(চার)
১৯৬৫ সালের পূর্বে কৃষিতে সার এবং কীটনাশকের ব্যবহার বলতে গেলে ছিলই না। বর্ষার পানি শুকিয়ে গেলে জমিতে বেড়ে উঠা জলজ উদ্ভিদ জমা করে পঁচিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে নিলেই হত। তখন ভরা বর্ষায় হাওরে নাব্যতা ছিল বেশি, উজান বা ভারত থেকে নেমে আসা পানির স্ফটিক স্বচ্ছতা ছিল মুগ্ধ করার মত। নৌকায় বসে স্বচ্ছ পানিতে মাছের চলাচল চোখে পড়ত। জৈষ্ঠের মাঝামাঝি বর্ষার নতুন বাড়ন্ত পানির দৃশ্য বিশেষ করে সবুজ শুকনা মাঠকে ডুবিয়ে প্রতিদিনকার পরিবর্তনের ব্যাপারটা ছিল অনেকটা প্রণীকুলের শৈশব কৈশোরের প্রতিনিয়ত রূপ পরিবর্তনের মতই। এ যেন জীবনের জোয়ার, যৌবনের জায়ার। কোথাও কাদা নেই, সবুজ মাঠ ঘাট একটু একটু করে তলিয়ে যাওয়া, বাড়ির পাশের সমতল ভূমিতে ক্রমশ কোমড়জল, পেটজল। দলবেঁধে স্বচ্ছ পানিতে কিশোর কিশোরীদের ধাপাধাপি, হুলিখেলা, লাইখেলা সেতো মনে ধরে রাখারই মত।
বাড়ন্ত পানিতে নতুন রঙ্গে রাঙ্গায়িত উচ্ছল মাছের বিশেষ করে গায়ে লম্বা লাল দাগের রংমাখা পুটি, কালো হলুদের আঁচর কাঁটা টেংরা, লেজে তারা খঁচিত গায়ে দাগকাটা তারা বাইন মাছের ছোটাছুটি, ঝাকবেঁধে টাকি ও শোল মাছের পোনার উপস্থিতি ছিল নজর কাড়ার মত। এসব মাছ ধরায় ছিল না কোন বাধা অথবা জানা কোন আইনকানুন। তিনজন মিলে দূর হাওরের সমতল হাটু পানিতে ‘হলঙ্গা’ টেনে ছোট কৈ, টাকি, পুটি, টংরা ধরা সেতো এক অনুপম দৃশ্য।
হলঙ্গা হল বাঁশের চিকন শলা দিয়ে তৈরি ফেলুনের আকারের, পাশের বাঁশ দুটো একজন পেছনে থেকে কাঁধে ধরতে হত, আর সামনে দুকোণা থেকে দুজন দূর থেকে লম্বা রশি ধরে দৌড়ে ঘাসের উপর দিয়ে টানতেন, হাটু পানি থেকে দৌঁড়ে ক্রমশ শুকনায় উঠে মাছ ঝাকায় ঢালা হত। মাত্র কয়েক টানেই ঝাকা ভরে যেত। আজ সেই ঘাসওয়ালা পতিত ভূমিও নেই, সেই মাছও নেই, নেই চোখে পড়ার মত ‘হলঙ্গা’ নামক মাছ ধরার সেই উপকরণ।
বর্ষা তথা আষাঢ়ে সমগ্র হাওর জলে ভরে যেত, মৌসুমি বায়ুও তখন যৌবনের দ্বারপ্রান্তে। জলজ ঘাস, ফুটকি, সিঙ্গারা, শাপলা এসব উদ্ভিদ গজানোর পূর্বে খোলা হাওরে শুধুই ঢেউয়ের খেলা। বোশেখে ধান তোলার কঠোর পরিশ্রম সহ পূর্ববৎ ছমাস পরিশ্রমের পর অবসর কৃষককুল খোলা হাওরে রঙিন পালের নৌকায় হাওর পাড়ি দিতেন ভাটিয়ালি গান ধরে।
প্রকৃতির কি অপরূপ মিল! তখন যেমন বর্ষার যৌবনকাল, মৌসুমি বায়ুরও ভরা যৌবনের প্রভাবে হাওরে যেন সমুদ্রের ঢেউ, বেড়ে উঠা বড় বড় মাছের জলখেলি তৎসঙ্গে মাঝি মাল্লার ঘরে উঠা নতুন ফসলের নতুন টাকায় নতুন জামা কাপড় পড়ে ধূলিহীন অমলিন অবয়বে যৌবনময় তৃপ্তি ও সুখ ভরা এক অকৃত্রিম হাসি।
পায়ে হাঁটার কষ্ট নেই, সময়ের নেই কোন অভাব, সন্তানের আবদার পূরণেও নেই কোন জড়তা, নেই দুষ্ট রাজনীতির প্রভাবে সম্প্রীতি ভঙ্গের কোনই সম্ভাবনা।
এ যেন একখানা ছোট্ট ভূখন্ডে ছোট ছোট অজপারাগাঁয়ের ছোট ছোট জনগোষ্ঠীর পরম সুখ শান্তি তৎসঙ্গে এক স্বর্গপুরিতে সার্বভৌম স্বাধীনতাকে উপভোগ করার বহমান এক স্বর্ণযুগ।
ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব
এমবিবিএস; এফসিপিএস
প্রাক্তন সিনিয়র কনসালটেন্ট
জাতীয় সংসদ সচিবালয়, ঢাকা।
আমি অজপাড়াগাঁয়ের কৃষকের ছেলে
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com