সন্ধ্যে হলেই দাদীর পাশে শুয়ে শুয়ে কিচ্ছা কাহিনী, কলেরা, বসন্তের ভীতিকর বানোয়াট গল্প শোনা ছাড়া আর কোন কাজ ছিল না

ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব
প্রাথমিক শিক্ষাজীবন বাড়িতে কেটেছে বলতে গেলে দাদীর আঁচলের আবর্তেই। যতটুকু মনে পড়ে বোধশক্তি হওয়ার পর থেকে দাদীর পাশেই ঘুমাতাম। তৎকালীন সময়ে ক্লাস ওয়ানে ‘ছড়া ও পড়া’ এবং ছোট্ট একটা ধারাপাত ছাড়া আর কোন বই ছিল না। তাও আবার ক্লাস ওয়ানে ধারাপাতের অংশবিশেষ পড়তে হত। মনে আছে বড় চাচার মতের বিরুদ্ধে বাবা জোর করে মাঠ থেকে ধরে নিয়ে যখন স্কুলের অত্যন্ত কড়া প্রধান শিক্ষক বাবু সুরেশ চন্দ্র দাসের হাতে তুলে দিয়ে আসলেন অতঃপর স্কুল পালানোর দুঃসাহস দেখানো আর সম্ভব হয়নি। প্রাণপ্রিয় শিক্ষক বাবু দীনেশ চন্দ্র দাস পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ দেখে যখন মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে শুরু করলেন স্কুলের প্রতি আসক্তিটা বেড়ে গেল অনেক গুণে। মোটামুটি তিন চার মাসে ‘ছড়া ও পড়া’ শেষ করে দু’তিনটা রিভিশন হয়ে যাওয়ার পর একেবারে অবসর।
সন্ধ্যে হলেই দাদীর পাশে শুয়ে শুয়ে কিচ্ছা কাহিনী ও কলেরা, বসন্তের ভীতিকর বানোয়াট গল্প শোনা ছাড়া আর কোন কাজ ছিল না। দ্বিতীয়ত ঐ সময়ে প্রাথমিক শিক্ষা জীবনে অজ পাড়াগাঁয়ে বাড়িতে আবার পড়াশোনা করার কোন রেওয়াজ ছিল বলে আমার জানা নেই। ঠাকুরমার ঝুলির গল্পের মতই শিশুমনে আঁচরকাটা রাজকুমার আর রাজকুমারীকে নিয়ে কল্পনার রাজ্যে নিজে আরো রং মিশিয়ে একসময় কিভাবে যেন ঘুমিয়ে পড়তাম। তখন ব্ল্যাংকেটেতো দূরের কথা, লেপ বা রাজাইও ছিল অপ্রতুল। কোন মেহমান বা অতিরিক্ত কেউ বাড়িতে আসলে দাদীর সাথে ভারী কাঁথার নিচে ঘুমাতে হত।
যা বলছিলাম- মাঝে মধ্যে ঘুমের মাঝে মনে হত কি যেন বুকের মাঝে পাথরচাঁপা দিয়ে ধরত। ইচ্ছে করলেও হাত-পা নাড়াতে পারতাম না। পাশে দাদীকে জোরে ডাকতে চেষ্টা করতাম কিন্তু গলা দিয়ে কোন স্বর বের হত না। কত যে জোর-জবরদস্তি, এ কি যে এক কষ্ট! কথা বলার প্রাণান্তকর চেষ্টায় এক রকম গুংগানি শুরু হত যা চলত বেশ কিছুক্ষণ। আমার ডাক কেউ শুনছে না, আমার কষ্টটা কেউ বুঝতেছে না। এহেন পরিস্থিতিতে ধস্তাধস্তি ও গুংগানির এক পর্যায়ে দাদী যখন জেগে উঠে একটু নাড়া দিতেন তখন ছাড়া পেতাম। মনে হত যেন পুনর্জন্ম ফিরে পেলাম। দাদী বলতেন ‘বোবায়’ ধরেছিল। নিস্তেজ শরীর ও মন নিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়তাম। এখন বুঝি এসব ছিল দুর্বল ও অবসন্ন শরীরের উপর ভারী কাঁথার চাপের ফলাফল। অধিক্ষণ একভাবে শুয়ে থাকার ফলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে রক্ত সঞ্চালন কমে যাওয়ার কারণে নড়াচড়া করার ক্ষমতাও হয়ত হ্রাস পেত। এ বোবায় ধরার অভিজ্ঞতা যে কত কষ্টকর ছিল তা কারো জীবনে দু’একবার ঘটে থাকলে তা অনুভব করা সম্ভব।
যারা সাধারণত বোবা তারা কিন্তু কালা তথা কানেও শুনে না। মস্তিস্কে কথাবলা ও কানে শোনার জায়গা বা সেন্টার দুটো মহাকৌশুলী সৃষ্টিকর্তা ভেবেচিন্তে একেবারে পাশাপাশি বা সংলগ্ন করে সৃষ্টি করেছেন ফলে যে বোবা সে কালা তথা কানে শুনে না। একটু ভেবে দেখুনত যে বোবা সে যদি কানে শুনতে পেত কি অবস্থা হত? আপনি অকথ্য ভাষায় তাকে গালিগালাজ করলেন, সে শুনল অথচ কোন প্রতিউত্তর দিতে পারল না তার অবস্থাটা কি হবে? হার্ট ফেল বা প্রচলিত কথায় কলিজা ফেটে মারাও যেতে পারে। মহানুভব সৃষ্টিকর্তা কি উপকারটাই না করলেন।
কিন্তু অদ্যাবধি আমাদে চোখদ্বয় শত অন্যায়কে দেখে আসছে, কর্ণদ্বয় হাজারো অবিচারের কাহিনী শুনে আসছে কিন্তু বিবেক সব বিষজ্বালা বুকে নিয়ে কি চমৎকার ভাবেই না সতত নির্বিকার! এ-তো সেই ছোট বেলায় দাদীর বলা ‘বোবা ধরা’র মতই এবং বিষয়টা একই সমতলে। যেন ‘আমি চিৎকার করে কাঁদিতে চাহিয়া করিতে পারি না চিৎকার’।
সেদিন দাদী ছিলেন, ছিল দাদীর আঁচলের আচ্ছাদন, সচেতন দাদীর সতর্ক এক সার্বক্ষণিক সাহচর্য। ঘুমুতে যাওয়ার সময় বোবা ধরার ভয় থাকলেও ভরসা ছিল দাদী পাশে আছেন। ধাক্কাটা সময়মত আসবেই। বিপদ যত বড়ই হোক না কেন তিমিরকে অতিক্রম করে ঊষার উদয় হবেই। তাই আজ দাদীকে বড্ড মনে পড়ছে। একটু ধাক্কার যে সবসময়ই বড্ড প্রয়োজন ॥