মেয়েদের সঙ্গে আপত্তিকর ছবি-ভিডিও তুলে ফেসবুকে ভাইরাল করার ভয় দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা আদায়
স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রতারণার ফাঁদ পেতে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি প্রতারক চক্র। শুধু তাই নয়, প্রতারকদের শিকার হওয়া লোকজন তাদের নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকারও হচ্ছেন। প্রতারকরা বিকাশ কিংবা রকেটের মাধ্যমে টাকা নিয়ে সেই টাকা ক্যাশ আউট করে হবিগঞ্জ শহরে। ঢাকায় ডিবি পুলিশের অভিযানে এমন তথ্য বের হয়ে এসেছে।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৫টায় ঢাকার খিলগাঁও বনশ্রী এলাকার অনলাইন ব্যবসায়ী রনি আহমেদকে (২৯) মোবাইলে কল করেন এক নারী। রনি বিদেশ থেকে জুতা ও ব্যাগ আমদানি করে অনলাইনের মাধ্যমে বিক্রি করেন। ওই নারী তাকে ফোন করে একটি ব্যাগের অর্ডার দেন। অর্ডার গ্রহণ করে রনি ওই নারীকে পরের দিন ব্যাগ ডেলিভারি দেয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু ওই নারী ওইদিনই ডেলিভারির অনুরোধ করে তোড়জোড় শুরু করেন। ওইদিন সন্ধ্যার পর ব্যাগ ডেলিভারি দিতে খিলগাঁও তিলপাপাড়ার উত্তরণ ক্লাব সংলগ্ন ২০ নম্বর সড়কে যান রনি। তারপর ব্যাগ অর্ডারকারী ওই নারীর স্বামী পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি তাকে ৬ তলা বাড়ির নিচতলার ফ্ল্যাটের সামনে নিয়ে যায়।
সেখানে যাওয়া মাত্র হাজির হয় আরো কয়েকজন ব্যক্তি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা রনিকে টেনেহিঁচড়ে ওই ফ্ল্যাটের ভেতরে নিয়ে বেধড়ক পেটায়। ছিনিয়ে নেয়া হয় তার মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ, নগদ টাকা ও এটিএম কার্ড। ফ্ল্যাটের ভেতরে আগে থেকে কয়েকজন নারীও উপস্থিত ছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে হাজির হন ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ে আরো কয়েকজন ব্যক্তি। তারা অভিযোগ করেন অবৈধ কার্যকলাপ করার উদ্দেশেই রনি সেখানে গিয়েছেন। তারা রনি ও একজন তরুণীকে বস্ত্রহীন করে আপত্তিকর ছবি-ভিডিও ধারণ করে। সেই ছবি ও ভিডিও ভাইরাল করে দেয়ার হুমকি দেয়। ঘটনাস্থলে পুলিশের এসআই পরিচয় দিয়ে একজন হাজির হয়। পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হয়ে গেলে রনি বাধ্য হয়ে নগদ টাকার বিনিময়ে সেখান থেকে রেহাই পান।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তেজগাঁও বিভাগ সম্প্রতি এমন একটি প্রতারক চক্রকে গ্রেপ্তার করেছে যারা বিভিন্ন কৌশলে মানুষকে তাদের আস্তানায় নিয়ে প্রথমে মারধর করে। দেহপ্রসারিণী তরুণীদের সঙ্গে আপত্তিকর ছবি-ভিডিও তুলে সেগুলো ভাইরাল করার ভয় দেখিয়ে আদায় করে লাখ লাখ টাকা। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মানুষকে ফাঁদে ফেলে তারা বিকাশ বা রকেটের মাধ্যমে যে অর্থ আদায় করে সেই টাকা তারা ধরা পড়ার ভয়ে হবিগঞ্জ জেলা শহর থেকে ক্যাশআউট করে। প্রতারণা করে টাকা দিয়ে মুক্তি মিললেও মুখ না খোলার জন্য তারা ছবি ও ভিডিও তাদের কাছে রেখে দেয়। মুখ খুললে সেগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। এজন্য ভুক্তভোগী অনেকেই পরে আর মুখ খোলেন না। সূত্র জানিয়েছে, এই চক্রটি অন্তত ৭ বছর ধরে এভাবে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে যাচ্ছে। তাদের অভিনব প্রতারণার শিকার হয়েছে অন্তত কয়েকশ’ লোক। চক্রটির মূলহোতা পলাতক রয়েছে। তার বিরুদ্ধে ৫-৬টি প্রতারণার মামলা রয়েছে। সে মূলত চাহিদা অনুসারে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে টাকার বিনিময়ে তরুণীদের পাঠায়। তার অধীনে ১০-১২টি গ্রুপ কাজ করে। প্রতিটা গ্রুপে একজন ভুয়া পুলিশের এসআই নামধারী, একজন সাংবাদিক, ১ জন এলাকার বড় ভাই, কয়েকজন নারীসহ আরো কয়েকজন ব্যক্তি থাকে। একেক জনের ভূমিকা একেক রকম।
৮ই মার্চ ঢাকার খিলগাঁও থানায় ওই ব্যবসায়ীর অভিযোগের ভিত্তিতে ডিবির তেজগাঁও বিভাগ বনশ্রী থেকে ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- মো. বদিউজ্জামান শাহীন (৪০), মিজানুর রহমান (৪৫), মো. ফয়সাল আহমেদ (২৩), কামরুজ্জামান সোহেল (৩২), সাইফুল ইসলাম ইমরান (৩১) ও বিথি আক্তার সোমা (২৬)। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে ৫টি এটিএম কার্ড, পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার ইউনিফর্ম, বেল্ট ও ফিল্ড ক্যাপ উদ্ধার করা হয়েছে।
ডিবির তেজগাঁও ডিভিশনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অনলাইনে পণ্য কেনাকাটার কৌশলেই নয় আরো অনেক কৌশলে এ চক্র ভুক্তভোগীদের কৌশলে তাদের আস্তানায় নিয়ে যায়। এক্ষেত্রে টাকার বিনিময়ে নারীদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সময় কাটাতে গিয়ে বেশিরভাগ ব্যক্তিই ফাঁদে পড়েন। চক্রের সদস্যরা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে নিরাপদ ভবনে বেশি টাকার বিনিময়ে বাসা ভাড়া নেয়। খিলগাঁও, তিলপাপাড়া, বাসাবো, মাদারটেকসহ বিভিন্ন এলাকায় বাসা ভাড়া নেয়। একেকটি বাসা বেশিদিন ব্যবহার করা হয় না। প্রতারণা করে ধরা পড়ার ভয়ে ঘন ঘন বাসা পরিবর্তন করা হয়। ভাড়া করা বাসা থেকে এসকর্ট সার্ভিস দেয়া হয়। এজন্য প্রতিটা বাসায়ই কয়েকজন করে তরুণী থাকে। চক্রের কিছু সদস্য ক্লায়েন্ট ম্যানেজ করে। পরে সেই ক্লায়েন্ট যখন তাদের বাসায় এসে উপস্থিত হয় ঠিক তখনই তারা তাদের আসল রূপ দেখায়। ক্লায়েন্ট বাসায় প্রবেশ করা মাত্র কয়েকজন মিলে তাকে মারধর করে। বস্ত্রহীন করে তরুণীদের সঙ্গে ছবি তুলে। সেখানে এলাকার বড় ভাই নামধারী প্রতারক এসে হাজির হয়। তার এলাকায় এরকম কার্যকলাপ হচ্ছে সেটা মেনে নেয়া হবে না বলে দমক দেয়। তারপর একজন সাংবাদিক এসে ঘটনা পত্রিকায় ছাপানো ও সর্বশেষ পুলিশের এসআই পরিচয় দিয়ে আরেকজন এসে মামলা দিয়ে জেলে পাঠানোর হুমকি দেয়। এক পর্যায়ে মীমাংসা করতে দাবি করা হয় মোটা অঙ্কের টাকা। চাহিদামতো টাকা দিলে মুক্তি মেলে। না হলেও দিনের পর দিন আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। এই চক্রের ফাঁদ থেকে সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, শিক্ষার্থীরা রেহাই পাননি। অর্থ আদায় করা যাবে এমন সম্ভাব্য লোকদের কাছ থেকে তারা একই কায়দায় অর্থ আদায় করতো।
