
এম,এ আহমদ আজাদ, নবীগঞ্জ থেকে || শুধু নবীগঞ্জ নয় সারা দেশের লন্ডনীদের কাছে সাতকরা একটি অতি পরিচিত ও টক জাতীয় ফল। এ ফলের চাহিদা লন্ডন ও সিলেটের মধ্যে খুবই বেশি। এবার নবীগঞ্জের সাতকরা যাচ্ছে লন্ডনে। সাতকরার ঘ্রাণই এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অনেকটা কমলালেবুর মতো গোলাকার এই সাতকরা সিলেট অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আগে সিলেট ছাড়া বাংলাদেশের অন্য কোথাও সাতকরা দেখা না গেলেও বর্তমানে সিলেট অঞ্চল ছাড়িয়ে দেশ বিদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এ ফলটি। এর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে প্রবাসে বসবাসকারী সিলেটবাসীর কাছে। আর একটি কথা না বললেই নয়, এটি ভারতের আসামের পাহাড়ি এলাকার আদি ফল। সিলেটের পাহাড়ি টিলায় সাতকরার চাষ হয়। লেবুগাছের মতো সাতকরা কাটা ভরা গাছ যার উচ্চতা প্রায় ২০ থেকে ২৫ ফুট পর্যন্ত দেখা গেছে। ফাগুন মাসে ফুল আসে ও জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়ে ফল হয়। সিলেটে এর প্রচুর চাহিদার কারণে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের আসাম ও মেঘালয় থেকেও আমদানি হয়। সাতকরা একটি ভিটামিন সমৃদ্ধ ফল। এতে ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস আছে। এমনকি ঔষধ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। সাতকরার আচার সিলেটের মনিপুরী বাসীদের হাতে বানানো বিখ্যাত আচার।
দেখতে গোলাকার কমলার চেয়ে বড় আকৃতির ফলটির খোসা পুরু আর শাঁস (চাল) পরিমাণে খুবই কম। এক সময় সাতকরার চাষ হতো সিলেটের নবীগঞ্জ, চুনারুঘাট, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাটের জাফলং বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, ছাতক, বড়লেখা, কোম্পানীগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, কুলাউড়া কমলগঞ্জের পাহাড়ের টিলায়। এখন ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্যে এর ব্যাপক চাষ হচ্ছে। সাতকরা ভৌগলিকভাবে সেমি পাহাড়ী এলাকার ফল। তবে বাংলাদেশে সাতকরার জনপ্রিয়তা আগের চেয়েও এখন অনেক বেড়েছে। সিলেটি প্রবাসীদের কাছে সাতকরার চাহিদা আর সুনাম দুটোই আছে। বিশেষ করে লন্ডনে সাতকরার চাহিদা আকাশচুম্বি ও দাম অনেক বেশি।
লন্ডন প্রবাসী গৃহবধু সাবিনা ইয়াসমিনের সাথে আলাপ হয় দেবপাড়া বাজারে। তিনি সাতকরা কিনতে এসেছেন। তিনি বলেন, দেশে দেড়শ থেকে দুইশ টাকার মধ্যে একহালি সবচেয়ে ভালো সাতকরা পাচ্ছি। লন্ডনে এক হালি সাতকরা ২০ থেকে ২৫ পাউন্ড দিয়েও পাওয়া যায় না। বাংলা টাকায় প্রতিহালি ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা দিয়ে কিনতে হয়। তাই বেশি করে সাতকরা কিনে শুকিয়ে শুটকি করে নিয়ে যাবো।
