ভাঙ্গা ঘরে থেকে মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে নিজের উপার্জিত অর্থ ব্যয় করেছেন বাবা আব্দুল হাই

এসএম সুরুজ আলী ॥ হবিগঞ্জ সদর উপজেলার রিচি উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী মদিনাতুল কোবরা জেরিন হত্যাকারীদের বিচারের দাবি জানিয়েছেন নিহতের পরিবার, স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ এলাকাবাসী। বুধবার সরেজমিনে নিহতের স্কুল ও গ্রামের বাড়ি ধল গ্রামে গেলে এ দাবি জানানো হয়। নিহত জেরিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িটি অনেকটা নিস্তব্ধ। উঠোনে কোন মানুষ নেই। এক পর্যায়ে এক যুবক বের হয়ে আসেন। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে জেরিনের বাবা কোথায় আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাড়িতে আছেন। তারপর জেরিনের বাবা আব্দুল হাইকে ডেকে নিয়ে আসা হয়। তিনি সাংবাদিকদের দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কান্না জড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, তার কোন ছেলে নেই। দুই মেয়ে। বড় মেয়ের নাম সামিরুলনেছা শারমিন আর ছোট মেয়ের নাম মদিনাতুল কোবরা জেরিন। শারমিন এইচএসসিতে উত্তীর্ণ হয়েছেন। আর জেরিন এবার এসসি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
তিনি বলেন, জেরিন ৩য় শ্রেণিতে কিন্ডার গার্ডেনের বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে বৃত্তি পেয়েছিল। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়েও বৃত্তি লাভ করে। সমাপনী পরীক্ষায় বৃত্তি পাওয়ার পর তাকে অনেক স্কুলে ভর্তি করার জন্য শিক্ষকরা আমার সাথে যোগাযোগ করেন। কিন্তু আমি তাকে রিচি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করি। রিচি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর জেএসসি পরীক্ষায় সে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পায়। তারপর আমরা জেরিনকে নিয়ে স্বপন দেখতে শুরু করি। জেরিন একদিন প্রতিষ্ঠিত হয়ে আমাদের মুখ উজ্জল করবে এটা ভাবনা ছিলো। সে নবম শ্রেণিতে উঠার পর শিক্ষকরা পরামর্শ দেন জেরিনকে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ানোর জন্য। শিক্ষকদের পরামর্শে তাকে বিজ্ঞান বিভাগের ভর্তি করি। বিজ্ঞান সাবজেক্ট নেওয়ার পর পড়াশোনায় আরো মনোযোগি হয়ে উঠে জেরিন। সে মেধাবী ছাত্রী হিসেবে নিয়মিত সরকারি বৃত্তি পেতো। সরকারি বৃত্তি ছাড়াও রিচি গ্রামের একজন ব্যবসায়ী প্রতি মাসে তাকে ৫শ’ টাকা করে সম্মানী দিতেন। মারা যাওয়ার কয়েকদিন পূর্বে জেরিনকে আমি জিজ্ঞেস করি সরকার মেধাবী হিসেবে তোমাকে সম্মানী দিচ্ছে। তুমি কি এর মর্যাদা রাখতে পারবে। এ সময় জেরিন আমাকে বলেছিল, সে এসএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পাবে। তারপর তাকে সংবর্ধনা দিবে। এ সংবর্ধনা তার বাবা হিসেবে আমিও সম্মানিত হবো। কিন্তু আমাদের সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। তিনি বলেন, জেরিন যেমন মেধাবী ছিল, তেমনি অনেক সুন্দর ছিল। আমার মেয়ের সৌন্দর্য্য তার জন্য কাল হয়ে যায়। মাস খানেক পূর্বে সে আমাকে জানায়, আমদের পাশর্^বর্তী বাড়ির মোঃ দিদার হোসেনের ছেলে মোঃ জাকির হোসেন (২৫) তাকে উত্ত্যক্ত করছে। আমি এ কথা শুনে জাকিরের বাবার কাছে বিচার দিয়ে আসি। পরবর্তীতে জাকিরের বাবা ও বড় ভাই আমাদের বাড়িতে এসে এ ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে জেরিনকে আর ডিস্টার্ব করবে না বলে আশ^স্থ করেন। এর আগে জেরিনকে উত্ত্যক্ত করেছে কি না তা আমি জানি না। উত্ত্যক্ত করলেও হয়তো মান ইজ্জতের ভয়ে