জেলা রেজিস্ট্রার ও এক সাব-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে ঘুষ বাণিজ্য ও দলিল লেখককে হয়রানীর অভিযোগ
স্টাফ রিপোর্টার ॥ হবিগঞ্জের জেলা রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান এর বিরুদ্ধে আবারও আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করেছেন এক দলিল লিখক। আদালতের দুই দফা নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও সালাউদ্দিন নামে এক দলিল লিখকের সনদ বাতিলের কারণে গতকাল মঙ্গলবার এই মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর আগেও জেলা রেজিস্ট্রার ও মাধবপুর উপজেলার সাব রেজিস্ট্রার শংকর কুমার ধরের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করেন দলিল লিখক সালাউদ্দিন।
আদালত ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলায় ব্যাপক শিল্পায়ন হওয়ায় সেখানকার চারাভাঙ্গা সাব রেজিস্ট্রি অফিসার পদটি অত্যন্ত লোভনীয় পদ হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। বর্তমান সাব রেজিস্ট্রার শংকর কুমার ধর সেখান থেকে প্রতিমাসে ২০ লাখ টাকা ঘুষ বাণিজ্য করেন বলে অভিযোগ করেছেন দলিল লিখক সালাউদ্দিন। প্রতি মাসে তিনি ২ থেকে ৩ লাখ টাকা ভাগ দেন জেলা রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমানকে। সালাউদ্দিন এই ঘুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় তার উপর ক্ষিপ্ত হন জেলা রেজিস্ট্রার ও সাব রেজিস্ট্রার। বিভিন্ন সময় তাকে হয়রানীর চেষ্টা করেন তারা। বিগত সময়ে সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে ৫৬৪১/১৬ নং দলিলে তার বিরুদ্ধে রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার অভিযোগ দায়ের করা হয়। এ ব্যাপারে তাকে শোকজও করা হয়। এরই মাঝে বিষয়টি নিয়ে সিআর ২২/১৮ মামলা দায়ের করা হয়। ফলে তার বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগের তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাবেক জেলা রেজিস্ট্রার মামলা চলমান থাকায় তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া সম্ভব নয় বলে মহা রেজিস্ট্রারকে পত্র প্রেরণ করেন।
এদিকে বর্তমান জেলা রেজিস্ট্র্রার মিজানুর রহমান ও মাধবপুর উপজেলা সাব রেজিস্ট্রার শংকর কুমার ধর নতুন করে সালাউদ্দিনকে হয়রানীর সুযোগ খুঁজতে থাকেন। তারা সালাউদ্দিনের কাছে ৫ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন। কিন্তু সালাউদ্দিন ২ লাখ টাকা দিয়ে আর দেয়া যাবে না বলে জানালে তারা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকেন। সাবেক জেলা রেজিস্ট্রার ইলিয়াস হোসেন তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া সম্ভব নয় বলে প্রতিবেদন দেয়ার পরও জেলা রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান নবীগঞ্জ উপজেলার সাব রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে একটি তদন্ত করান। সালাউদ্দিন তার লাইসেন্স বাতিল করার এই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে তৎকালীন সিনিয়র সহকারী জজ সাজ্জাদ হোসেন এর আদালতে স্বত্ব ৯৭/২০ মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় বিগত ৪ অক্টোবর বিজ্ঞ বিচারক জেলা রেজিস্ট্রার ও সাব রেজিস্ট্রারকে মামলাটি শুনানী শেষ না হওয়া পর্যন্ত যাতে সালাউদ্দিনের সনদ বাতিল বা কার্যক্রম থেকে বিরত রাখা না হয় তার জন্য অন্তবর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেন।
কিন্তু গত ৭ সেপ্টেম্বর মাধবপুর উপজেলার সাব রেজিস্ট্রার শংকর কুমার ধর এখতিয়ার বহির্ভুতভাবে সালাউদ্দিন আহমেদকে একটি পত্র প্রেরণ করে উল্লেখ করেন, উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত সে যেন দলিল লেখা থেকে বিরত থাকে। এ ধরনের আদেশ সাধারণত আইজিআর প্রদান করতে পারেন।
এই আদেশ পেয়ে সালাউদ্দিন সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে জেলা রেজিস্ট্রার ও মাধবপুরের সাব রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে ওই আদেশকে অবৈধ ও কার্যকরী নহে মর্মে ঘোষণা চেয়ে নিষেধাজ্ঞা প্রার্থনা করলে বিজ্ঞ আদালত শুনানী শেষে নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করেন। এই নিষেধাজ্ঞার পরও সালাউদ্দিনকে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে না দিলে তিনি জেলা রেজিস্ট্রার ও মাধবপুরের সাব রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা মামলা দায়ের করেন।
আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও সালাউদ্দিনকে কেন তার সনদ বাতিল করা হবে না তার জন্য কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করেন জেলা রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান। ১৭ সেপ্টেম্বর এই কারণ দর্শানোর নোটিশ পেয়ে আবারও আদালতের শরণাপন্ন হয়ে গত ১ অক্টোবর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবেদন করেন সালাউদ্দিন। ৪ অক্টোবর আবারও তার সনদ বাতিল না করার জন্য অন্তবর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞার আদেশ দেন বিজ্ঞ বিচারক।
দুই দফা নিষেধাজ্ঞা ও আদালত অবমাননা মামলা দায়েরের পরও জেলা রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান গত ১৮ নভেম্বর এক পত্রে সালাউদ্দিনকে তার দলিল লিখকের সনদ সাময়িক স্থগিত এবং তাকে সাব রেজিস্ট্রার অফিসে প্রবেশে নিষেধ করে একটি আদেশ প্রদান করেন। এই পত্র পেয়ে সালাউদ্দিন পুনরায় মঙ্গলবার দুপুরে হবিগঞ্জের সিনিয়র সহকারী জজ একলাছ উদ্দিনের আদালতে জেলা রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান এর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করেন। মামলাটি আমলে নিয়ে জেলা রেজিস্ট্রারকে সমন এর আদেশ হয়েছে বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে দলিল লিখক সালাউদ্দিন জানান, আমার বিরুদ্ধে যে রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে আমি তার জবাব প্রদান করেছি। এ ব্যাপারে যে মামলা রয়েছে তাও মোকাবেলা করছি। আমি কোন রাজস্ব ফাঁকি দেইনি।
তিনি অভিযোগ করে জানান, মাধবপুর উপজেলার সাব রেজিস্ট্রার শংকর কুমার ধর প্রতিমাসে ২০ লাখ টাকা ঘুষ পান দলিল রেজিস্ট্রি থেকে। বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের দলিল থেকে তিনি ১ লাখ টাকাও ঘুষ নেন। আমি যেহেতু শিল্প প্রতিষ্ঠানের দলিল বেশী করি তাই আমি ঘুষের প্রতিবাদ করায় তিনি আমার উপর ক্ষিপ্ত হন। প্রতি মাসে তিনি জেলা রেজিস্ট্রারকে ২/৩ লাখ টাকার ভাগ দেন। ফলে তারা দুইজন মিলে আমাকে হয়রানী করছেন।
এ ব্যাপারে সালাউদ্দিন এর আইনজীবী দেবাশীষ পাল চৌধুরী বলেন, সরকারী নিবন্ধন ম্যানুয়েল ২০১৪ এর ৬৩(ক) এর ১ ও ২ উপধারা অনুযায়ী এবং ডিএলআর ৩৯(এডি) ২২৩ পৃষ্ঠায় বলা আছে দলিল রেজিস্ট্রির পর যদি কোন রাজস্ব আদায়ে অনিয়ম হয়ে থাকে তার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট নিবন্ধকের। দলিল লিখকের এতে কোন দায় নেই। আদালতের নিষেধাজ্ঞা ও অবমাননার মামলা থাকার পরও একজন সরকারী কর্মকর্তা যেভাবে তা অমান্য করছেন তা নজির বিহীন। এতে করে সাধারণ মানুষের আইন না মানার প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে।
এ দিকে জেলা রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তার এক কম্পিউটার অপারেটরের মাধ্যমে তার দপ্তরের কর্মচারীদেরকে টাকার বিনিময়ে বদলী, বিভিন্ন দলিল লিখকের নামে বিভিন্ন লোক মারফত মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে তা তদন্তের নামে টাকা আদায় করেন। দলিল লিখকদের লাইসেন্স বাতিলের হুমকি দিয়েও এই টাকা আদায় করা হয়। এ ব্যাপারে বিভিন্ন মিডিয়ায় নিয়মিত সংবাদ প্রকাশিত হয়ে আসছে।
এ ব্যাপারে জেলা রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমানের সাথে পূর্বে ফোন করলে তিনি বলেছিলেন, তিনি শুধু রুটিন ওয়ার্ক করছেন। কারও সনদ বাতিল করা হবে না। তবে মঙ্গলবার আদালতে মামলা দায়ের হলে তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান মামলার বিষয়টি তিনি জানেন না।
আদালতের নিষেধাজ্ঞা ও অবমাননা মামলা থাকার পরও কিভাবে দলিল লিখকের সনদ বাতিল করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আদালতের বিষয়টি আমি আদালতেই দেখব। আর কোন তদন্ত আমি নিজে করি না। এগুলো আইজিআরের নির্দেশে হয়। আপনারা শুধু আমার বিষয়েই লিখেন। রাজস্ব ফাঁকির বিষয়টি কেন লিখেন না।
এ ব্যাপারে মাধবপুর উপজেলার সাব রেজিস্ট্রার শংকর কুমার ধর এর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এ ব্যাপারে মোবাইলে ম্যাসেজ দিলে তিনি কোন প্রতিক্রিয়া জানাননি।