জালাল আহমেদ
ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে এইচএসসি পরীক্ষার ডিউটিকালে নকল ঠেকাতে

যত রকম পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব তাই নিয়েছি

১৯৮৬ সালের মে মাসে আমার চাঁদপুরের দিনরাত্রি শুরু হল। ডাকবাংলোতে থাকি, রুম বদলে নীচে ১০২ নাম্বার রুমে, ’৮১ ব্যাচের মোঃ শাহাবউল্লাহ পরিবার নিয়ে কিচেনসহ একপাশে থাকেন। আমার পাশের রুমে ১৯৮২ বিশেষ ব্যাচের বদরুদ্দোজা পারভেজ। কিছুদিনের মধ্যে বদরুদ্দোজা’র রুমে তাসের আড্ডা জমে উঠলো। সে নিজে গিটার বাদক, টুং টাং গিটার বাজায়, ইলেকশন অফিসার মুজিবর, স্পোর্টস অফিসার নাসির, লেকচারার হেলাল আরো কেউ কেউ প্রতিদিনই আসেন। আমার কোন পদায়ন নাই, কোন দায়িত্ব নাই, সকাল ১০টায় অফিসে যাই ৫টায় ফিরি। তখন এইচএসসি পরীক্ষা চলছিল। আমাকে দিয়ে দেয়া হল পরীক্ষার ডিউটি, চাঁদপুর মহিলা কলেজে। অন্যকোন কাজ যেহেতু নাই, মন দিয়ে মহিলা কলেজে পরীক্ষার ডিউটি করি। ১৯৬২ সালে চাঁদপুর মহিলা কলেজ স্থাপন করেন তৎকালীন এসডিও, মুক্তিযুদ্ধকালে পাবনার জেলা প্রশাসক, মুক্তিযুদ্ধে পাবনা যুদ্ধের বীরযোদ্ধা, নুরুল কাদের খান সিএসপি, বাংলাদেশের প্রথম সংস্থাপন সচিব (এখন জনপ্রশাসন)। বাই নেচার আমি নকল বিরোধী ফলে যাদের একটু খায়েশ ছিল নকল করার তাদের স্বভাবতই মন খারাপ কারণ যত রকম পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব তাই নিচ্ছিলাম নকল ঠেকাতে। তবে কলেজটা ভালো ছিল, কলেজ অধ্যক্ষ মতিউর রহমানও ছিলেন সহযোগী। শুরুতেই তার সঙ্গে একটা ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়। ফলে এটাও দায়িত্ব পালনে সহায়ক হয়।
ব্যচেলর ম্যাজিস্ট্রেট, বয়স তখন ২৫, টেনিস খেলে আর মিনিমোক নামে পিচ্চি এক গাড়ি নিজে চালিয়ে ছোট্ট এই শহরে দ্রুত পরিচিতি লাভ করলাম। কিছুদিন পর মহিলা কলেজের আরেক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গেলাম। চাঁদপুর মহিলা কলেজের কোন হোস্টেল ছিল না আর হোস্টেলের নামে বাণিজ্যিক এলাকায় যা ছিল তা আসলে বসবাসের অনুপযোগী এক আবাস। কলেজের পাশেই আনসার ক্লাব নামে একটি স্থাপনা ছিল, অনেক বড় এক প্লটের এক পাশে একটি পুরনো দোতলা ভবন। সেখানে আনসাররা বসবাস করতো। তাদেরকে অন্য একটি দোতলা বড় ভবন দেয়া হয়েছিল শহরের মূল এলাকা থেকে একটু দূরে, তারা যাচ্ছিল না। তাদের উচ্ছেদ করার দায়িত্ব দেয়া হল আমাকে। যথাযথ ভাবে তাদের উচ্ছেদ করা হল, তারাও নতুন বরাদ্দকৃত ভবনে চলে গেল। এই ভবনে কলেজের মেয়েরা শিফট করলো। একটা ছোট পকেট গেট দিয়েই এখন তারা কলেজে আসতে পারতো। তাদের ছেড়ে আসা ভবনে স্থাপন করা হল চাঁদপুর ডায়াবেটিক সমিতি। ১০ দিন পরে বেতনের প্রশ্ন, জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসার ছোট্ট একটা প্রশ্ন তুলে বেতনও দিয়ে দিলেন।
চাঁদপুরে তখন জেলা প্রশাসক এস এম শামসুল আলম, বাড়ি বগুড়া। আমি আগে বলেছি আমার দেখা একজন সেরা ফিল্ড অফিসার ছিলেন তিনি, ১৯৭০ ব্যাচের ইপিসিএস, তখন পর্যন্ত ঢাকায় চাকুরী করেন নাই। পরে একবার আমার ভূমি মন্ত্রণালয়ে পোস্টিং হলেও আসতে দেননি। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ছিলেন আতিকুল ইসলাম চৌধুরী যিনি পরে ফরিদপুর ও বান্দরবানে জেলা প্রশাসক ছিলেন। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ছিলেন মোঃ আফজাল হোসেইন যিনি পরে রংপুর ও সিলেট এর জেলা প্রশাসক ছিলেন। এছাড়া ট্রাইং ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন ১৯৮১ ব্যাচের মোঃ শাহাবউল্লাহ। অসাধারণ মেধাবী অফিসার, পরে সরকারের সচিব মর্যাদা পান, এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন এবং ভিয়েতনামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। এছাড়া ১৯৮২ বিশেষ ব্যাচের এ এম বদরুদ্দোজা ছিলেন সহকারী পরিচালক, স্থানীয় সরকার আর লিয়াকত আলী ছিলেন সদর উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট। এনডিসি ছিলেন সাবেক ইলেকশন অফিসার হুমায়ুন কবির। ১৯৮৪ ব্যাচের অফিসাররা যোগদান করেছিলেন জানুয়ারী ১৯৮৬ তে, তাঁরা ১০ জন ছিলেন চাঁদপুরে। আতাউল হক, আতোয়ার রহমান, আবু সাদেক মোঃ আতাহার, মোঃ শহীদ উল্লা খন্দকার, মোঃ ফয়জুর রহমান, মানিক চন্দ্র দে, মোঃ মিজানুর রহমান, নলিনী রঞ্জন বসাক, মোঃ মশিউর রহমান ও অন্য একজন। তখন ফরিদগঞ্জে উপজেলা ম্যজিস্ট্রেট ছিলেন আবদুল বারেক, আদালত পরিচালনায় তাঁর দক্ষতার সুনাম ছিল না। তিনি ছিলেন প্রাক্তন সিও, ১৯৮২ সালে পদোন্নতি পাওয়ায় আমাদের সিনিয়র এবং সিও হবার আগে ছিলেন পুলিশের দারোগা। তিনি হরদম ফরিদগঞ্জ বাড়ি, তৎকালীন মন্ত্রী মওলানা আবদুল মান্নানের প্রভাব এর কথাও বলতেন । এ কারণেই বিভাগীয় কমিশনার তাঁকে সরাতে চেয়েছিলেন।
আমরা যেমন শিক্ষানবীশ হিসেবে পুরো দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেছি তাঁদের ভাগ্যে তা ছিল না। তাঁরা শিক্ষানবীশ কর্মকর্তা হিসেবেই শাখা প্রশিক্ষণ, সংযুক্তি, তদন্ত ও কেস এনোটেশনের মত কাজ করেছেন। জুলাই মাসে কমিশনার অফিস থেকে জেনারেল সার্টিফিকেট অফিসার (জিসিও) হিসেবে আমার পদায়নের আদেশ আসে। জেনারেল সার্টিফিকেট অফিসারের কাজ ছিল পাবলিক ডিমান্ড রিকভারী এক্ট ১৯১৩ অনুযায়ী সার্টিফিকেট কেসের মাধমে সরকারি পাওনাদি আদায় করা। তখন বিভাগীয় কমিশনার অফিস থেকে উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট, নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (এনডিসি) ও জিসিও পদায়ন করা হত। এর সঙ্গে সঙ্গে জেলা প্রশাসক মহোদয় আমাকে রাজস্ব শাখা অর্থাৎ রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি)’র দায়িত্ব ও প্রদান করেন। উল্লেখ্য সহকারী কমিশনার পর্যায়ে এই কালেক্টরেটেও আমি জেষ্ঠ্যতম ছিলাম। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজস্ব প্রশাসনের বিধি বিধান বাংলাদেশের অন্য অংশ থেকে ভিন্ন ছিল। ফলে চাঁদপুরে নতুন করে সব শিখতে হচ্ছিল এবং এই ক্ষেত্রে দ্রুত শিখার কোন বিকল্প ছিল না। অন্য অর্থে এটা ছিল ‘লারনিং বাই ডুয়িং’! এই সময়ে একদিন খানে আলম খান আসলেন এক রাজস্ব মামলার শুনানির জন্য। খানে আলম খান দীর্ঘদিন ছিলেন ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার। মামলার শুনানির পর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এর রুমে আড্ডা, তিনি চাঁদপুর এ কাজ করেছেন ১৯৫২-৫৩ সালে, তখন সাইকেলে করে হাইমচর-ফরিদগঞ্জ যাবার গল্প করছিলেন।
চাঁদপুর নদী ভাংতি এলাকা বিধায় রাজস্ব প্রশাসনের জটিলতাও ছিল। জেলা প্রশাসক মহোদয় পরিদর্শনের উপর খুব গুরুত্ব দিতেন। তাঁর কথা ছিল যে একজন সুপিরিয়র কর্মকর্তা পরিদর্শন শেষে এক দরজা দিয়ে বের হবেন, আরেকজন আরেক দরজা দিয়ে প্রবেশ করবেন। ফলে আমাকে যেমন তহশিল (ইউনিয়ন ভূমি অফিস) পরিদর্শনে যেতে হত তেমনি জেলা প্রশাসক বা অতরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এর সফরসঙ্গী হয়েও যেতে হত। জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সঙ্গে সফরের সুবিধা ছিল কিছু মূল্যবান অভিজ্ঞতালব্ধ টিপস পাওয়া যেত যা সারাজীবনে কাজে লাগার মত। তাঁর যে দু’টি টিপস আমি জেলা প্রশাসক হিসেবে বা অন্য পদেও ব্যবহার করেছি তা হল পরিদর্শন প্রতিবেদন তাৎক্ষণিক লিখে ফেলা বা ডিক্টেশন দেয়া, যখন যা সুবিধা। আমি সবসময় তাই করেছি। আর দ্বিতীয় হল ভ্রমনকালেই প্রয়োজনীয় বিষয়ে ডিক্টেশন দিয়ে দেওয়া। ফলে গাড়িতে বসেই অনেক চিঠির প্রাথমিক খসড়া হয়ে যেতো। পরবর্তীতে শামসুল আলম সাহেবের বিভিন্ন অফিস পরিদর্শনের এক সেট প্রতিবেদন বিপিএটিসিতে প্রশিক্ষণের নমুনা হিসেবে ব্যবহৃত হতো।