স্টাফ রিপোর্টার ॥ দৈনিক মানবকণ্ঠের প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক, ভাষা সৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের প্রবাসী সংগঠক, বাংলাদেশ সরকারের সাবেক উপদেষ্টা কবি জাকারিয়া চৌধুরী ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী জাকারিয়া চৌধুরী বৃহস্পতিবার (২৫ মার্চ) গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় রাজধানীর গ্রীণ লাইফ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করে তার ভাতিজা সাংবাদিক পাবেল খান চৌধুরী জানান, ঢাকার আনুষ্ঠানিকতা শেষ মরদেহ হবিগঞ্জ নিয়ে আসা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার বিকেলে ১ম জানাজা দৈনিক মানবকণ্ঠ কার্যালয়ে , রাত ১০টায় শহরের কোর্ট মসজিদে ২য় জানাজা এবং সর্বশেষ মরহুমের গ্রামের বাড়ি বানিয়াচং উপজেলার শতমুখায় শুক্রবার সকাল ১০টায় জানাজা শেষে তার দাদার কবরের পাশে দাফন করা হবে।
বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের অধিকারী জাকারিয়া চৌধুরীর গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার সুজাতপুর ইউনিয়নের শতমুখা চৌধুরী বাড়ি। তার বাবা ইয়াইয়া খান চৌধুরী ১৯৫৭ সালে কুষ্টিয়া ও ঢাকার প্রথম বাঙালি ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ও এমএনএ (মেম্বার অব ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লি) ছিলেন। বাবার চাকরির সুবাদে ১৯৩৩ সালের ১৮ নভেম্বর জাকারিয়া চৌধুরী ভারতের আসাম প্রদেশের শিবসাগরে জন্মগ্রহণ করেন।শিক্ষা জীবন শুরু মেঘালয়ের রাজধানী শিলং ও করিমগঞ্জে, তারপর সিলেটে। করিমগঞ্জের স্কুলে অধ্যায়নকালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় হন।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে ১৯৫৫ সালে অর্থনীতিতে সম্মান ডিগ্রী অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মিছিল করতে গিয়ে কারারুদ্ধ হন তিনি। এরপর ১৯৫৭ সালে লন্ডনে লিঙ্কনস্ ইন এ ‘বার-এট-ল’ পড়ার জন্য ভর্তি হন। ছাত্রাবস্থায় লন্ডনে ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন এবং পরবর্তীতে ১৯৬০ সালে সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ব বাংলা স্বাধীন করার পরিকল্পনায় ‘পূর্বসূরী’ নামে গোপন রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
জাকারিয়া চৌধুরী ১৯৬৮ সালে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার’ প্রতিবাদে লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাই কমিশন জবরদখলের নেতৃত্ব দেন ও প্রখ্যাত আইনজীবী ব্যারিস্টার স্যার টমাস উইলিয়াম কিউসিকে মামলা পরিচালনার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে প্রেরণ করেন। আইয়ুব শাহী পতনের পর ১৯৭০ সালে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পুনরায় লন্ডন যান এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক হিসেবে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চে অসহযোগ আন্দোলনের শুরুতে বঙ্গবন্ধু তাকে ব্যক্তিগত দূত হিসাবে লন্ডনে অবস্থান নিতে বলেন। তখন এয়ারপোর্টের কর্তৃত্ব পাকিস্তান বিমান বাহিনী নিয়ে নেয় এবং আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি নিরাপত্তা আরোপ করে। যেহেতু তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতিক হিসাবে পাকিস্তান সরকারের কাছে চিহ্নিত ছিলেন সেহেতু এয়ারপোর্ট দিয়ে লন্ডন যাওয়া সমীচীন মনে করেননি। তবে ২৫ মার্চের পৈচাশিক ঘটনার পর তিনি আত্মগোপনে থেকে ৩ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করতে ঢাকা ছেড়ে হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে চলে আসেন। অনেক বিদ্রোহী বাঙালি সেনারা তখন মেজর খালেদ মোশাররফের (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) নেতৃত্বে ঐ চা-বাগানে অবস্থানরত ছিল। বিদ্রোহী বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা বৈঠক করে তাকে লন্ডনে চলে গিয়ে ‘অর্থ’ ও ‘অস্ত্র’ সংগ্রহের দায়িত্ব অর্পন করেন। পরে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে লন্ডনে গিয়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত দূত পরিচয়েই সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য তখন বিলেতে মরহুম আজিজুল হক ভূঁইয়াকে আহবায়ক ও মরহুম বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে উপদেষ্টা করে যে সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হয় তিনি সেই সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে কার্যক্রম শুরু করেন এবং ‘বাংলাদেশ ফান্ড’ নামে অর্থ সংগ্রহের জন্য হেমব্রোজ ব্যাংকে একাউন্ট খোলেন। পরবর্তীতে সেই একাউন্ট ন্যাশনাল ওয়েস্ট মিনিস্টার ব্যাংকে স্থানান্তর করা হয়।
১৯৭১ সনের ২৫ মার্চে সেই নৃশংস পাকিস্তানী সামরিক হামলার প্রতিবাদে লন্ডনসহ বিলেতের বিভিন্ন শহরে প্রবাসী দেশবাসী কর্তৃক প্রতিবাদের ঝড় উঠে, গঠিত হয় একশন কমিটি। লক্ষ লক্ষ পাউন্ডের চাঁদা জমা হতে থাকে এই ফান্ডে। সংগৃহীত এই ফান্ডের টাকায় পৃথিবীব্যাপী প্রচার কার্য্য চালানো হয়। যুদ্ধের জন্য কেনা হয় রসদ ও সাজ-সরঞ্জাম এবং পরবর্তীতে যুদ্ধের পর উদ্বৃত্ত টাকা দান করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে। সব একশন কমিটিকে সমম্বয় ও কূটনৈতিক লবিংয়ের জন্য ‘বাংলাদেশ মিশন’ নাম দিয়ে ২৪ পেমব্রিজ গার্ডেন, লন্ডন ডব্লিউ-২ তে অফিস স্থাপন করা হয়। মিশনের প্রধান হিসাবে মরহুম বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী দায়িত্বরত ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালের ৯ মাস লন্ডন ছিল প্রতিবাদ ও প্রচারে মুখরিত। বিলেতের দেশপ্রেমিক জনগোষ্ঠীর ততপরতা ও ত্যাগের কারণেই আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যম আমাদের প্রতি বরাবর সহানুভূতিশীল ও সোচ্চার ছিল যা যুদ্ধ জয়ের জন্য অপরিহার্য্য। ১৯৭২ সালে তিনি ফের দেশে ফিরে আসেন। ১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সরকারের উপদেষ্টা পদে যোগ দেন। তিনি শ্রম মন্ত্রণালয়, জনশক্তি মন্ত্রণালয় ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন।
হাওর এলাকার বাসিন্দা হিসাবে জাকারিয়া চৌধুরীর প্রচেষ্টায় ১৯৭৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি এক অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান হাওর উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে যার নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড। জাকারিয়া খান চৌধুরী ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে হবিগঞ্জ-২ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এছাড়াও ১৯৯১ সালে বিএনপি থেকে ও ১২ জুন ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র হিসাবে অংশ নিয়ে পরাজিত হন। এরপর থেকে সক্রিয় রাজনীতিতে না থেকে লেখালেখিতে মনোযোগ ও মানবকন্ঠ পত্রিকা প্রকাশ করেন।
জাকারিয়া চৌধুরীর স্ত্রী দেশের প্রখ্যাত ভাস্কর শামীম শিকদার। তার ছেলে শান্তি চৌধুরী লন্ডনে ব্যারিস্টারী অধ্যয়নরত এবং মেয়ে জাকিয়া শামীম চৌধুরী সুইটিও মায়ের মত একজন ভাস্কর। জাকারিয়া খান চৌধুরীর ভাই মরহুম জাকির খান চৌধুরী ছিলেন এরশাদ সরকারের যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী।