জালাল আহমেদ
খোয়াই নদী মাছুলিয়া থেকে রামপুর পর্যন্ত সোজা খনন করার ফলে হবিগঞ্জ শহরের চেহারা বদলে যায়
এইচএসসি পরীক্ষার সময়ে আমি নিয়ম করে রাতে পড়তে বসতাম। আমাদের বাসার পরিবেশ পড়ালেখার অনুকূল ছিল না যদিও এই বাসা থেকেই আমরা ৬ ভাইবোন গ্র্যাজুয়েট হয়েছি, ৪ ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছি

কলেজের পড়া প্রায় শেষ হয়ে আসতে থাকে। কলেজে আমার বন্ধু ছিল সব সময়ের মতোই কয়েকজন। স্কুল থেকে কামাল, আর পার্থ। আর কলেজে এসে আবদুল হক, দিলীপ আর মনোয়ার। স্কুলের বন্ধু নিয়াজ কলেজে না এলেও নিয়াজ ছিল আমার সারা জীবনের বন্ধু। বিজ্ঞান বিভাগের ইফতেখার স্কুলে ফার্স্ট বয় ছিল, এসএসসিতে সে ভালো রেজাল্ট করেছিল, তাঁর সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা ছিল। তাঁর ভাই ছিল আমাদের অর্থনীতি’র শিক্ষক, আব্বাস স্যার। আমাদের সময়ে কলেজ আঙ্গিনায় একটা জিমন্যাশিয়াম ছিল। আমি স্কুল থেকেই এই জিমে আসতাম, কলেজেও কিছুদিন তা’ বজায় রাখি। এরপর কলেজ শেষে ঘোরাঘুরি আর আড্ডা দেয়ার অভ্যাস হয়। কয়েকজন এক হয়ে কলেজ ট্যাঙ্কে, যা এখন আদালতের সীমানাভূক্ত, এর পাড়ে বসে বাদাম খেয়ে আড্ডা দিতাম। কখনো কামালের বাসায় বা কখনো নদীর পাড় ধরে নিয়াজসহ বন্ধুরা পুরান মুন্সেফীর দিকে হাঁটতে যেতাম ।
আমাদের কলেজ পড়ার সময় একটি অন্যতম বড় কাজের সঙ্গে আমরা শরিক হই যা এখন আর আলোচিত না বা কোথাও উল্লেখ হয় না। তা হলো খোয়াই নদীর লুপ কাটিং। হবিগঞ্জের দুঃখ বলা হতো খোয়াইকে। নদী বর্তমান সার্কিট হাউস, থানা, জেলা প্রশাসকের অফিসের সামনে দিয়ে হাসপাতাল কোয়ার্টার, মুসলিম কোয়ার্টার, সিনেমা হল, বাজার, পুরান মুন্সেফী’র পাস দিয়ে সোজা উত্তর দিকে পুরান বাজারের দিকে বহমান ছিল। স্টাফ কোয়ার্টার ছিল নদীর ওপাড়ে। ১৯৭৭-৭৮ সালে এই নদী পৈল রোডে মাছুলিয়া হতে উত্তরে রামপুর পর্যন্ত সোজা খনন করার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। তখন সিলেটের জেলা প্রশাসক ছিলেন ১৯৬৫ ব্যাচের সিএসপি মোহাম্মদ ফয়েজউল্লাহ এবং হবিগঞ্জের এসডিও ছিলেন মোঃ আজিজুর রহমান। তাঁদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের বৃহত্তম লুপ কাটিং এর কাজ শুরু হয়। প্রথমে স্বেচ্ছাশ্রমে এই কাজ শুরু হয় এবং কলেজ টিম রামপুর অংশে মাটি কাটে। আমি একটি দলের নেতা ছিলাম এবং দীর্ঘদিন আমরা মাটি কাটি। পরে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর অধীনে খনন কাজ চলে এবং যখন তা শেষ হয় তখন স্থায়ীভাবে হবিগঞ্জ শহরের চেহারা বদলে যায়। আজ শহরের যে পূর্বমুখী বিস্তার তা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র এই প্রকল্পের কারণে। এ কাজে আমিও ঘাম ঝরিয়েছি ভেবে তৃপ্তি পাই।
ইতোমধ্যে আমাদের টেস্ট পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় এবং টেস্ট পরীক্ষা’র ফলাফলেও আমি প্রথম হই। কিন্তু যে নাম্বার পাই তা প্রথম বিভাগের ছিল না। তার অন্যতম কারণ ছিল বিষয় নির্বাচন। আমি সারাজীবনই বিষয় নির্বাচনে ভুল করেছি এবং সুযোগ পেলে আবারো একই ভুল করবো। তবে অন্যের জন্য আমি এই সুপারিশ করি না। বিষয় নির্বাচনে আমি কখনোই নম্বর বেশী উঠবে কি-না সে বিষয়ে নজর দেইনি, আমি পছন্দ করি কি-না বা পড়তে ভালো লাগবে কি-না সে বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছি। এইচএসসিতে আমার বিষয় ছিল সাধারণ ইতিহাস, পৌরনীতি, অর্থনীতি এবং চতুর্থ বিষয় ছিল লজিক। ফলে এসএসসি’র কথা মাথায় রেখে টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্টের পর নিয়ম করে পড়ালেখা শুরু করি। আমার জীবনে এই একটি পরীক্ষার আগেই আমি অল্প হলেও নিয়মিত পড়ালেখা করেছি। পরীক্ষার প্রস্তুতির বিষয়টি আমার ব্যক্তিগত অভ্যাসে নাই এবং আমি কাউকে আমার মতো হবার সুপারিশ বা পরামর্শও দেব না। এইচএসসি পরীক্ষার সময়ে আমি নিয়ম করে রাতে পড়তে বসতাম। আমাদের বাসার পরিবেশ পড়ালেখার অনুকূল ছিল না যদিও এই বাসা থেকেই আমরা ৬ ভাইবোন গ্র্যাজুয়েট হয়েছি, ৪ ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছি।
আমার আব্বা ছিলেন এডভোকেট, ঐ মহকুমা শহরের ব্যস্ততমদের একজন। তবে তাঁর ব্যক্তিগত অভ্যাস ছিল সন্ধ্যার পর পেশাগত কাজ না করা। সন্ধ্যার পর চেম্বারে তাঁর বন্ধু-বান্ধবরা চলে আসতেন আড্ডা দিতে। আইনজীবীদের কেউ কেউ পেশাগত পরামর্শের জন্য আসলেও অপেক্ষা করতে হতো। শহরের সবচেয়ে ব্যস্ত ডাক্তার আবুল হাশিমও চেম্বার দ্রুত শেষ করে ৯টার মধ্যে চলে আসতেন আড্ডা দেবার লোভে। কাপের পর কাপ চা আর সিগারেটের ধোঁয়ার মাঝে আড্ডা চলতো। আব্বা ছিলেন চেইন স্মোকার, আমরা ৫ ভাই নন-স্মোকার। সকালেও একই অবস্থা, পেশাগত ব্যস্ততা, সহকারী দুইজন, পরে তিনজন আসতেন। মক্কেলরা চলে আসতেন এবং সকালের ব্যস্ততা চলত ৯ঃ৩০/১০ঃ০০ টা পর্যন্ত। আমার থাকা এবং পড়ালেখা বাংলা ঘরের একপাশে অর্থাৎ আব্বার চেম্বারের পাশে। ফলে রাতে বাসার ভেতরে পড়া শুরু করলাম। বাসার ভেতরেও প্রায় একই অবস্থা।
আমাদের সন্তানরা আসলে এটা সহজে ধারনাও করতে পারবেনা। আমরা ছিলাম ৮ ভাইবোন। ১৯৭৮ সালে ৭ জনই স্কুল-কলেজে যায়। বাসায় জায়গীর ছিল একজন অর্থাৎ সাবেকি নিয়মে একজন বহিরাগত ছাত্র বাসায় লজিং থেকে পড়াশুনা করতো। তখন প্রায় শিক্ষিত এবং সম্পন্ন পরিবারে এটা অবশ্যপালনীয় নিয়মের মতো ছিল। আমার চাচা-মামারা যখন ১৯৪৯-৫০ সালে ঢাকায় পড়তে আসেন তাঁরাও তাঁদের পড়ালেখা শুরু করেন লজিং থেকে। বুয়েটের প্রথম ভিসি ড. আব্দুর রশিদ সাহেবের বাসায় তাঁরা থেকেছেন এবং ঐ বাসায় নিয়মিতভাবেই অনেক ছাত্র থাকতেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী ছিলেন নাসিরউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, তাঁর বাসায় আলাদা বড় একটি রুমে অনেক ছাত্রের থাকার ব্যবস্থা ছিল এবং আমার চাচা যিনি ১৯৪৯ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন তিনি ঐ বাসায় থেকেছেন। তাই আমাদের বাসায়ও সবসময় এমন কেউ না কেউ থেকেছেন।
তখন পরীক্ষার সেন্টার হতো কমপক্ষে মহকুমা সদরে, পরীক্ষার সময়গুলোতেও কোন না কোন পরীক্ষার্থী চলে আসতো বাসায় থেকে পরীক্ষা দিতে। বাসায় কাজিনরাও থাকতো। শুধু মামাবাড়ির দিকেই আমার কাজিন সংখ্যা ছিল ৩৯। ফলে বাসার ভেতরেও যে পড়ালেখার আদর্শ পরিবেশ ছিল তা নয়। আমার মা, যিনি এখনো আল্লাহর রহমতে আমাদের মাঝে আছেন, কিভাবে যে এই ১৪/১৫ জনের বিরাট সংসার সামলাতেন তা এখনকার সময়ে বিস্ময় মনে হবে। তখনকার মফস্বলে প্রাইভেট পড়ানো বা কোচিং ব্যবসা এখনকার মতো বাণিজ্যিক ভিত্তিতে শুরু হয়নি। আমি এসএসসি’র টেস্ট পরীক্ষার পরে বকুল স্যারের (বকুল কুমার রায়) কাছে অংক আর ইংরেজী পড়েছি। এইচএসসিতেও ইংরেজী পড়েছি দেবব্রত স্যার (দেবব্রত ভট্টাচার্য) এর কাছে। বলতে দ্বিধা নেই শিক্ষকদ্বয়ের কেউই আমার কাছ থেকে মাসকাবারী হিসাব করে কোন টিউশন ফি নেননি। আমার শিক্ষাজীবনে তাঁদের অবদান আমি আজও কৃতজ্ঞতা ভরে স্মরণ করি।