সে আমাদের জানায়নি। ১৮ জানুয়ারি সকাল ৭টায় জেরিন প্রতিদিনের ন্যায় স্কুলে যাওয়ার জন্য তেমুনিয়া পয়েন্টে যায়। এ সময় জাকিরের বন্ধু নুর আলম সিএনজি গাড়ী নিয়ে জেরিনকে উঠতে বললে সরল বিশ^াসে জেরিন তার সিএনজিতে উঠে। ওই সিএনজিতে চালক নুর আলম গাড়ীতে থাকা তার বন্ধু হৃদয়কে নিয়ে স্কুলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। সামান্য দূরে গিয়ে সিএনজিতে জাকির হোসেনকে তোলে নুর আলম। সিএনজি গাড়ীটি রিচি স্কুলের প্রথম গেইট ও ২য় গেইটে না থামালে জেরিন বুঝতে পারে জাকির গং তাকে অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। সে গাড়ি থামানে বললেও নুর আলম গাড়ি থামায়নি। এক পর্যায়ে গাড়ীতে থাকা জাকির ও তার বন্ধু হৃদয় জেরিনের সাথে ধস্তাধস্তি শুরু করে। জেরিন নিজেকে রক্ষার জন্য শোর চিৎকার করে গাড়ী থেকে লাফ দিয়ে পড়ার চেষ্টা চালায়। এ অবস্থায় নিজেরা বাঁচার জন্য জাকির ও তার সহযোগী হৃদয় মিয়া জেরিনকে ধাক্কা দিয়ে সিএনজি থেকে রাস্তায় ফেলে দেয়। এতে জেরিন গুরুতর আহত হয়। আহত অবস্থায় স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় তাকে প্রথমে হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়। পরে সংবাদ পেয়ে আমিও হবিগঞ্জ হাসপাতালে যাই। গিয়ে দেখি আমার মেয়ে অজ্ঞান। কোন কথা বলতে পারছে না। ডাক্তার তার গুরুতর অবস্থা দেখে সিলেট ওসমানি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন। পরের দিন সকালে আমার মেয়ে মৃত্যুরকোলে ঢলে পড়ে। যখন আমার মেয়ে মারা যায় তখন আমরা তার শোকে বিলাপ করতে থাকি। আমার মেয়েকে যে এভাবে হত্যা করা হয়েছে আমাদের মনে হয়নি। যে কারণে আমরা ময়না তদন্ত ছাড়াই লাশ বাড়িতে এনে দাফন করি। পরবর্তীতে জানতে পারি ওই সিএনজিতে জাকির ছিল। এরপর তার প্রতি আমাদের সন্দেহ হয়। পরে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হবিগঞ্জ সদর সার্কেল) মোঃ রবিউল ইসলামের নেতৃত্বে হবিগঞ্জ সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ মাসুক আলীসহ একদল পুলিশ আমার মেয়ের হত্যা রহস্য উদঘাটন করেন। এ জন্য আমরা পুলিশ প্রশাসনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তিনি আরও বলেন, এ ঘটনার সাথে যারা জড়িত তাদের অবিলম্বে গ্রেফতার এবং জাকিরসহ তার সহযোগিদের যাতে ফাঁসি হয় এজন্য সরকারের কাছে দাবি জানাই। জাকিরের ফাঁসি হলে আমার মেয়ের আত্মা শান্তি পাবে।
জেরিনের ঘরে গিয়ে দেখা যায়, জেরিনের মা বিলাপ করছেন। তিনি বলেন, আমরা কোনদিনও কল্পনা করিনি আমাদের মেয়েকে এভাবে হত্যা করা হবে। আমার মেয়েকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। সে একদিন উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হবে। এজন্য আমরা বাড়িতে কোন প্রকার ঘর নির্মাণ করিনি। ভাঙ্গা ঘরে থেকে জেরিনের বাবা যে টাকা পয়সা উপার্জন করেছিলেন তা ব্যয় করেছি মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করা জন্য। কিন্তু ঘাতক জাকির আমার মেয়ের প্রাণ কেড়ে নিয়ে আমাদের স্বপ্ন ভেঙ্গে দিয়েছে। আমি মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে আমার মেয়ের বেহেশত কামনা করছি এবং ঘাতক জাকিরসহ তার সহযোগিদের ফাঁসির দাবি জানাই।
