বাস্তবতা
ডাঃ মোঃ আখতার উদ্দিন মুরাদ

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি শহর, অনেক স্মৃতি বিজড়িত মায়ের সাথে বেড়ানো ছোটবেলায় সেই দিনগুলি, বড় খালার বাসা, অন্নদা স্কুলের বোডিং মাঠ, তার পুকুরে গোসল করা, টেংকের পাড়ে ঘুরে বেড়ানো আরও কত স্মৃতি সবই আজ স্মৃতি কাতুরে মনটায় ভেসে উঠে। গত ২৮ জানুয়ারি পারিবারিক কাজে যেতে হয়েছে। শহরটা দেখে আমার ছোটবেলার শহরের সাথে মিলাতে পারছিলাম না। দেখে মনে হল শহর না এলোমেলো জঞ্জালপূর্ণ একটা শহর। কিছু দিন আগে আমার এক ছোট ভাইয়ের স্ত্রী বলছিল “ভাইয়া বাসায় হা করলে মুখে মশা ঢুকে, দিনের বেলায় মশারী টানায়ে শুতে হয়।” আমি বেশী কিছু না বলে চুপ করে ওর কথা শুনে গেলাম। নিজেও যে এসব কাজ করি না তা কিন্তু নয়। সন্ধ্যা হলে মশারীর ভিতরে বসে মোটামুটি লেখাপড়ার কাজ করি। ইদানীং দেখি মশা গুলি বেশ স্বাস্থ্যবান, এরা এত খাবার কোথায় পায় আল্লাহ মালুম। ঢাকা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌছাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। আমার যেতে হবে রেল লাইন পাড় হয়ে, শহরে ঢুকে মনটা খারাপ হয়ে গেল রাস্তাঘাট আগের মতই, ড্রেনগুলিতে পানি জমে শেওলা পড়ে আছে, মশার বাচ্চাগুলি কিলবিল কিলবিল করছে। টিএ রোড ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি ঐতিহ্যবাহী রোড, ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র, এখন ওখানে তৈরী করা হয়েছে ওভারপাস রেল ক্রসিং এর জ্যাম থেকে বাঁচাতে। কিন্তু একি শহরের প্রাণকেন্দ্রে এতবড় ওভারপাস পুরো স্থানটা একেবারে নিঃশেষ করে দেয়া হয়েছে, পরিকল্পনা বটে। শহর পরিকল্পনা করা একটা শিল্প, ভেনিস নগরী এত শতাব্দী পরেও তার যৌবন হারায় নাই কারণ ভেনিসের পূর্ব পুরুষেরা সুন্দরভাবে শহরটি সাজানোতে আজ আমরা নিজের অর্থ খরচ করে ভেনিস দেখতে যাই। নয়ন ভরে উপভোগ করি। যাক একথা। পারিবারিক কাজ শেষে ছোট মামা, খালাতো ভাইদের বাসা থেকে বিদায় নিলাম তখন রাত ৮.৩০ মিনিট। যানজটপূর্ণ রাস্তা শেষে বিশ্বরোডের মোড়ে আসতে আমার প্রায় একঘণ্টা লাগলো। রাস্তার আর্বজনা টমটম, বাস, ব্যাটারি চালিত রিক্সা, আন্তঃজেলার ট্রাক সব মিলে একাকার। এই টমটম কোন একটা সময় আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে একথা হলফ করে বলতে পারি। এগুলির না আছে গিয়ার না আছে সেইফটি মেজ্যার, আমার জানা বেশ কটি দূর্ঘটনা টমটমের জন্য এবং প্রত্যেকটাতে মাথায় আঘাত দুএকজনের বোর হোল করে মাথার ভিতর থেকে জমাট রক্তও বের করা হয়েছে। আমাদের দেশে রাস্তা বিজ্ঞান সম্মত কিনা বলতে চাই না, তবে রাস্তাগুলিতে প্রকৌশলীদের মেধা কাজে লাগানো হয়েছে কিনা আমার সন্দেহ আছে। তার একটা প্রমাণ দেই হাইওয়ের পাশ থেকে যে রাস্তা হাইওয়েতে যুক্ত হয়েছে তার প্রায়টিই সংগতিহীন, প্রায় প্রত্যেকটা সরাসরি নব্বুই ডিগ্রীতে এনে যুক্ত করে দেয়া হয়েছে এটা যে কত বড় ভুল তা বলার অপেক্ষা রাখে না, তারপর রাস্তায় স্পীডব্রেকার এটা আরও একটা বিপদজনক। নেই কোন টারমার্ক। আবার এই স্পীডব্রেকার থেকে বাঁচার জন্য গাড়ী গুলিকে বিভিন্ন পন্থায় মাটি থেকে উচু করা হয়, একটা গাড়ী যখন ডিজাইন করা