স্মৃতির পাতা থেকে-৩৭
এদিকে আমার মাস্টার্স পরীক্ষাও তখন মাথার উপর। খাগড়াছড়ি থেকে পরীক্ষা দেয়া সম্ভব হলেও পানছড়ি থেকে তা সম্ভব হতো না ফলে উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট না হয়ে খাগড়াছড়ি থেকে যাওয়া আমার জন্য ভালোই ছিল। পরীক্ষা’র তারিখ দেবার পর ডিসি সাহেবের সঙ্গে কথা বললাম যে কিভাবে ছুটি নেয়া যায়। ৫ সপ্তাহ ছুটিতো তিনি কোন ভাবেই দিবেন না। তাই প্রথম দু’টো পরীক্ষা খাগড়াছড়ি থেকে এসেই দিলাম। বৃহস্পতিবার বিকেলে রওয়ানা দিয়ে রাতে চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম থেকে রাতের ট্রেনে ঢাকা এসে মহসিন হলের রুম নাম্বার ২৪৩ এ ঠাঁই। যথারীতি আমার কোন নোট নাই। শনিবারে বন্ধু ঘধংরযঁষ কধসধষ (১৯৮৪ ব্যাচ, একসময়ে ঢাকা’র জেলা প্রশাসক) নোট দেখে পড়ালেখা করি, রবিবার পরীক্ষা দিয়ে বিকেলের বাসে ফেনী, সোমবার সকালে ফেনী-খাগড়াছড়ি বাসে দুপুর ১২ টার মধ্যে খাগড়াছড়ি পৌঁছে অফিস করি। এইভাবে দুই পেপার পরীক্ষা দেবার পর ডিসি ভাবিকে বললাম যে এইভাবেতো পরীক্ষা দেয়া সম্ভব না, আগামী পরীক্ষা দিতে যখন যাবো একসঙ্গে তিন পরীক্ষা দিয়ে আসবো। ছুটির বিষয়ে স্যার যে সিদ্ধান্ত নেন, নিবেন। একথা বলে তৃতীয় পত্র পরীক্ষা দিতে চলে আসলাম। এরপর ১৫ দিন থেকে তৃতীয়, চতুর্থ ও কম্প্রিহেনসিভ পত্রের পরীক্ষা দিয়ে খাগড়াছড়ি ফিরে আসলাম।
আমাদের ৪০ নাম্বারের টিউটোরিয়াল ছিল কোন না কোন পাবলিক আন্ডারটেকিং বা কর্পোরেশন এর উপরে বিশ্লেষণাত্মক প্রবন্ধ লিখা। তাই আমার বন্ধুরা সবাই কোন না কোন সরকারী সংস্থা/পাবলিক কর্পোরেশন এর উপর টিউটোরিয়াল জমা দিয়েছিল।
আমি খাগড়াছড়িতে কোথায় পাবো পাবলিক কর্পোরেশন! মরহুম অধ্যাপক মোফাজ্জলুল হকের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকে ঠিক হলো যে আমি পার্বত্য চট্টগ্রামে বাজার ফান্ড এর ভুমিকা’র বিষয়ে একটা পেপার জমা দেব। আগেই উল্লেখ করেছিলাম যে বাজার ফান্ড ঔপনিবেশিক ভারত সরকারের ২৩ নভেম্বর ১৮৯৫ সালের ৫৫১১ নং আদেশ বলে সৃষ্ট একটি “এক্সক্লুডেড লোকাল ফান্ড” যা স্থানীয় হাট বাজারের ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের জন্য ব্যবহারযোগ্য। টিউটোরিয়াল জমাও দিয়েছিলাম কিন্তু বিলম্বে জমা হওয়ায় এবং টিউটোরিয়াল ছাড়াই দ্বিতীয় শ্রেণীর নাম্বার থাকায় তা’ আর যোগ করা হয়নি বলে চৎড়ভবংংড়ৎ ঐধনরন তধভধৎঁষষধয স্যার জানিয়েছিলেন। ফলে আমার চূড়ান্ত মূল্যায়ন হয় ৫০০ এর পরিবর্তে ৪৩০ এর উপর। এ কারণে মাস্টার্স এ আমার পজিশন পিছিয়ে যায় ও পরে এর জন্য বড় মূল্য দিতে হয়। তবুও পরীক্ষাটা শেষ করে আমি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি।
খাগড়াছড়িতে চাকুরী করে কোর্স সিস্টেমে মাস্টার্স কমপ্লিট করা নিঃসন্দেহে আমার জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।
পরীক্ষা শেষে ঢাকা থেকে ফিরে এসে শুনলাম যে জেলা প্রশাসক সাহেবের মা মারা গিয়েছেন, তিনি খাগড়াছড়িতে জেলা প্রশাসকের বাংলোতেই ছিলেন এবং অফিসারদের কেউ কেউ দাফনে অংশ নিতে লক্ষ্মীপুর গিয়েছিলেন। স্যারের মা আমাদেরও স্নেহ করতেন। আমি অনুভব করলাম যে আমার গিয়ে কবর জেয়ারত করে আসা উচিত। এক উইকএন্ডে চলে গেলাম লক্ষ্মীপুর। সেখানে স্যারের ছোটভাই হামদে রাব্বী সদর উপজেলা চেয়ারম্যান। সদরের ইউএনও ছিলেন আগে মাটিরাঙ্গায় থাকা ড. জাফর আহমেদ চৌধুরী। ট্রাইং ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন ১৯৮১ ব্যাচের ইধফৎঁষ ঞধৎধভফধৎ, স্যারের সংগেও দেখা হল। তখন লক্ষ্মীপুরের জেলা প্রশাসক ১৯৬৮ ব্যাচের ইপিসিএস হুমায়ুন কবির। জাফর স্যার আমাকে পাশে বসিয়ে নিজে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেলেন উপজেলা চেয়ারম্যানের বাড়িতে। তাঁর এই সৌজন্যের কথা আমি অনেক সময়ই বিভিন্নজনকে বলেছি। সেখানে গিয়ে কবর জেয়ারত করি এবং পরে খাগড়াছড়ি ফিরে যাই।
