জালাল আহমেদ
‘দরিয়ার পাড়ের দৌলতি’ আমার পড়া চরাঞ্চলের উপর লেখা সেরা উপন্যাস

আমি যখন দীর্ঘ তিনমাস অপেক্ষা করার পর দায়িত্ব পেলাম তখন নিজেকে ভাগ্যবানই ভাবছিলাম। একই অবস্থায় পরে আমার ব্যাচমেট আবুল হোসেন কুমিল্লায় দায়িত্ব না পেয়ে, গাজীপুরে যোগদান করে। অল্প কিছুদিন পরেই সে কুষ্টিয়াতে বদলী হয় এবং কুষ্টিয়া থেকে জামালপুর জেলা পরিষদে যোগদান করে। আমার বন্ধু তারিকুল ইসলাম এর নোয়াখালী থেকে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক কুমিল্লা পদে পদায়ন হলে তাঁকে যোগদান না করার পরামর্শ দেয়া হয়। তবে সে পরে তিন বছর কুমিল্লায় জেলা প্রশাসক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছে। যেহেতু বিএনপি’র এমপি সাহেবদের হস্তক্ষেপে আমার এই ভোগান্তি এতে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ভাবলেন যে আমি নিশ্চয়ই আওয়ামী ঘরানার কর্মকর্তা।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ হানিফ, নোয়াখালী পৌরসভার চেয়ারম্যান রবিউল হোসেন কচি কালেক্টরেটে আসলে আমার রুমেই বসতেন। শুরু থেকেই প্রেসের সংগে আমার একটি সুসম্পর্ক হয়ে যায়। তাঁরা খুব কাছ থেকে আমার তিনমাসের অপেক্ষাকালও দেখেছেন। কারণ আমি প্রায় সারাদিন কাটাতাম কালেক্টরেট ভবনে মূলতঃ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের রুমে। সাংবাদিকদের কারো কারো সংগে এই ২৫ বছর পরও আমার সম্পর্ক অক্ষুন্ন রয়েছে। বিশেষ করে আমার মনে পড়ে তৎকালে জনপ্রিয় পত্রিকা জনকন্ঠের সাংবাদিক ভাষা সৈনিক কামালউদ্দিন আহমদের কথা।
সৈয়দ শামসুল হক লিখেছিলেন আমাদের জলেশ্বরীতলায় দুই মফিজ, ধর মফিজ আর কাট মফিজ। সেটা ছিল উপন্যাসের কল্পিত জগতের কথা কিন্তু বাস্তবে নোয়াখালীতে ছিল তিন কামাল। বাংলা কামাল, ইংলিশ কামাল আর প্রিন্স কামাল। এরমাঝে তখনকার জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক জনকণ্ঠ এর সাংবাদিক ইংলিশ কামাল লুঙ্গী জোব্বা পরে আর কাঁধে এক গামছা নিয়ে ঘুরে বেড়ান সারা জেলা। ¯্রােতের বিপরীতে চলা মানুষ, ভাষা সৈনিক। তাঁর লেখা দরিয়ার পাড়ের দৌলতি আমার পড়া চরাঞ্চলের উপর লেখা সেরা উপন্যাস। গুণী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন এই উপন্যাস নিয়ে সিনেমা করেছিলেন। প্রেসক্লাবের সভাপতি বকতিয়ার শিকদার ছিলেন অত্যন্ত স্মার্ট এবং ওয়াকিবহাল সাংবাদিক। চৌধুরী মনিরুজ্জামান, মোজাম্মেল হক মীরনসহ অনেকের সংগেই অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক রয়ে গিয়েছে।
