হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও বিকেজিসিতে তৃতীয় শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষা

মঈন উদ্দিন আহমেদ ॥ হবিগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও বিকেজিসি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে গতকাল মঙ্গলবার। সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় প্রায় ১ হাজার ৪শ’ শিক্ষার্থী অংশ নেয়। তন্মধ্যে বিকেজিসি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ১২০ জন পরীক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাবে। মর্নিং শিফটে ৬০ জন এবং দিবা শাখায় ৬০ জন। একইভাবে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়েও ১২০ জন শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবে। তন্মধ্যে মর্নিং শিফটে ৬০ জন এবং দিবা শাখায় ৬০ জন। এ দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজের সন্তানকে ভর্তি করাতে অভিভাবকরা রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নামেন। নির্ধারিত সময়ে স্কুলে সন্তানকে নিয়ে যাওয়া, সকালে এ কোচিং তো বিকেলে ওই কোচিং-এ ছুটে চলা যেন নিত্য হয়ে দাঁড়ায়। যে কোন মূল্যেই হোক সন্তানকে কাক্সিক্ষত স্কুলে ভর্তি করাতে হবে। এতে কোমলমতি শিশুরা রীতিমতো যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। অভিভাবকদের এ দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে অনেকে করে নেন অর্থনৈতিক বাণিজ্য। এমনও দেখা যায় ভর্তি পরীক্ষার এক মাস আগে বিশেষ শিক্ষকের কাছে কোচিং করাতে গিয়ে অভিভাবকদের ৫/৭ হাজার থেকে ১৫/১৬ হাজার টাকা গুণতে হয়। কিন্তু আসন সংখ্যা যেহেতু সীমিত সেহেতু অনেকেই কাক্সিক্ষত স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান না। দিন দিন এ প্রতিযোগিতা বেড়েই চলেছে।
গতকাল অনুষ্ঠিত তৃতীয় শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষার পর অনেক কোমলমতি শিক্ষার্থীকে পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে বের হয়ে অঝোড়ে কাঁদতে দেখা গেছে। শুধু তাই নয় নিজের সন্তানকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছেন অনেক অভিভাবকও। বিষয়টি শহরে বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। অনেকে আবার ফেসবুকেও এ প্রসঙ্গে নানা মন্তব্য করেন। দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ পত্রিকার পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো-
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) হবিগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট ত্রিলোক কান্তি চৌধুরী বিজন তাঁর ফেসবুক পেজে লিখেন, কোমলমতি শিশুদের উপর এত চাপ কেন। ওরা কাঁদছে আর বলছে বাবা-মা কি বলবে। প্রসঙ্গ: ৩য় শ্রেণীর ভর্তি পরীক্ষা।
মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ নামে একজন লিখেন, এর জন্য বাবা-মা দায়ী। ছেলে মেয়েকে চান্স পেতেই হবে, নইলে দুনিয়ার সব শেষ। এমন মানসিকতার বাবা মাকেই আমি দায়ী করি।
মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন নামে একজন লিখেন, বাচ্চাকে সরকারি স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়াতে গিয়ে অভিভাবকদের যে অবস্থা দেখলাম, মনে হলো আমরা আমাদের সন্তানদের ক্যারিয়ার গঠন করতে গিয়ে তাদেরকে রোবটে পরিণত করে ফেলছি। এখনই ভাবতে হবে…
রোবট নয়, আমাদের সন্তানদের আগে মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। আমাদের মাথায় রাখতে হবে, জাগতিক শিক্ষাটুকুই সব কিছু নয়। সামাজিক শিক্ষা ছাড়া সব শিক্ষাই অসম্পূর্ণ। নচেৎ…
এক কিন্ডারগার্টেন প্রতিষ্ঠাতা নাছির উদ্দিন লিখেন, আল্লাহর দোহাই লাগে দয়া করে বাচ্চাদের এ ভর্তি যুদ্ধ বন্ধ করে লটারির মাধ্যমে এদের নির্বাচিত করুন। এত ছোট অবস্থাতেই তাদের মেধা যাচাই এর নামে যুদ্ধে নামাবেন না।
নাজিম উদ্দিন নামে একজন লিখেন, সরকারি স্কুলে ভর্তি পরীক্ষার নামে হবিগঞ্জ শহরের কোমলমতি শিশুরা অভিভাবকদের প্রতি বছর চাপের মুখে রাখা হয়। আমি মনে করি পরীক্ষা পদ্ধতি বাদ দিয়ে লটারি চালু হোক। তাহলে সবার সুযোগ পাওয়ার চান্স আছে।
কামাল হোসাইন সিমন নামে একজন লিখেন, ভর্তি যুদ্ধের এ কান্না থামবে কবে?
