তখনকার সময়ে কেউ বিএ এমএ পাশ করলে গ্রামের লোকজন তাকে দেখতে আসতেন ॥ চিকিৎসা বিজ্ঞানে এমবিবিএস পাশ করে প্রথম বাড়ি যাওয়ার পর আশেপাশের গ্রাম থেকে হিন্দু মুসলিম সবাই আমাকে দেখতে এসেছেন একজন বড় ডাক্তার মনে করে

ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব

জনাব আবদুল গণি মাস্টার (এম,এ) সাহেবের কথা বলছিলাম। তখনকার সময়ে কেহ বিএ, এমএ পাশ করলে নামের শেষে তা সাফিক্স হিসেবে জুড়ে দিতেন। কারণও ছিল, কয়েক গ্রাম মিলে দু’একজন স্নাতক বা স্নাতকোত্তর বিদ্যান পাওয়া যেত। বিদুষীতো প্রশ্নই উঠে না। গ্রামের লোকজন দেখতে আসতেন বড় পাশ দিয়ে আসা ব্যক্তিদের। বিএ, এমএ মানেই বিরাট সরকারি চাকুরে। চাল-চলন, কথা-বার্তা, জ্ঞান-গরিমায়ও সমাজে তাদের ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠত স্বমহিমায়। মনে পড়ে, চিকিৎসা বিজ্ঞানে এমবিবিএস পাশ করে প্রথম বাড়ি যাওয়ার পর এলাকার আশেপাশের গ্রাম থেকে হিন্দু মুসলিম সবাই আমাকে দেখতে আসতেন একজন বড় ডাক্তার মনে করে। সারাদিন চা-পানের আসর চলত আর আমার বাবা এতে ভীষণ আনন্দও পেতেন। সূতরাং আবদুল গণি সাহেব শুধু একজন উচ্চ শিক্ষিত আড়তদার মহাজন হিসেবেই নন, ভদ্র সজ্জন হিসবেও উত্তরাঞ্চলে ধান ব্যবসায়ী বা বেপারিদের নিকট সমধিক সমাদৃত ছিলেন। উনার অংশগ্রহণে এ ব্যবসাটা অত্র এলাকায় নিঃসন্দেহে অনেক মর্যাদাবান হয়ে উঠেছিল।
আবদুল গণি সাহেবের মেয়ের জামাতা ছিলেন ডাক্তার। আমি যখন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি তখন ডা. আবদুল হাই সাহেব কসবা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা। আমার বড়চাচার সাথে মোটামুটি আন্তরিকতা ছিল। তারপরও মেডিকেলে ভর্তির পরামর্শের জন্য গণি সাহেবের নিকট থেকে একখানা চিঠি সংগ্রহ করে আমাকে বিদ্যানুরাগী আমার ছোট চাচাকে দিয়ে ডা. আ. হাই সাহেবের এখানে পাঠালেন। আমরা কসবায় পৌছলাম বেলা দুটায়। পাকা টিনের চালের বড় বাসার প্রশস্ত বারান্দায় পঁচিশ ত্রিশজন রোগী। একহারা গড়নের সুদর্শন গৌর বর্ণের ডাক্তার সাহেব পা ভাঙ্গা এক রোগীর প্লাস্টার করছিলেন। শেষ হলে আমি চিঠিটা উনার হাতে দিলাম। আমার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে আমাদেরকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে বসালেন। অভিব্যক্তিতে মনে হল আমাদের ব্যাপারে পূর্ব থেকেই ওয়াকিবহাল।
ডাক্তার সাহেবের সুদর্শন চেহারা, বারান্দায় এত রোগী, উনার ব্যবহার সব মিলিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতি আমার আকর্ষণ বেড়ে গেল অনেক। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার সাহেব এসে আমাদেরকে ভেতরের রুমে ডাকলেন। খাবার টেবিলে নানাবিধ পদসহ ভাতের প্লেট সাজানো। তবে মাগুর মাছের সুস্বাদু ভুনার স্বাদ আজো স্মৃতিপটে জাগরূক।
২০০৭ সাল, আমি তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজে চাকুরীরত। বিভাগীয় প্রধান আহমদ হোসেন স্যার স্লিপ দিয়ে একজন বয়স্ক ভদ্রলোককে পাঠালেন আল্ট্রাসনোগ্রাম করে দেয়ার জন্য, নাম ডা. আবদুল হাই। জিজ্ঞেস করলাম আপনি কি কোন সময় কসবা ছিলেন? যা প্রায় বত্রিশ বছর পূর্বেকার কথা। বললেন জ্বী, কক্সবাজারের সিভিল সার্জন থাকা অবস্থায় সদ্য অবসরে গেলাম। আল্ট্রাসনোগ্রাম শেষ করে পরে আহমদ হুসেন স্যারের রুমে বসে চা খাওয়ার অবসরে আমি আমার পুরোনো স্মৃতি তুলে ধরে মাগুর মছের গল্প বললাম। ভদ্রলোক বিস্মিত এবং তৎসঙ্গে আনন্দিত হলেন। ব্যস্ততার কারণে চেষ্টা করেও উনাকে বাসায় নেয়া সম্ভব হল না।
আমরা মেঘনা ও শীতলক্ষ্যার বিস্তৃত জলরাশির মোহনায় পৌঁছে গেলাম। এখান থেকে কয়ক কিলো উজানে শীতলক্ষ্যা দিয়ে মদনগঞ্জ পৌছাতে হবে। পড়ন্ত বেলায় ধানের ও জেলেদের শত শত নৌকার সমারোহ বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এক অনুপম দৃশ্যের অবতারণা বটে। শুধু উজান তথা উত্তর পূর্বাঞ্চল থেকেই নয়, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কিয়দংশ থেকেও অভিনব আকৃতির বেশ বড় বড়, একেকটা প্রায় দেড় দুই হাজার মণ ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন নৌকা চোখে পড়ল। জেলেদের নৌকা ঘিরে আকাশে শত শত শ্বেতশুভ্র উড়ন্ত গাংচিলের নিঃশব্দ ছন্দময় মছ ধরার প্রচেষ্টা। ভাদ্রের তাল নীরাইয়ে ঢেউহীন শান্ত মোহনা, জেলের জালে মাছের বিরামহীন লাফালাফি, অগণিত নৌকায় নামানো পালের খাড়া মাস্তুলে ঝুলন্ত রশির মোহনীয় দৃশ্য আজো স্মৃতির দুয়ারে কড়া নাড়ে।
সবাই দাঁড় টেনে উজান বেঁয়ে চলছেন। প্রতিটি নৌকায় অনেকগুলো দাঁড়ের একসঙ্গে পানিতে উঠানামা মনে হচ্ছিল সমস্ত নদীজুড়ে অঘোষিত এক নৌকা বাইচ। মাঝে মাঝে লঞ্চ ও বালু এবং পাথর বোঝাই কার্গো চলাচল দ্বারপ্রান্তে নগর সভ্যতার আভাষ দিচ্ছিল। ছইয়ের উপর বসে নীরব নিথর গ্রাম বাংলার রূপ-প্রকৃতি আর শহরঘেষা যান্ত্রিকতার ছোঁয়া এ দুয়ের ব্যবধান খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। একদিকে বর্ষায় অলস গ্রামীণ মানুষ হাতে যাদের অফুরান সময় আর অন্যদিকে এখানকার ব্যস্ত মানুষজন যাদের দেখে মনে হচ্ছিল যেন হাতে নেই একটুখানি সময়, একটুখানি অবসর।
গন্তব্যে পৌঁছার পথ যেন শেষ হচ্ছিল না। আসলে কোন গন্তব্যের শেষ পর্যায়ে এমনটাই হয়। যেন তাল গাছের আড়াই হাত অর্থাৎ সাড়া গাছ বেঁয়ে উঠে শেষের আড়াই হাত উঠা যতটুকু কষ্টের ঠিক তেমনি।
চলবে…..