নোয়াখালীতে কর্মকর্তাদের বসবাসের ভালো ব্যবস্থা ছিল না। সোনাপুরের ৮৫/৯০ বছরের পুরনো বাংলোগুলোর মূল অধিকারী ১৯৭১ সালে মাইজদী শহরে শিফট করার পর আর অত মনযোগ পায়নি। এই শিফটিং নিয়েও গল্প আছে। ১৯৭১ সালে নোয়াখালীতে পাকবাহিনীর প্রধান আস্তানা ছিল বেগমগঞ্জ টেকনিক্যাল স্কুল। তখন সিএসপি মনযুরুল করিম জেলা প্রশাসক, ডঃ মহিউদ্দীন খান আলমগীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। জেলা জজ ছিলেন স্বনামখ্যাত গাজী শামসুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে একবার মুক্তিযোদ্ধারা সোনাপুরে জেলা জজের বাংলোতে আসে এবং জেলা প্রশাসক ঐ বাংলোতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগে বৈঠক করেন। এর কোন প্রমাণ পাকবাহিনীর হাতে ছিল না কিন্তু তারা জেলা প্রশাসককে বাধ্য করে মাইজদির নির্মাণাধীন বাংলোতে চলে আসতে।
মাইজদিতে তখন এক সারিতে পাঁচজন কোর অফিসারের জন্য পাঁচটি বাংলো নির্মিত হচ্ছিল। মনযুরুল করিম ছিলেন আমার বন্ধু তারিকুল ইসলামের নিকটাত্মীয়। তারিক এর মায়ের গল্প যে সোনাপুরের ঐ বাংলোর দুঃসাহসী ইঁদুরকুল খাবার টেবিল থেকে শুধু পড়ে থাকা খাবার না, ছুড়ি-চামচও নিয়ে যেত। পাকবাহিনী একবার এডিসি ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীরকে বেগমগঞ্জ টেকনিক্যাল স্কুলে তাঁদের ক্যাম্পে যেতে বললো। তিনি গেলেনও কিন্তু ক্যাম্পের মেইন গেটে তাঁকে নেমে হেঁটে যেতে বলা হলে তিনি ক্যাম্পে প্রবেশ না করে ফিরে আসেন। পরে তাঁকে ময়মনসিংহে একই পদে বদলী করা হয়।
আমাদের কর্মকর্তাদের পারিবারিক পরিমন্ডলে আন্তরিক মেলামেশা ছিল। জেলা প্রশাসক পতœীও তাতে উৎসাহ দিতেন। সোনাপুর দিঘীর পাড়ে আমার বন্ধু অমূল্যভূষন বড়ুয়া একাই থাকতেন। অল্পদিন পরেই তাঁর জায়গায় এলেন ১৯৮৪ ব্যাচের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোখলেসুর রহমান, তিনি থাকতেন সপরিবারে। ফলে আমাদের দুই পরিবারে যোগাযোগ এবং যাতায়াত শুরু হয়। তাঁর মেয়ের নাম ছিল চৈতি। পরে দেখা গেল মোখলেসের স্ত্রী আমার স্ত্রীর দূর সম্পর্কে আত্মীয়াও বটে। দিঘী’র পশ্চিম পাড়ে ছিল এডিএম আব্দুস সোবহান সিকদারের বাসা। তাঁর পরিবারও সংগে ছিল, মেয়েরা ছিল। আমাদের দুই বাসার মধ্যে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। আরও পরে আজিমপুর কলোনী এবং ধানমন্ডির ৭ নং রোডের বাসায়ও আমরা একই কম্পাউন্ডে ছিলাম।
দিঘীর দক্ষিন পশ্চিম কোণে ছিল বাড নার্সিং স্কুল যেখানে আমার বড় ছেলে ভিক্টর পড়েছে তিন বছর। দিঘীর পাড় ধরে হেঁটে হেঁটে সে স্কুলে যেত, পরে এই দিঘীতে তাঁর সাঁতার শেখারও শুরু। দিঘীর পাড়ে আর কোন অফিসার থাকতো না।
তারা থাকতো মাইজদিতে। মাইজদিতে ছিল স্টাফ কোয়ার্টার, অফিসার ও স্টাফদের জন্য। বাসাগুলো ছিল পুরনো, লোনা ধরা আর রক্ষণাবেক্ষণ ছিল খুবই খারাপ। আমার বন্ধু তারিকুল ইসলাম সপরিবারে থাকতো সেখানে। তাঁর ছেলে মেয়েরা, ফাইয়াজ ও টুম্পা আমার ছেলেদের প্রায় সমবয়সী ছিল এবং তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্বও ভালো ছিল। ভাবি রেহেনা বেগম এর পৈত্রিক বাড়ি রামগতি আর তারিকের বাড়ি বরিশাল। ফলে “আমার বাপে বরিশাইল্যা আমার মায়ে নোয়াখাইল্যা” গানের কথা মনে পড়তো। ভাবী ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে এসি ল্যান্ড জাফর এর ক্লাসমেট। আমার বন্ধু তারিক ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লোকপ্রশাসন বিভাগে আমার সিনিয়র। আমি সারাজীবন বাজার ফাঁকি দেয়া মানুষ কিন্তু নোয়াখালীতে তারিকুল ইসলামের সংগে নিয়মিত সপ্তাহে দুইদিন দত্তের হাট বাজারে বাজার করতে যেতাম। ভাবিও বাচ্চাদের নিয়ে বেড়াতে আসতেন আমাদের সোনাপুরের বাংলোতে। অন্য অফিসারদেরও কেউ কেউ স্টাফ কোয়ার্টারে থাকতেন।
বাকীরা কেউ কেউ থাকতেন অফিসের পেছনে ইম্প্রোভাইজড বাংলোতে। এখানে উল্লেখ্য যে আমি সোনাপুরে যে বাংলোতে থাকতাম তার যে অবস্থা ছিল তাকে অনায়াসে গণপূর্ত বিভাগকে দিয়ে ইম্প্রোভাইজড ঘোষণা করিয়ে আমি সরকার থেকে ভাড়ার টাকা গ্রহণ করে নির্দিষ্ট ভাড়ায় থাকতে পারতাম। কিন্তু আমি এই ধরণের প্রস্তাবে সায় দেইনি। কারণ বাংলোর মান যাই হোক তা ছিল ওল্ড কালেক্টরস বাংলো, এতে জমি ছিল ৬/৭ বিঘা, গাছপালা ছিল প্রচুর। ফলে সরকারি এত সুবিধা ভোগ করে কম ভাড়া দিতে আমি নৈতিকভাবে সমর্থন করিনি।
কালেক্টরেটের পেছনে এক সারিতে ৫/৬ টিনশেড বাংলো ছিল। এদের একত্রে বলা হত ম্যাজিস্ট্রেট কলোনী। এখানে সদর উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট, হাওলাদার জাকির হোসেনসহ বেশ কয়েকজন পরিবার নিয়ে থাকতো। সেখানে বেশি গিয়েছি বোধহয় কামাল-খোদেজা খানম দম্পতির বাসায়। কাছেই একটি বাসায় সপরিবারে ভাড়া থাকতো মো. জাফর আলম, তাঁর বাসায়ও অনেকবার গিয়েছি। ভাবি ছিলেন অতিথিপরায়ন। ১৯৮৪ ব্যাচের ভূমি হুকুম দখল কর্মকর্তা মুজিবর রহমানও ভাড়া বাসায় থাকতো। তার বাসায়ও বেড়াতে যেতাম। দিলীপ সাহা, শাহ আলম মৃধা, মো. শাহজাহান মিয়া থাকতো লইয়ারস কলোনীতে।
আমি আগে উল্লেখ করেছি যে বিকেলে অফিস থেকে বাসায় এসে ড্রাইভার জসিমকে ছেড়ে দিতাম। বিকেল-সন্ধ্যা-রাতে আমি নিজেই গাড়ি চালাতাম। তা’ শহরের কোন সহকর্মীর বাসায় যাওয়া হোক বা মাইজদী বুক স্টোর বা চরের দিকে দল বেঁধে ঘুরতে যাওয়া হোক। ঐ সময়ে একটি বৃহত্তর পরিবারের মতো সবাই নোয়াখালীতে মিলেমিশে থেকেছি।