যে বয়সে হাসি আনন্দ ও খেলাধুলার মধ্য দিয়ে শিখার কথা সে বয়সে ভর্তি যুদ্ধ শেষে কান্না জড়িত চেহারায় বের হয়ে আপনজনের গলা জড়িয়ে কান্না করছে। এরূপ দৃশ্য অবলোকন করেছি গত ২০ ডিসেম্বর এবং আজ ২৪ ডিসেম্বর হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও হবিগঞ্জ বিকেজিসি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালের ৩য় ও ৬ষ্ঠ শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষা শেষে। গোলাপের মতো ফুটফুটে এ শিশু কিশোরগুলো এমনভাবে অসহায়ের মতো কান্না করছে আমার মনে হয় তার পিতা-মাতার মৃত্যুতেও এমন কান্না করবে না। কাঁদবেই না বা কেন? তাকে তো তাড়া করছে বছর জুড়ে কোচিং, প্রাইভেট, গৃহশিক্ষক নিয়োগের উদ্দেশ্য। যেন একটি দাড়ি, কমাও ভুল না হয়। আমরা কি শিশুদের এ কান্না থামাতে পারি না? আমার মনে হয় ভর্তি হবার সমপরিমাণ মানসম্মত সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই এ কান্না থামাতে পারে। এর জন্য সরকারের নীতি ও উদ্দেশ্যের পরিবর্তন করতে হবে। সকল শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষার সাংবিধানিক দায়িত্ব রাষ্ট্রকে পালন করতে হবে। শিক্ষা নিয়ে ব্যবসার সুযোগ বন্ধ করতে হবে। কিন্তু পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার মূল দর্শনই হলো সব কিছুকে বেসরকারিকরণ করে ব্যবসা ও মুনাফা করার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রকি তার মূল দর্শন থেকে সরে আসতে পারে?
শাইনিং স্টার মডেল স্কুলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এবাদুল হাসান লিখেন-
হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসক মহোদয় সমীপে, (সদয় বিবেচনার্থে) জনাব, ভাল স্কুলে শিশু সন্তান ভর্তির জন্যে দেশের অন্যান্য জেলার চেয়ে ভিন্ন বা অতিরিক্ত মাত্রায় উদগ্রিব থাকেন হবিগঞ্জ শহরের অভিভাবকগণ। তাই যে বয়সে পড়া ও লিখা শেখার সাথে সাথে মেধাদৃপ্ত হয়ে বেড়ে উঠার জন্য ক্লাস ও খেলা সহযোগে দিন বছর অতিক্রম করার কথা, সেই বয়সে ২য় শ্রেণিতে উঠার সাথে প্রাইভেট মাস্টার আর কোচিং সেন্টারে দিনের প্রায় সবটুকু সময় ব্যয় করে। তাই মেধা বিকশিত না হয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়ে পরে।
আমার মতে সরকারি হাই স্কুলে ৩য় শ্রেণির ভর্তির জন্য মেধাদৃপ্ত শিক্ষার্থী বাছাই পরীক্ষা নিতে প্রয়োজন সহজ, পাঠ্যবই ভূক্ত বিষয় ভিত্তিক সৃজনশীল (গতানুগতিক ধারার প্রশ্ন নয়) প্রশ্ন যার মাধ্যমে পাঠ পড়ে বয়সানুযায়ী বুঝার ক্ষমতা, লিখার দক্ষতা, সমস্যা সমাধানের বুদ্ধিমত্তা ও পাঠে মনোযোগিতা সহজভাবে যাছাই করা যাবে এবং একই সাথে শিশুদের উপর কোচিং এর চাপ পরিহার করা যাবে। এর জন্য নমুনা স্বরূপ উন্মুক্ত মডেল প্রশ্ন আহবান করা যেতে পারে।
সৈয়দ এবাদুল হাসান, চেয়ারম্যান, শাইনিং স্টার মডেল স্কুল, হবিগঞ্জ।
ও সভাপতি, হবিগঞ্জ কিন্ডার গার্টেন এসোসিয়েশন।
এছাড়া আরও অনেকে নানা মন্তব্য করে ফেসবুকে পোস্ট দেন।
এদিকে অনেক অভিভাবক অভিযোগ করেন, ভর্তি পরীক্ষায় যে সকল শিক্ষার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে তাদের অধিকাংশই কেঁদেছে। আর যারা হাসি মুখে পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে বের হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে পড়–য়া শিক্ষার্থী। ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে যদি বয়স নির্ধারিত থাকতো তাহলে বেশি বয়সের শিশুরা পরীক্ষায় অংশ নিতে পারতো না। ফলে পরীক্ষা যত কঠিনই হোক যারা দ্বিতীয় শ্রেণি উত্তীর্ণ হয়ে তৃতীয় শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে তাদের মধ্য থেকেই ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেত। কিন্তু বয়স নির্ধারিত না থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় বয়স্ক শিশুরা চান্স পেয়ে যায়। তাই অভিভাবকরা ভবিষ্যতে তৃতীয় শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের বয়স নির্ধারণ করে দেয়ার দাবি জানান।
এদিকে মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত ভর্তি পরীক্ষা প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, তৃতীয় শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষা অনেক মানসম্পন্ন হয়েছে। প্রশ্নপত্রে একটি ফুলস্টপও বইয়ের বাহির থেকে করা হয়নি। যারা কোচিং বাণিজ্য করেন তারা একটি নির্দিষ্ট ধারায় শিক্ষার্থীদের পড়িয়ে থাকেন। এবার সেই ধারার ব্যত্যয় ঘটেছে। ফলে যারা কোচিং সেন্টারে দৌঁড়েছেন তাদের মনে হয়েছে বইয়ের বাহির থেকে প্রশ্ন করা হয়েছে। আর কোচিং সেন্টারে পড়–য়া ছাত্রছাত্রীরাই বেকায়দায় পড়েছে। তিনি গতকাল হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবে দৈনিক ইত্তেফাকের ৬৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন। প্রশ্ন কমন না পড়া প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি পরীক্ষার অনেকগুলো খাতা দেখেছি। অনেকেই ভাল করেছে। প্রয়োজনে আপনারাও দেখতে পারেন।