সিলেটের বিভিন্ন সীমান্তের আমদানি সূত্রের দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতি বছর ২১৬ মেট্রিক টন সাতকরা আসছে। এছাড়া অবৈধভাবে সীমান্ত পার হয়েও সাতকরা আসছে দেশে। সিলেটের প্রতিটি বাজারেই সারা বছর সাতকরা পাওয়া যায়। এখন একহালি সাতকরা বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে দুইশ টাকায়।
গরুর মাংসের সাথে সাতকরা একটি বিশেষ মজাদার ও জনপ্রিয় মুখরোচক খাবার। এই সাতকরা গরুর মাংসের সাথে রান্নায় মাংসের স্বাদ দ্বিগুণ ও অতুলনীয় করে তুলে। যে একবার সাতকরা সহ গরুর মাংসের স্বাদ পাবেন তিনি বারবার খেতে চাইবেন।
হলুদ ও হালকা সবুজ রঙের লেবুজাতীয় গোলাকার একটি ফল সাতকরা। সিলেট অঞ্চলের বাজারে এখন কদর বেড়েছে ফলটির। ঢাকা সিলেট মহাসড়কের পাশে নবীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন বাজারে সাতকরার ছাহিদা আকাশচুম্মি। উপজেলার গোপলারবাজার, আউশকান্দি বাজার, দেবপাড়া বাজার, বাংলাবাজার ও নবীগঞ্জ শহরের প্রায় সব বাজারেই সাতকরার পসরা লক্ষ করা গেছে।
ক্রেতা-বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গরুর মাংস দিয়ে হরেক রকমের রান্না হয়। শুধু নবীগঞ্জ নয়, সারা সিলেটের মানুষের কাছে সাতকরা দিয়ে গরুর মাংস পছন্দের পদ। সাতকরা দিয়ে মাংস রান্না এখন ঐতিহ্য হয়ে গেছে। সাতকরার খোসা দিয়ে রান্না করা হয়, ভেতরের অংশ মাছের কারি টকঝাল স্বাদ আলাদা রয়েছে।
গতকাল রবিবার মহাসড়কের উপর নবীগঞ্জ উপজেলার দেবপাড়া ও আউশকান্দি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সাতকরা বিক্রি হচ্ছে হালি হিসেবে। প্রতি হালি আকার ভেদে ৮০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত চাচ্ছেন বিক্রেতারা। ক্রেতারা দামাদামি করে নিচ্ছেন। কেউ হালি হিসেবে, কেউ ডজন হিসেবে নিচ্ছেন।
রবিবার দুপুর ১২টার দিকে মহাসড়কের দেবপাড়া বাজারে গিয়ে দেখা যায়, এলাকায় সাতকরা কিনছিলেন আউশকান্দি এলাকার বাসিন্দা কাজল মিয়া। তিনি বলেন, রান্নায় বেশি পরিমাণে সাতকরা ব্যবহার করা হয় না। এ জন্য তিনি এক হালি কিনেছেন। এক হালি ১৮০ টাকায় কিনেছেন। সপ্তাহখানেক আগেও ৮০ টাকা হালি কিনেছেন। আজ বিক্রেতারা ২০০ টাকা হালি চাচ্ছেন। পরে দরদাম করে ১৮০ টাকায় কিনেছেন।
দেবপাড়া বাজার এলাকার বিক্রেতা আব্দুল মান্নান বলেন, তিনি ১২ বছর ধরে সাতকরার ব্যবসা করেন। প্রতি মওসুমে তিনি কয়েক লাখ টাকার সাতকরা বিক্রি করেন। তিনি জারা লেবু ও সাতকরার ব্যবসা সব সময় করে থাকেন। আগে সিলেট অঞ্চলে সাতকরা চাষিরা সাতকরা সরবরাহ করলেও এখন সেগুলো পাওয়া যায় না। এখন ভারত থেকে আসে। বস্তায় নিয়ে আসা সাতকরা একেকটিতে ১০০ থেকে ১৫০টির মতো থাকে। সেগুলো নিয়ে এসে পরে বাজারে বিক্রি করেন। পরিবহনসহ বাজারে বিক্রির জন্য তোলা পর্যন্ত খরচ বেশি পড়ায় দামও বেশি রাখতে হচ্ছে।