হয় তখন অনেক কিছু হিসাব নিকাশ করে করা হয়। গাড়ি যখনই উচ্চ গতি নিয়ে চলতে থাকে তখনই এসব জটিল বিষয়গুলি কাজ করতে থাকে। যেমন একটা গাড়ি আশি কিলোমিটারে চল্লে তার উপর বাতাসের চাপ থাকে তা গাড়িটাকে রাস্তায় স্থির রাখতে সাহায্য করে এখন আমি যদি গাড়িটাকে উচু করে দেই তাহলে গাড়ি যখন উচ্চগতিতে চলে তখন বাতাস প্রচন্ড বেগে গাড়ির ছাদে এবং গাড়ির নিচ দিয়েও প্রচন্ড গতিতে যেতে থাকে এতে করে পুরো গাড়িটা শূন্যে ভাসতে থাকে এই অবস্থায় যদি সামান্য আঘাত লাগে তাতেই গাড়ি তার নিজের স্থিতি হারিয়ে দূর্ঘটনার শিকার হয়। গাড়ি, টমটম, ব্যাটারী রিক্সা এসব তৈরী করা যদি এতই সহজ হত তাহলে জাপান, কোরিয়া জার্মানরা না খেয়ে আমাদের দেশে এসে কাজের জন্য রিক্সা গ্যারেজে ভিড় জমাতো। যাক কুট্টাপাড়া পার হওয়ার পর যা মনে হল বের হওয়াটা ঠিক হয় নাই, মুরুব্বীদের কথা শুনা উচিত ছিল, ছোট মামী নাকি মামার সাথে ঝগড়া শুরু দিছিলো “ওরে তুমি কেন ছাড়লা” আসলে আমি চিন্তা করলাম এখন যতটুকু কুয়াশা পড়েছে সকালে আরো বেশী কুয়াশা পড়বে। আর রাতে বাস ট্রাকের ধাক্কায় কুয়াশা কিছুটা হালকা থাকবে, তিতাসের ব্রীজ পার হওয়ার পর রাস্তা আর দেখা যাচ্ছে না। আমি ড্রাইভারকে বল্লাম টারমার্ক দেখে চলতে, টারমার্ক কিছু জায়গায় আছে বটে তবে আমার মত বুড়ো হয়ে গেছে। উপায় না দেখে গাড়ি রাস্তার একেবারে কিনারে এনে আস্তে চলতে লাগলাম। এরমাঝে আর এক জ্বালা বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়ি গুলির হেড লাইট, এইটা যে কি অসহ্য ও বিরক্তিকর তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। গাড়ি স্টার্ট দেয়ার পর থেকে যে হেডলাইট হায় ভীমে দেয়া হয় তা আর লো ভীমে আনার ইচ্ছা উনাদের থাকে না। এসব অসতর্কতা কতটুকু বিপদজনক একটু দেখুন। হবিগঞ্জ থেকে বিকালে ঢাকা ফিরছি, ভৈরব পার হবার পর একটা সাদা প্রিমিও গাড়ি আমার গাড়িকে বা পাশ দিয়ে পাস করে সজোরে চলে গেল। আমি ড্রাইভারকে জিগ্যেস করলাম তুমি বুঝতে পারছিলে ও যে তোমার বা পাশ দিয়ে পাস করবে, ও বল্ল স্যার আমাদের গাড়ির মাঝখানে যখন আসছে তখন বুঝলাম, যাক সেই গাড়ি চলে গেল, আমরা আমাদের হিসাবে চলতে থাকলাম। বেলাবোতে এসে দেখি বেশ একটা জটলা, কি ব্যাপার রাস্তা এসব জটলায় গাড়ি থামানো নিষেধ তারপর ইচ্ছে হল একটু দেখি, ড্রাইভার জোরে জোরে বলছে স্যার ঐ গাড়িটা স্যার ঐ গাড়িটা। চোখ খুলে দেখি পুরো গাড়িটার ডান পাশের অর্ধেকটা কেটে পিছনে চলে গেছে, এরপাশে সিলেটে যাওয়ার একটা বাস সামনের অংশ দেবে গেছে, বা পাশে একটা ট্রাক দাঁড়ানো। যা বুঝলাম বাস ট্রাককে ওভারটেক করতে গিয়ে কারটাকে এভাবে আঘাত করেছে, কারটি ওভারস্পীডে থাকাতে সে নিজের ভারসাম্য হারিয়ে এখন এ অবস্থা। যাত্রীদের চার জন মৃত ড্রাইভার স্পট ডেড। বেসামাল চল্লে যা হয়। পরবর্তীতে এই দূর্ঘটনা জাতীয় টেলিভিশনেও এসেছে। যাক সারা রাস্তা এরকম করে প্রায় মধ্য রাতে মেয়ের উৎকণ্ঠিত ফোন, মামার ঘন ঘন জিজ্ঞেসা বোনের অপেক্ষা নিয়ে কোন রকমে আমার প্রিয় শহর হবিগঞ্জে নিজ বাসায় পৌঁছালাম।

ডাঃ মোঃ আখতার উদ্দিন মুরাদ
আখতার মেডিক্যাল, চিড়াখানা রোড, শায়েস্তানগর, হবিগঞ্জ।
ফোন- ০১৭১১১৭১৪০৫