এস কে শাহীন ।। ২০০২ সালের এক ভরা বর্ষা। উত্তর বাংলার প্রত্যন্ত এক গ্রাম পাটুলিয়া। চারপাশে শুধু পানি আর পানি। মাঠঘাট, খালবিল, পাড়ার পথ সব পানিতে থৈথৈ করছে। তবে গ্রামের মানুষের মন যেন আরও বেশি ভিজে উঠেছে ভালোলাগায়।
ছোট্ট ছেলেটি জুয়েল। বয়স নয় কি দশ। বাবাকে হারিয়েছে বছর তিনেক আগে। মা আছেই কেবল, সেও সারাদিন কাজের তাগিদে ঘরের বাইরে। দাদির কাছে বড় হচ্ছে ছেলেটা।
বর্ষা এলেই জুয়েলের প্রাণ খুলে যায়। তার সবচেয়ে প্রিয় সময় বর্ষাকাল। কারণ এই বর্ষাতেই খালের পানি বেড়ে যায়, নৌকা চলে, পাড়ার ছেলেরা দল বেঁধে পাটের আঁশ ছাড়ায়, খালে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাছ ধরে। আর বর্ষা মানেই নতুন গল্প, নতুন খেলা, আর ভেজা বিকেল।
সেদিন সকাল থেকে বৃষ্টি। মেঘের গর্জন মাঝে মাঝে হালকা থামে, আবার নামে একটানা ঝর। জুয়েল স্কুলে যেতে পারেনি। দাদি তাকে বলে, “বৃষ্টি থাকুক, বাপু। আজ গায়ে কাঁদা লাগাইও না।” কিন্তু জুয়েলের মন কি মানে?
সে হাতে ছোট বাঁশের ভেলা নিয়ে ছুটে যায় খালের দিকে। ধানের জমিগুলো পানিতে ভেসে, সবুজ পাতাগুলো জলে ঝুঁকে পড়েছে। মাঝখানে একটা সরু বাঁশের সাঁকো। সেখান দিয়ে হেঁটে সে পৌঁছায় তার ‘গোপন জগতে’ পাড়ার খালপাড়। আজ নৌকা ভাসছে। হোসেন কাকার নৌকা। একদল কিশোর পাট বেঁধে জল ছেঁচে তুলছে। দূরে মাঝখানে ছোট একটা নৌকা নিয়ে পাড়ার ‘মুন্নী আপা’ বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বাজার ফিরছে।
জুয়েল দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে। কী অপূর্ব দৃশ্য! মনে হয় এই মুহূর্তটাই সে আঁকতে চায় মনে। হঠাৎ পেছনে কেউ ডাক দেয়- এই জুয়েল, ভিজে যাস না!
সে পেছনে তাকিয়ে দেখে রুনা। তার ক্লাস মেট। হাতে ছাতা, চোখে তিরিক্ষি রাগ।
জুয়েল হেসে বলে- বর্ষায় ভিজতেই হয়। তুমি কি বৃষ্টিতে ভিজতে জানো না?
রুনা গম্ভীর মুখে ছাতা তার হাতে ধরিয়ে দেয়- এই ছাতা রাখ, নয়তো ঠাণ্ডা লাগবে। আমি মা’র জন্য ধনেপাতা তুলতে এসেছি।
জুয়েল এবার একটু চুপ করে যায়। ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে খালের দিকে তাকিয়ে বলে- জানো, রুনা? এই বৃষ্টির দিনে বাবার কথা খুব মনে পড়ে। উনি নৌকায় করে গান গাইতেন…”
রুনার চোখও ভিজে আসে। সে চুপচাপ পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।
এভাবে বর্ষার দিন, খালপাড়, ধানের ক্ষেত, আর দুই শিশুর কোমল বন্ধুত্ব মিশে যায় প্রকৃতির সঙ্গে। সেদিনের সেই বৃষ্টিভেজা দুপুরে জুয়েল বুঝে ফেলে- বর্ষা শুধু জল নয়, বর্ষা স্মৃতি, বর্ষা কান্না, বর্ষা ভালোবাসা।