স্বপ্ন দেখাননি, স্বপ্ন পূরণের জন্য লড়াই করতেও শিখিয়েছেন। যে আধার ঘিরে রেখেছিল আমাদের চারপাশ, সেখানে আলোর বর্ণচ্ছটায় সব অন্ধকার দূর করে এনেছিলেন কাক্সিক্ষত সকাল। বেগম রোকেয়া তাই কেবল একটি নাম নয়, বেগম রোকেয়া মানে আলোয় আলোয় ভরা এক উজ্জ্বল সকাল। তাকে নিয়ে কিছু লেখার জন্য আজ কলম ধরেছি। এর পেছনেও তারই অবদান। তার জন্ম, মৃত্যু দিনটিতে তাকে স্মরণের আগে তাই জানাতে চাই অনেক শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। বেগম রোকেয়া ছিলেন এ উপমহাদেশের নারী জাগরণের অগ্রদূত। প্রায় ২শ’ বছর পরাধীনতার শৃঙ্খলে থেকে এদেশের মুসলিম সমাজ নানাদিক দিয়ে বঞ্চিত হয়, তেমনি তাদের মাঝে কুসংস্কার ও অশিক্ষা দানা বাধতে থাকে। এই কুশিক্ষা ও কুসংস্কারের বেশি শিকার হন এদেশের নারী সমাজ। মাতৃভাষায় জ্ঞানার্জন তৎকালীন বাঙালি মুসলিম সমাজে প্রায় নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে। এ অবস্থা থেকে নারী সমাজে উত্তরণের জন্য যারা অসামান্য অবদান রাখেন তাদের মধ্যে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন অন্যতম। ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলাধীন পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহন করে এই মহিয়সী নারী। পারিবারিক নাম ছিল রোকেয়া খাতুন। আর কর্মজীবনে পরিচিত ছিলেন মিসেস আর.এস. হোসেন নামে। বাবার নাম ছিল জহির উদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের ও মা রাহাতুন্নেছা। মোহাম্মদ ইব্রাহিম আবুল আসাদ সাবের ও খলিলুর রহমান আবু সায়গাম সাবের তার দুই ভাই এবং বোন ছিলেন করিমুন্নেছা ও হুমায়ারা। কোনদিন স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পাননি এই মহিয়সী নারী। কিন্তু বড় ভাই বোনের চেষ্টায় তিনি বাংলা ও ইংরেজী পড়া শিখেন এবং লেখার হাতেখড়িও হয়। সে লেখা আর থেমে থাকেনি। সময়টা ২০ শতকের শুরুর দিক। ইউরোপের রেনেসাঁর ছোয়ায় জাগতে শুরু করেছে বাঙালি। অবশ্য সে জাগরণে নারীর অংশগ্রহন কতখানি, তা বেগম রোকেয়ার ভাষাতেই জানা যায়- “স্বামী যখন কল্পনার সাহায্যে সুদূর আকাশের গ্রহ নক্ষত্রমালা পরিবেষ্টিত সৌরজগতে বিচরণ করেন, সূর্য মন্ডলের ঘনফল তুলাদন্ডে ওজন করেন এবং ধুমকেতুর গতি নির্ণয় করেন, স্ত্রী তখন রন্ধনশালায় বিচরণ করেন, চাউল ডাল ওজন করেন এবং রাধুনীর গতি নির্ণয় করেন”। সময়ের প্রেক্ষাপটে দারুণ সাহসী ছিল তার কন্ঠ- “যে পর্যন্ত পুরুষগণ শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে স্ত্রীলোকদিগকে তাহাদের প্রাপ্য অধিকার দিতে স্বীকৃত না হয়, সে পর্যন্ত তাহারা স্ত্রীলোকদিগকে শিক্ষাও দিবে না। যারা নিজের সমাজকে উদ্ধার করিতে পারিতেছে না, তাহারা আর দেশোদ্ধার কিরূপে করিবে? অর্ধাঙ্গীনিকে বন্ধিনী রাখিয়া নিজে স্বাধীনতা চাহে, এরূপ আকাক্সক্ষা পাগলেরই শোভা পায়”। বেগম রোকেয়ার ৫টি গ্রন্থ তাকে স্মরণীয় করে রেখেছে- এগুলো হল মতিচুর (১ম খন্ড) ১৯০৪, সুলতানার স্বপ্ন (১৯০৮), মতিচুর (২য় খন্ড) ১৯২২, পদ্মরাগ (১৯২৪) এবং অবরোধ বাসিনী (১৯৩১)। তিনি কবিতাও লিখেছেন যা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। ‘অবরোধ বাসিনী’ বেগম রোকেয়ার এক অসাধারণ সৃষ্টি। এই বইয়ের পরতে পরতে নারীকে মূল্যায়ন করেছেন সত্যিকারের মানুষ হিসেবে।