আগে উল্লেখ করতে ভুলে গিয়েছিলাম যে খাগড়াছড়ি মহকুমা’র পরিবহন পুলে একটা হাতি ছিল। প্রাক্তন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান ১৯৬২ সালে এই হাতিকে রামগড় মহকুমায় দেখেছেন কারণ তখন খাগড়াছড়ি মহকুমা ছিল না। আর রাঙ্গামাটির হাতি আরো আগের। পার্বত্য চট্টগ্রামের দুইবারের জেলা প্রশাসক মেজর এল এইচ নিবলেট এর দ্বিতীয় মেয়াদের সময় ১১ ডিসেম্বর ১৯৫৬ তারিখে জেলা প্রশাসককে হত্যা করে পরে তাঁর কবরের পাশে শুয়ে অনশনে প্রাণত্যাগ করে। পরিবহন পুল বলতে বুঝায় সাধারণ ব্যবহারের জন্য যানবাহন প্রস্তুত রাখা হয় যেখানে। ঢাকায় সরকারী পরিবহন পুল আর জেলায় জেলা প্রশাসক পুলের কথা আমরা শুনে থাকি। সরকারী প্রয়োজনে পুল যানবাহনের ব্যবস্থা করে থাকে। পুলে গাড়ি এবং নৌযান থাকে, পার্বত্য চট্টগ্রামে হাতিও ছিল। ১৯৮৩ সালে অন্য কোন জেলা বা মহকুমায় হাতি না থাকলেও খাগড়াছড়ি মহকুমায় ‘ফুলকলি’ নামে একটা হাতি ছিল। পুলে ড্রাইভার এর পাশাপাশি মাহুত এর পদও ছিল। ‘ফুলকলি’ আলুটিলাতে ছাড়া অবস্থায় থাকতো, মাহুতকে খবর দিলে সে বন থেকে হাতি নিয়ে আসতো। আমরা যাবার আগে ইপিসিএস ১৯৭০ ব্যাচের মোস্তাফিজুর রহমান সাহেব নামে একজন এসডিও ছিলেন যিনি দীঘিনালা, পানছড়ি বা মহালছড়ি গেলে অবশ্যই হাতি নিয়ে যেতেন। আমি চলে আসার পর জেলা প্রশাসক ছিলেন খোরশেদ আনসার খান, যিনি ১০ বছরেরও বেশী রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়িতে চাকুরী করেছেন। তিনিও হাতি চড়তে পছন্দ করতেন, পছন্দ করতেন ‘ফুলকলি’কেও। তাঁর সময়ই ১৯৮৬ সালে ‘ফুলকলি’ মারা যায় এবং তাকে আলুটিলাতে কবর দেয়া হয়।
অনেক ভ্রমণকারী আলুটিলাতে ‘ফুলকলি’র কবর ও সেখানে খোরশেদ আনসার খান এর কবিতা দেখতে পান। আমিও সেখানে যাবার পর ‘ফুলকলি’তে চড়েছি বেড়ানোর জন্য। খাগড়াছড়িতে বুনো হাতিও ছিল। বুনোহাতির অন্ততঃ একটা দল জেলা সদর, গুইমারা-মাটিরাঙ্গা এলাকায় ঘোরাফেরা করতো। তারা একপর্যায়ে পুরো এলাকা জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। আমরা জানি যে হাতি খুব শান্ত প্রাণী, দল বেঁধে অনেকগুলো পরিবার একসঙ্গে থাকে এবং দলের সর্দারকে অনুসরণ করে চলে। কিন্তু মাটিরাঙ্গার ওই দলে সম্ভবতঃ কোন মাস্ত হাতি ছিল বা কোন “জড়মঁব” হাতি ছিল, কোন কারণে কোন কোন হাতি ‘জড়মঁব’ বা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায় তখন তাকে সর্দার দল থেকে বের করে দেয়। হাতি একা বাঁচতে পারে না তাই সেও দূর থেকে দলকে অনুসরণ করে। এই “জড়মঁব” এলিফ্যান্টগুলোই সাধারণতঃ আতঙ্ক ছড়ায়। এই দলটাও সেটলার্স ভিলেজে আক্রমণ করতে থাকে এবং তাদের হাতে প্রাণহানিও ঘটে। একদিন ব্রিগেড সদরের সভায় গুইমারা জোন কমান্ডার দুইজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীও নিয়ে আসেন যারা প্রধান সড়কে হাতীর মজার ও আতঙ্কজনক অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেয় ।
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com