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী রনি আহমেদ বলেন, এক নারী আমাকে অনলাইন থেকে নম্বর নিয়ে ফোন করে ব্যাগ অর্ডার করেন। সেই ব্যাগ ডেলিভারি দেয়াই আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওই ফ্ল্যাটে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে আমার কাছে থাকা নগদ চার হাজার টাকাসহ, মোবাইল, মানিব্যাগ, ব্যাংকের কার্ড ছিনিয়ে নেয় তারা। তরুণীর সঙ্গে জোরপূর্বক অন্তরঙ্গ ছবি-ভিডিও করে। অসৎ উদ্দেশে তারা এরকম করছে সেটা আমি ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেই বুঝতে পেরেছিলাম। বিভিন্ন সময়ে আসা বড় ভাই, সাংবাদিক ও পুলিশ পরিচয়ে দিয়ে আসা ব্যক্তিরা চক্রের সদস্য সেটিও বুঝতে পারছিলাম। তারা আমার পরিবার পরিজনকে এখানে এনে আমাকে অপমানিত করা ও ভিডিও ছবি বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখায়। তাই নিজেকে বাঁচাতে ও মান সম্মান ধরে রাখার জন্য তাদের চাহিদামতো আমার এটিএম কার্ডের পিন নম্বর দিতে বাধ্য হই। বুথ থেকে তারা প্রথমে ৪৫ হাজার এবং মোবাইল ব্যাংকিং রকেট থেকে ২৫ হাজার টাকা তোলে। তারপর তারা আমাকে বাইরে থেকে ছিটকিনি আটকিয়ে রেখে চলে যায়। জানালার পাশে রাস্তা হওয়াতে অপরিচিত এক লোকের মাধ্যমে আমি পালিয়ে আসি। পালিয়ে আসার পরও রেহাই পাইনি। অপরিচিত মোবাইল নম্বর থেকে পুলিশ পরিচয় দিয়ে তাদের একজন আমার কাছে ৩০ হাজার টাকা চায়। টাকা না দিলে তারা আমাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে আসবে বলে জানায়। পরে আমি তাদেরকে রকেটের মাধ্যমে আরো ২০ হাজার টাকা দেই।
ডিবি’র তেজগাঁও বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. বায়েজীদুর রহমান বলেন, চক্রের মূল হোতা একজন পলাতক। মূলত তার নির্দেশেই ১০ থেকে ১২টি গ্রুপ কাজ করে। রনি নামের ওই ব্যবসায়ীর করা মামলার সূত্র ধরে আমরা মোট দু’টি গ্রুপকে গ্রেপ্তার করেছি। তারা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে বিভিন্নভাবে ফাঁদে ফেলে নির্যাতন করে অর্থ আদায় করতো। চক্রের সাইফুল নামে এক সদস্য প্রতারণার মাধ্যমে আদায়কৃত অর্থ হবিগঞ্জ থেকে ক্যাশআউট করে। তার একটি এজেন্ট ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট আছে। প্রতারণার লেনেদেনে সেটি ব্যবহার করা হয়। ঢাকা থেকে পাঠানো টাকা হবিগঞ্জে ক্যাশআউট করে আবার ঢাকায় পাঠানো হয়। তিনি বলেন, এটি তাদের একটি কৌশল। কারণ প্রতারণার লেনদেন ও ক্যাশআউটের সূত্র ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অনেক সময় প্রতারককে গ্রেপ্তার করে। তাই তারা ঢাকার বাইরে একটি জায়গা থেকে ক্যাশআউট করে। অপরাধ আড়াল করতেই এমন কৌশলে তারা কাজ করতো।
ডিবির তেজগাঁও ডিভিশনের উপ-পুলিশ কমিশনার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে এ ধরনের প্রতারণা হচ্ছে বলে আমাদের কাছে অভিযোগ আসছিল। তদন্ত করে আমরা অভিযোগের সত্যতা পাই। পরে আমরা দু’টি চক্রকে গ্রেপ্তার করেছি। আরো বেশকিছু চক্রের সন্ধান পেয়েছি। তাদেরকে গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে। এছাড়া যে দুই চক্রকে গ্রেপ্তার করেছি তাদের মূল হোতাসহ অনেকে পলাতক রয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। সূত্র: মানবজমিন
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com