১৮ বছর বয়সে স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সাথে বিবাহ হয়। তিনি সরকারি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। ১০ বছরের বৈবাহিক জীবনে স্বামী তাকে ভালমত ইংরেজী শিক্ষা দান করেন। তৎকালীন নারীদের দুঃখের কথা, বন্দী জীবনের কথা, পর্দার কথা, তখন থেকেই লিখতে শুরু করেন। স্ত্রীর নারী শিক্ষার আগ্রহ দেখে, স্বামী মৃত্যুর আগে তাকে বলে যান মেয়েদের জন্য স্কুল করতে এবং কিছু অর্থও রেখে যান। দুটি মেয়ে হয়েছিল, পরে মারা যায়। মাত্র ৫টি মেয়ে নিয়ে তিনি প্রথমে পাঠশালা খোলেন। নাম দেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাই ইস্কুল। এ সময়ে বেগম রোকেয়া আনজুমান-এ-খতিয়ান ইসলাম নামে একটি সমিতি করেন। এখান থেকে বিধবা মহিলাদেরকে অর্থ সাহায্য করতেন। বেগম রোকেয়ার সময় নারী শিক্ষার কোন স্কুল ছিল না। তিনি প্রথম নারীদের, বিশেষ করে মুসলিম নারীদের শিক্ষার প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করেছিলেন। শিক্ষায় সভ্যতায় সমাজ আজ অনেক দূর এগিয়েছে। বেগম রোকেয়া যে শিক্ষার আলো জ্বেলেছিলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বে তা আজ শতধারায় বিচ্ছুরিত। তবুও আজ বলতে হয় “মানসিকতা কি এগিয়েছে ততদূর”? কতদূর এগোল মানুষ? কেন এখনও পথেঘাটে, অফিসে, আদালতে, শিক্ষাঙ্গনে, চলন্ত বাসে নারীরা নির্যাতিত হয়? শিশুরা অপহৃত হয়, নির্যাতিত হয়? কেন এখনো বখাটেদের অত্যাচারে আত্মহত্যা করে আমাদের মেয়েরা? আজ প্রায় দেড়শত বছর পরেও আমাদের মেয়েরা কি এসব ব্যবহারের দাতভাঙ্গা জবাব দেওয়ার সাহস রাখে? বেগম রোকেয়ার এতখানি সংগ্রাম-পরিশ্রমের কিভাবে মূল্যায়ন করছি আমরা? তাকে নিয়ে এ সময়ের ৩ জন তরুণের ভাবনার কথা তুলে ধরছি- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অনন্যা- “হলে যাওয়া আসার পথে রোজ দেখি তার পাথরের মূর্তি। ভাবি কবে বুঝি দুফোটা জল গড়িয়ে পড়বে মূর্তিটির চোখ দিয়ে। আমাদের আবেগ কি এত ঠুনকো যে, প্রেমে ব্যর্থ হলেই গলায় ওড়না পেচিয়ে ঝুলে পড়তে হবে? একবুক আশা আর স্বপ্ন নিয়ে আমরা ভর্তি হই দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যাপিঠে। সে স্বপ্ন কেন এত সহজে ভেঙ্গে যাবে? সে সময়ে বেগম রোকেয়া যে দৃঢ়তা দেখাতে পেরেছেন, তার সামান্য অনুপ্রেরণাও কেন আমরা নিতে পারছি না? এটা আমাদের ব্যর্থতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী মিনহাজ উদ্দিন মনে করেন “সময়ের ধারাবাহিকতায় এখনকার মেয়েদের অর্জন অনেক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যাই তার প্রমাণ। তবে তুলনামুলকভাবে পুরুষদের মানসিকতা যে বেশিদূর এগিয়েছে তা মনে হয় না। রোকেয়ার স্বপ্নের যে বৈষম্যহীন সমাজ, তা গড়তে হলে তাদের সহযোগিতাও খুব জরুরী”। সেনাবাহিনীতে কাজ করছেন সেগুফতা আফরিন। তিনি বলেন- “নারীর অর্জন কতখানি তা চারপাশে তাকালেই দেখা যাবে। আজকে সেনাবাহিনীতে অনেক মহিলা কাজ করছে, এটা কিছুদিন আগেও ভাবা যেত না। তবে সেনাবাহিনীতে নারীর অংশগ্রহন আরো বেশি হওয়া উচিৎ। উন্নয়নের শুরুটা আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা আরো জোরদার হতে হবে”।
বছরের বিশেষ দিনে আমরা বসি নারীর চাওয়া পাওয়ার হিসাব মিলাতে। রোকেয়া সারাজীবন কাজ করেছেন নারী-পুরুষের সমান অধিকারের পক্ষে। স্বপ্ন দেখেছেন বৈষম্যহীন সমাজের। স্বপ্নটা সেদিনই সত্য হবে যেদিন আমাদের আলাদাভাবে অধিকার আদায়ের লড়াই করতে হবে না। সব শেষে বেগম রোকেয়ার একটি উক্তি দিয়ে লেখা শেষ করছি- “বাইরে আলো জ্বালাবে পুরুষ, আর ঘরে আলো জ্বালাবে নারী। ঘর অন্ধকার রেখে শুধু বাইরে আলো জ্বালালে সমাজ সুন্দরভাবে গড়ে উঠবে না। জাতি গঠিত হবে না-বড় হবে না। জাতিকে বড় করতে হলে মায়েদের শিক্ষার প্রয়োজন”।