স্টাফ রিপোর্টার ।। নবীগঞ্জ শহরে সম্প্রতি দফায় দফায় একাধিক সংঘর্ষের জেরে ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ও যানবাহনে ভাঙচুর- লুটপাট এবং মোটরসাইকেলে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ব্যাপক ক্ষোভ ও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। ভাঙচুর ও লুটপাটে অন্তত ২৫ লক্ষাধিক টাকার ক্ষয়ক্ষতির দাবি করেছেন ভুক্তভোগীরা। নবগঠিত মার্চেন্ট এসোসিয়েশন ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীদের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে এবং ক্ষতিপূরণ আদায়ের আশ্বাস দিয়েছে।
এদিকে শহরজুড়ে এক ধরনের নৈরাজ্যকর অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে স্থানীয়দের অভিমত। গুজব ছড়িয়ে আনমনু ও তিমিরপুর গ্রামের মধ্যে বিদ্যমান উত্তেজনাকে উসকে দিচ্ছে একটি বিশেষ চক্র।

গত শুক্রবার রাতের সংঘাতের পর পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযান শহরের পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত করলেও পরদিন শনিবার সকাল থেকে আবার উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। আনমনু গ্রামের লোকজন দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নবীগঞ্জ শহর ও আনমনু পয়েন্টে জড়ো হতে থাকলে আতঙ্কে দোকানপাট বন্ধ করে দেন ব্যবসায়ীরা। শহরে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে।

শনিবার (৫ জুলাই) সকালে নবীগঞ্জ শহরে উপজেলার ৬নং কুর্শি ইউনিয়নের বাংলাবাজার এলাকার এক নিরীহ গাড়ি চালকের ওপর আনমনু গ্রামের লোকজন হামলা চালায়। চালককে আটকে বেধড়ক মারধরের পাশাপাশি তার গাড়িও ভাঙচুর করা হয়। এমনকি তার গলা বরাবর ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করা হয়। ভাগ্যক্রমে চালক সরে গিয়ে প্রাণে বেঁচে যান। এসময় গাড়ির চাবি, গাড়ির কাগজ এবং গাড়িতে থাকা দুটি ফোন ও টাকা লুট করে নিয়ে গেছে বলে জানান শ্রমিকরা। এ ঘটনায় শ্রমিকদের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা বিরাজ করছে।
শহরের সংঘর্ষের সময় সুযোগ নিয়ে হামলা ও লুটপাট চালায় একটি সংঘবদ্ধ চক্র। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বাজারে যখন আতঙ্কে নিরবতা নেমে আসে এবং কেউ থাকে না, তখন এই চক্রটি ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে ঢুকে হামলা ও লুটপাট চালায়।
গত দুই দিনে বাজারের অন্তত ২০-২২টি দোকানে ভাঙচুর ও লুটের ঘটনা ঘটে। ব্যাটারিচালিত মিশুক ভাঙচুর করে ব্যাটারি চুরি করা হয়েছে। এছাড়া আরো কয়েকটি মিশুক ভাংচুর ও মোটর সাইকেলে আগুন দেয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন, অনেকেই সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসেছেন। ২০২৪ সালেও অনুরূপ ঘটনায় আনমনু গ্রামের লোকজন বিভিন্ন দোকান থেকে মালামাল লুট করেছিল, যা পরবর্তীতে সালিশের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল।
ইনাতগঞ্জ ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি এবং সদ্য গণঅধিকার পরিষদে যোগ দেয়া আশাহিদ আলীর রহস্যজনক গতিবিধি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। তার সঙ্গে বিএনপি ঘরানার সাংবাদিক ও প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সেলিম তালুকদারের বিরোধ থেকেই মূল সংঘাতের সূত্রপাত হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার নতুন বাজার ট্রাফিক পয়েন্টে আশাহিদের সঙ্গে সেলিম তালুকদার সমর্থিত তিমিরপুর গ্রামের খরছু মিয়ার বাকবিতন্ডা হয়। একপর্যায়ে আশাহিদ দৌড়ে একটি দোকানে আশ্রয় নেন এবং আনমনু গ্রামের লোকজন তাকে সেখান থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালায়। এ সময় আশাহিদের সহযোগী বাদল মিয়া তার পক্ষে অবস্থান নেন। পরে তিমির পুর গ্রামের দুই শিক্ষার্থীকে বাজার থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করা হয়, যাদের পরে ছেড়ে দেওয়া হয়।
সংঘাত নিরসনে হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ সুজাত মিয়া, জামায়াত মনোনীত এমপি প্রার্থী মোঃ শাহজাহান আলী, উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক সরফরাজ আহমদ চৌধুরী, গণঅধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতা আবুল হোসেন জীবন প্রমুখ সালিশের উদ্যোগ নেন।
তিমিরপুর গ্রামের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ইনাতগঞ্জ থেকে পলাতক আশাহিদের বিভিন্ন অপকর্ম আড়াল করতেই এই অরাজকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। অপরদিকে, আনমনু গ্রামের অভিযোগ- নিরপেক্ষ তদন্ত ছাড়া তাদের অন্যায়ভাবে জড়িয়ে ফাঁসানো হচ্ছে।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, শহরে দফায় দফায় সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মধ্যে দোকানপাট ও যানবাহনে ভাঙচুর ও লুটপাট চলে। থমথমে পরিবেশ এখনও বিরাজ করছে।
নবীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শেখ মো. কামরুজ্জামান জানান, “দুই সাংবাদিকের ব্যক্তিগত ঝামেলা থেকে এই ঘটনার সূত্রপাত। আমরা বিষয়টি সমাধানের আহ্বান জানিয়েছি। সংঘর্ষ ও লুটপাটের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। তবে পুরো বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে রয়েছে।” নবীগঞ্জ শহরের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি কেবল সংঘর্ষ নয়, এর ছায়া পড়েছে রাজনীতি, ব্যবসা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থায়। সংঘর্ষের পেছনে জড়িতদের দ্রুত তদন্ত ও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হতে পারে বলে মনে করছেন স্থানীয় লোকজন।