জেরিনের বড় বোন সামিরুননেচ্ছা শারমীন জানান, জেরিন আমার চেয়ে অনেক মেধাবী ছিল। এবারের এসএসসি পরীক্ষার জন্য জেরিন সকল ধরণের প্রস্তুতি নিয়েছিল। ঘটনার দিন জেরিনের স্যার তার কোচিংয়ে শেষ পরীক্ষা নেয়ার জন্য তাকে স্কুলে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। এই উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে রওয়ানা দেয় জেরিন। কিন্তু আমার বোন আর বাড়িতে ফিরে আসতে পারেনি। ঘাতকরা আমার বোনকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। আমি আমার বোনের হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত জাকিরসহ তার সহযোগিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই এবং ভবিষ্যতে যাতে আর কোন বোনকে হারাতে না হয় জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানাই। জেরিনের চাচাত ভাই আব্দুল মুবিন মিজান জানান, আমাদের পরিবারের মধ্যে অত্যন্ত মেধাবী ছিল জেরিন। তাকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপন ছিল, সে ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনার হবে। কিন্তু তা আর পূরণ হলো না। জাকির শেষ পর্যন্ত আমার চাচাত বোনকে হত্যা করলো। তিনি বলেন, জাকির অনেক দিন ধরেই জেরিনকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে উত্ত্যক্ত করে আসছিল। এসব বিষয় আমরা জানা স্বত্ত্বেও মান সম্মানের ভয়ে মুখ খুলে বলিনি। আমি জেরিন হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবি জানাচ্ছি।
রি”ি উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, জেরিনের হত্যার বিচারের দাবি জানিয়ে গেইটের সামনে ব্যানার লাগানো হয়েছে। এ ব্যাপারে রিচি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্রী কাজী নিশাত আনজুম জানান, জেরিন আপা অত্যন্ত ভালো ও মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। জেরিন আপাকে এভাবে হত্যা করা হবে তা কখনো কল্পনা করিনি। যারা জেরিন আপাকে হত্যা করেছে আমরা তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। অনথ্যায় স্কুলের সকল ছাত্র-ছাত্রী আন্দোলন নামবো।
এ ব্যাপারে রিচি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাজী কামাল উদ্দিন জানান, জেরিনকে স্কুলের ২টি গেইটে না নামিয়ে তাকে অপরহণের জন্য নিয়ে যাচ্ছিল ঘাতকরা। যখন জেরিন অপহরণের বিষয়টি বুঝতে পেরে সিএনজি থেকে নামার চেষ্টা করেছে, তখনই ঘাতকরা তাকে সিএনজি থেকে রাস্তায় ফেলে দেয়। পরে সে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। তিনি বলেন, জেরিনকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপন ছিল। সে ভবিষ্যতে ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হতে পারতো। কিন্তু তাকে হত্যা করে আমাদের সকল আশা ভরসা ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। জেরিন হত্যাকান্ড স্কুলের ছাত্রছাত্রীদেরও মর্মাহত করেছে। অনেকের মনোবল ভেঙ্গে গেছে। তিনি জেরিন হত্যার সাথে জড়িতদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবি জানান।
এদিকে গতকাল বিকেলে হবিগঞ্জ সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মোতাচ্ছিরুল ইসলাম জেরিনের বাড়িতে যান। এসময় তিনি জেরিনের বাবা আব্দুল হাইসহ পরিবারের লোকজনদের শান্তনা দেন। উপজেলা চেয়ারম্যান মোতাচ্ছিরুল ইসলাম জানান, একটি মেধাবী প্রাণকে হত্যা করা হয়েছে। যারাই এ ঘটনার সাথে জড়িত তাদের বিচারের আওতায় আনার জন্য তিনি দাবি জানান এবং নিহতের পরিবারকে সহযোগিতার আশ^াস দেন।
এ ব্যাপারে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হবিগঞ্জ সদর সার্কেল) মোঃ রবিউল ইসলাম জানান, জেরিন হত্যা মামলা নিয়ে আন্তরিকভাবে কাজ করছে পুলিশ। ইতোমধ্যে এই হত্যার রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে। ঘাতক জাকির হোসেন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তিনি বলেন, এ ঘটনায় যারাই জড়িত থাকুক না কেন, পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসবে।