জালাল আহমেদ
তৎকালীন ত্রাণ সচিবকে জেলা প্রশাসক বললেন স্যার আপনাকে শুনলাম আমি ম্যাজিস্ট্রেটকে শুনি তারপর ব্যবস্থা নিব
১৯৮৮ এর ফেব্রুয়ারি মাসে ১৯৮৫ ব্যাচের ১০ জন অফিসার চাঁদপুরে যোগদান করেন। তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করা হয় গুয়াখোলা রোডে একটা পরিত্যক্ত বাড়িতে। তাঁরা ছিলেন জিয়াউদ্দিন আহমদ, মোঃ আবদুল হামিদ, মোঃ কামাল উদ্দিন তালুকদার, আবুল কালাম আজাদ, শাহনুন নেছা, একেএম আমিনুল ইসলাম, সাইফুর রহমান, বিশ্বনাথ বণিক, মোঃ মোজাম্মেল হক খান এবং মোঃ বিল্লাল হোসেন। তার পাশেই অনুরূপ আরেকটি বাড়িতে থাকতেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এএমএম ফরহাদ। তাঁর ভাই জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ আসম ফিরোজ সকলের পরিচিত। তাঁর আরেক ভাইয়ের স্ত্রী ছিলেন ১৯৮২ বিশেষ ব্যাচের সুরাইয়া খান রেজা, একসময় ধানমন্ডিতে আমার প্রতিবেশী। এই ১০ জন অফিসার সরাসরি আমার তত্ত্বাবধানে বেশ কিছু সংযুক্তি প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করেন ফলে তাঁদের সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক স্থাপিত হয় তা এই ৩২ বছর পরেও অনেকের সংগেই বিদ্যমান। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী জিয়াউদ্দিন আহমদ, শাহনুন নেছা পলি, কামাল উদ্দিন তালুকদার উল্লেখযোগ্য। আরও দু’জন ১৯৭৩ ব্যাচের কর্মকর্তার কথা মনে পড়ে, বিশেষ করে এডিএম জসিমউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ছিলেন অত্যন্ত ভালো একজন আইন জানা কর্মকর্তা। তিনি ভালো টেনিসও খেলতেন, পরে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ছিলেন, অকাল প্রয়াত। আরেকজন এডিসি অচ্যুতপদ গোস্বামী, পরে জেলা প্রশাসক জামালপুর ছিলেন।
আবার এসএসসি পরীক্ষার সময় এসে গেলো। জেলা প্রশাসক মহোদয় সারা জেলাতেই নকলমুক্ত পরীক্ষা গ্রহনের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিলেন। চাঁদপুরে হাজীগঞ্জ উপজেলা যেমন উন্নত ছিল, অগ্রসর ছিল তেমনি হাজীগঞ্জ টিমও ছিল খুব শক্তিশালী। আমার ব্যাচমেট নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা ছিল সার্কেল এএসপি। বন্ধু চৌধুরী মুনীর উদ্দিন মাহফুজ উপজেলা মুন্সেফ, ১৯৮২ বিশেষ ব্যাচের আব্দুর রউফ চৌধুরী ছিলেন উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট। ইউএনও ছিলেন অত্যন্ত সাহসী মেধাবী অফিসার ১৯৮১ ব্যাচের শাহাবউল্লাহ। ফলে সারা জেলাতেই একটু ভালো পরিবেশে পরীক্ষা হচ্ছিল। আমার নির্দিষ্ট কোন ডিউটি ছিল না কারণ তখন ৮৪ ব্যাচ ও ৮৫ ব্যাচ মিলিয়ে ২০ জন অফিসার। চাঁদপুর জেলা সদরে প্রধান সড়কে গনি হাই স্কুল মেয়েদের কেন্দ্রে দায়িত্বে ছিলেন ৮৫ ব্যাচের শাহনুন নেসা। একদিন সংবাদ এল যে পরীক্ষায় নকল বিরোধী কঠোর ভূমিকা নেবার কারণে তাঁকে সেন্টারে ঘেরাও করে রাখা হয়েছে এবং সেন্টারে ইট পাটকেল ছোঁড়া হচ্ছে। আমি শুনে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) কে জানালাম, তিনি আমাকে যেতে বললেন। আমি নিজে একটা গাড়ি চালিয়ে চলে গেলাম সেন্টারে, লোকজন সরে গিয়ে রাস্তা করে দিল। গাড়ি রেখে স্কুলের ভেতরে গেলাম, ম্যাজিস্ট্রেট শাহনুনকে নিয়ে বের হয়ে এলাম, তাঁকে ফ্রন্ট সিটে বসিয়ে গাড়ি চালিয়ে বের হয়ে আসলাম। লোকজন কৌতূহলী, উঁকি ঝুঁকি মারছে, কিন্তু বাঁধা দিল না।
রাতে জেলা প্রশাসকের বাসভবনের অফিসে ছিলাম, জেলা প্রশাসক মহোদয় এডিএম সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন ঘটনার বিষয়ে তাঁকে জানানো হল না কেন? বললেন যে পরদিন যেন আমরা দু’জনেই সেন্টারে যাই। এডিএম সাহেব আমাকে বললেন যে আমি যেন সকালে আগে চলে যাই, তিনি যাবেন পরে। পরদিন সকালে আমি শাহনুন নেছাসহ পরীক্ষা শুরুর আগেই চলে যাই। সবাইকে নকল করার বা অসদুপায় অবলম্বন না করতে সতর্ক করে দেই। পরীক্ষা শুরু’র পর দ্বিতীয় ঘন্টায় এক রুমে গিয়ে মেয়েদের কয়েকজনকে খাতা শেয়ার করতে দেখি এবং তাদের খাতা নিয়ে নেয়া হয়। এছাড়া শান্তিপূর্ণ ভাবেই পরীক্ষা চলছিল। পরীক্ষার পর আমি ফিরে এসে ডাকবাংলোতে লাঞ্চ করছিলাম তখন বাংলোর কেয়ারটেকার প্রকাশ এসে বললো প্রধানমন্ত্রী মিজান চৌধুরী’র বোনের জামাই আসছে দেখা করতে। আমি বললাম যে তুমি জানো যে আমি কারো সংগে বাংলোতে দেখা করি না, বলতে আসছো কেনো। দেখা হল না। আমি খেয়ে অফিসে এসে দেখি আমার রুমে একজন সাদা দাঁড়িওয়ালা লোক একটা মেয়েকে নিয়া বসা। আমি বসতে পরিচয় দিলেন যে তিনি প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীর বোন জামাই। তাঁর ছেলে আবু তাহের দুলাল তখন জাতীয় যুব সংহতি, চাঁদপুর জেলা আহবায়ক। তিনি বললেন যে তাঁর মেয়ে কিছু করেনি তবুও ম্যাজিস্ট্রেট খাতা নিয়ে নিয়েছে। আমি বললাম, কোন ম্যাজিস্ট্রেট? তিনি বললেন যে আপনি। আমি বললাম আমি করে থাকলে কি করেছি, কেন করেছি তা আমি জানি। আর আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকলে আপনি জেলা প্রশাসককে জানাতে পারেন।
এদিকে শহরে গুজব যে প্রধানমন্ত্রী এটা খুব সিরিয়াসলি নিয়েছেন এবং কেউ বলে আমি সাসপেন্ড হব, কেউ বলে বদলী। আমি বললাম আমি তো আসছি পানছড়ি থেকে, দিবে না হয় মনপুরা! উনারা আমার রুম থেকে বের হয়ে জেলা প্রশাসকের বাংলো অফিসে গেলেন। এই বিষয়ে পরবর্তীতে আমি আর কিছু শুনিনি। এটাও জেলা প্রশাসক মহোদয় তাঁর নিজের মত করে সামলেছেন। আমি একবার মাত্র এ ধরণের বিষয়ে জেলা প্রশাসকের সামনে ছিলাম। তখন আমি উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট, ফরিদগঞ্জ। কেয়ার এর সংগে একটা বিষয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয় এবং আমার নির্দেশেই ফরিদগঞ্জ থানা পুলিশ কেয়ার এর তিনজনকে এরেস্ট করে হাজতে রাখে। আমি চাঁদপুরে, জেলা প্রশাসক এর সামনে বসা, তৎকালীন ত্রাণ সচিব, ফোন করেন জেলা প্রশাসককে। তিনি তাঁর কথা বলছেন, জেলা প্রশাসক বললেন স্যার, আপনাকে শুনলাম আমি ম্যাজিস্ট্রেটকে শুনি তারপর এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিব। তিনি আমাকে শুনলেন, লোকগুলোকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা নিলেন কিন্তু ঘটনার প্রেক্ষিত বুঝে আমাকে তেমন কিছু বললেন না। এস এম শামসুল আলম অত্যন্ত সক্ষম এবং ট্যাক্টফুল ফিল্ড অফিসার ছিলেন।
এই সময়েই ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে আমার অন্য একটি অভিজ্ঞতা হয়। চাঁদপুর সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সহ সভাপতি কলেজ প্রাঙ্গণে ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হয়। তাকে জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসে। ডাক্তাররা তার জীবনাশংকা প্রকাশ করায় পুলিশ ডাইং ডিক্লারেশন বা মৃত্যুকালীন জবানবন্দীর আবেদন করলে আমাকে এ কাজে ন্যাস্ত করা হয়। তখন অপারেশন থিয়েটারে বসে গুরুতর আহত এই ছাত্রনেতার মৃত্যুকালীন জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করি। যদিও সে পরবর্তীতে সুস্থ হয়ে গেছে। এখন ধানমন্ডিতে থাকে, আর্থিক ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং সর্বশেষ ২০১৭ সালে অর্থ বিভাগে আমার সঙ্গে দেখা করে গিয়েছে।