শ্রুতিমধুর তেলাওয়াতে মুগ্ধ তিন প্রজন্ম
শাহ ফখরুজ্জামান ॥ যে কোন পেশা বা কাজে অর্ধশত বছর অতিক্রান্ত করা বিশেষ কিছু। এই মাহেন্দ্রক্ষণকে উদযাপন করা হয় জাঁকজমকভাবে। তবে একই মসজিদে টানা অর্ধশত বছর খতমে তারাবি পড়ানোর এক ব্যতিক্রম ও অনন্য নজির গড়েছেন মাধবপুর উপজেলার একতিয়ারপুর গ্রামের হাফেজ মোঃ মাহফুজুর রহমান। আর এই মাহেন্দ্রক্ষণকে তিনি উদযাপন করছেন আল্লাহর নিকট শুকরিয়া আদায়ের মাধ্যমে তাহাজ্জুদের নামাজে ১০ খতম কোরআন তেলাওয়াতের উদ্যোগ নিয়ে। ব্যতিক্রম এই ঘটনাটি ঘটেছে মাধবপুর উপজেলার শাহজীবাজার বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র মসজিদে।
হাফেজ মাহফুজুর রহমান স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমি ৭/৮ বৎসর বয়সেই হাফেজ হই। মাধবপুর উপজেলার হরষপুর মাদ্রাসায় হাফেজ নুরুজ্জামানের কাছে মাত্র ২ বছরে হিফজ শেষ করি। ওই সময়ে আমার মত এত কম বয়সে কেউ হাফেজ হতে পারেননি। ৫০ বছর পূর্বে শাহজিবাজার বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা খতমে তারাবি পড়াতে হাফেজ নিয়োগের জন্য আমি যে মাদ্রাসায় পড়ি সে মাদ্রাসায় আসেন। তখন আমিও সেখানে আবেদন করি। পরে প্রতিযোগিতা হলে আমার তেলাওয়াত শুনে সবাই আমাকে মনোনয়ন করেন তারাবি নামাজ পড়ানোর জন্য। মাত্র ৯ বছর বয়সে খতমে তারাবি পড়ানোর জন্য চলে আসি বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড মসজিদে। তখন জেলা শহরের কয়েকটি মসজিদেই শুধু খতমে তারাবি হতো। হাফেজের সংখ্যা খুব বেশী না থাকায় অনেক উপজেলা সদরেও খতমে তারাবি হত না। সেখানে বিচ্ছিন্ন এক এলাকায় খতমে তারাবি পড়ানো হবে শুনে আশ পাশের শাহজিবাজার গ্যাস ফিল্ড, রাবার বাগান, বনবিভাগ ও লাল চান্দ চা বাগানের কর্মকর্তারাও ছুটে আসেন এই মসজিদে। টিনের তৈরি মসজিদে মুসল্লীদের তিল ধারণের ঠাই থাকত না। এখন সেখানে হয়েছে পাকা বিল্ডিং। এসিরও ব্যবস্থা আছে। আমি যে বয়সে খতমে তারাবি পড়ানো শুরু করি তখন বয়স কম থাকায় নিয়মিত রোজা রাখাও সম্ভব হতো না। প্রথম বছর আমার তেলাওয়াত শুনে সবাই মুগ্ধ হন। পরে আর আমাকে কোন ইন্টারভিউ দিতে হয়নি। অনেক কর্মকর্তা আর কর্মচারী বদলী হয়েছেন। কিন্তু আমাকে কেউ পরিবর্তন করার কথা চিন্তা করেননি। বরং এক বছর তারাবি শেষ হওয়ার সাথে সাথেই পরের বছরের জন্য নিশ্চিত করা হত আমাকে। টানা ৫০ বছর সুস্থ থেকে তারাবি পড়ানো আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত। এই সময়ে আমাকে নিয়ে কেউ কোন কথাও বলেনি। একবার এক মুসল্লী আমার বদলে অন্য হাফেজ নিয়োগের কথা বললে সেখানে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। পরে ওই মুসল্লীকে এখান থেকে বদলী করা হয়েছিল।’
হাফেজ মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘একটানা ৪৮ বৎসর আমি একাই নামাজ পড়িয়েছি। এখনও একাই নামাজ পড়াতে সক্ষম। দুই বছর যাবত আমার সাথে আমার এক ছাত্রও নামাজ পড়াচ্ছে। টানা ৫০তম খতমে তারাবি পড়াতে গিয়ে অনেক মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে। অনেক বড় বড় কর্মকর্তা এখানে নামাজ পড়েছেন। আমাকে সবচেয়ে বেশী মুগ্ধ করে এই মসজিদে আমি তিন প্রজন্মকে তিলাওয়াত শুনাতে পেড়েছি। তাজুল ইসলাম নামে এক মুসল্লী শুরুর দিকে এখানে তারাবি পড়তেন। পরে তার ছেলে নজরুল ইসলামও এখানে নিয়মিত তারাবি পড়েন। এখন নজরুল ইসলামের ছেলে ফুয়াদও আসে তারাবিতে। তিন প্রজন্মকে মুসল্লি পাওয়া অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয়। এখানকার মানুষ ও মুসল্লিরা আমাকে অনেক সম্মান করে। তাই আমি বার বার এখানে চলে আসি তারাবির নামাজ পড়ানোর জন্য। যতদিন তারা আমাকে বলবে, আল্লাহ আমাকে সুস্থ রাখলে এই মসজিদেই তারাবি পড়াব। অনেক বড় বড় মসজিদে আমাকে তারাবি পড়ানোর জন্য আমন্ত্রণ জানালেও এই মসজিদের প্রতি যে মায়া তার জন্য আমি সকল আমন্ত্রণ বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করি। করোনা মহামারিতেও খতমে তারাবি অক্ষুন্ন রাখতে পারায় আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।’
হাফেজ মাহফুজুর রহমান মাধবপুর উপজেলার এনায়েতপুর গ্রামের মৃত মকসুদ আলী মোল্লার ছেলে। তার ৪ ছেলে ও ২ মেয়ে। সবাই লেখাপড়া করছেন। হাফেজ মাহফুজ আহমেদ ১৯৮২ সালে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সিলেট অঞ্চলের শ্রেষ্ট হাফেজ হন। ১৯৮৩ সালে জাতীয় পর্যায়েও পুরস্কৃত হন। যে মাদ্রাসা থেকে তিনি হাফেজ হয়েছেন সেই হরষপুর মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। এর পর মৌলভীবাজারের জামেয়া দ্বীনিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। পরে ঢাকার মনিপুরী পাড়া, নিকুঞ্জ ও যাত্রাবাড়ীতে বিভিন্ন মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। বর্তমানে তিনি ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নবীগনর দারুছুন্নাহ মাদ্রাসার হিফজ বিভাগের প্রধান হিসাবে কর্মরত আছেন।
হাফেজ মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘রমজান মাসে শুধু খতমে তারাবি পড়াই না। ৫০ বছর যাবত তাহাজ্জুদের নামাজে আরও তিন খতম করে খতম দিয়ে আসছি। এবার ৫০ বছরের শুকরিয়া আদায়ের জন্য তাহাজ্জুদে ১০ খতম দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। ইতোমধ্যে ৪ খতম শেষ হয়েছে। আল্লাহর রহমতে আমি কোন প্রস্তুতি ছাড়াই যে কোন মুহূর্তে এক বসায় নির্ভুলভাবে ৩০ পাড়া কোরআন মুখস্ত বলতে পারি। গত বছর রমজানের পূর্বে ৮ জন হাফেজের সামনে এক বসায় ৩০ পাড়া পড়েছি। কেউ কোন লুকমা দিতে পারেনি। বাংলাদেশে আমিই একমাত্র হাফেজ যে ওস্তাদের কাছে কোরআন শরীফের প্রথম আয়াত থেকে শেষ আয়াত শুনানোর পাশাপাশি শেষ আয়াত থেকে শুরু করে প্রথম আয়াত শুনাতে পেরেছি। যে কোন দিক থেকেই আমি কোরআন খতম করতে পারি। আমি হাফেজ হওয়ার পর শিক্ষকতায় এসে শতাধিক হাফেজ সৃষ্টি করতে পেরেছি। আমার হাত দিয়ে সৃষ্টি হওয়া অনেক হাফেজ আজ দেশ বিদেশে সুনামের সাথে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। কোরআনের খেদমতের মাধ্যমেই বাকী জীবন অতিবাহিত করতে চাই।’