ক্রেতা ও বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, জ্যৈষ্ঠ থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত সাতকরার মৌসুম। এ সময় সিলেটের বাজারে সাতকরা আসে। তবে বছরের অন্য সময়ও সাতকরা পাওয়া যায়। অনেকে সাতকরার খোসা শুকিয়ে রাখে। পরে ভিজিয়ে রান্নায় ব্যবহার করেন। আবার কেউ কেউ আচার তৈরি করে রাখেন, সেগুলো রান্নায় ব্যবহার করেন। মাংস রান্নায় সাতকরা স্বাদে ও গন্ধে ভিন্নতা আনে, যা ভোজনরসিকদের খুব প্রিয়।
দিনারপুর সিটফরিদ এলাকার বাসিন্দা পারভিন বেগম ছেলে জাকিরকে নিয়ে আউশকান্দি বাজার থেকে সাতকরা কিনছিলেন। কিছুটা বড় আকারের সাতকরা বিক্রেতা হালিপ্রতি ১৮০ টাকা করে চাচ্ছিলেন। পারভিন বেগম বলেন, বর্ষার এই সময়ে বাজারে প্রচুর পরিমাণে সাতকরা পাওয়া যায়। তিনি এখন সাতকরা সংগ্রহ করে কিছুটা শুকিয়ে রাখেন, কিছুটা আচার বানিয়ে রাখেন। পরে সারা বছর রান্নার সময় সেগুলো ব্যবহার করেন।
আউশকান্দি বাজারের বিক্রেতা আব্দুল মালিক বলেন, আগে শুধু সিলেট অঞ্চলে সাতকরার চাহিদা থাকলেও এখন পর্যটকেরা সিলেটে এলে সাতকরা কিনে নিয়ে যান। সারা দেশেই এখন সাতকরার চাহিদা আছে। তাই আমাদের এলাকায় সাতকরা কম মিলে, চাহিদা বেশি।
নবীগঞ্জ শহরের ছাদিক মিয়া নামের এক বিক্রেতা বলেন, আমাদের এলাকার মানুষের মতো, পর্যটকেরা সাতকরা কিনলেও কিভাবে খেতে হয় জানেন না। বিক্রেতাদের রান্নার নিয়ম শিখিয়ে দিতে হয়।
তিনি বলেন, সাতকরা ভারতের আসাম এবং সিলেট অঞ্চলের একটি বিশেষ ফল। সিলেট ছাড়া দেশের কোথাও এ ফল দেখা যায় না। আসাম ও সিলেটের জৈন্তাপুরে আদিবাসীরা ফলটি ওষুধ, রান্না ও তরকারির স্বাদ বাড়াতে ব্যবহার করে থাকেন।
নবীগঞ্জের লন্ডন প্রবাসী শাহ রমিজ আলী বলেন, এখন সিলেট অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের রসনার অন্যতম অনুষঙ্গ সাতকরা। তবে সিলেটে একে ‘হাতকরা’ নামে ডাকা হয়। সিলেটের পরিসীমা ছাড়িয়ে দেশে-বিদেশেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সাতকরা। টক আর তিতা স্বাদের সংমিশ্রণে ফলটির ঘ্রাণ অনন্য। আমরা এখন প্রচুর সাতকরা কিনে লন্ডন নিয়ে যাই। বিশেষ করে লন্ডনে সাতকরার আচার নিয়ে যাই, সেটা লন্ডনে অতুলনীয় চাহিদা ও দাম আকাশচুম্মি। তাই সব লন্ডনী দেশ থেকে সাতকরা নিয়ে যান।
নবীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শেখ ফজলুল হক মনি বলেন, সিলেটের সব জায়গায় সাতকরার চাহিদা খুবই বেশি। এই ফলটি সঠিকভাবে রান্না করলে অনেক মজাদার। বিশেষ করে গরুর মাংসের সাথে সাতকরার টেস্ট খুবই মজাদার ও সুস্বাধু হয়। নবীগঞ্জের দিনারপুর পাহাড়ি এলাকা সাতকরা চাষের জন্য উপযোগি। সেখানে চাষ করার জন্য আমরা কৃষকদের উৎসাহিত করছি।
১৫