জালাল আহমেদ
রাতে শুনলাম ইউএনও শাহাবউল্লাহ আর মুন্সেফ মাহবুবুল আলমের মাঝে অপ্রীতিকর ঘটনা শারীরিক আঘাত পর্যন্ত গড়িয়েছে

চাঁদপুর শহরে গেলে প্রধান সড়কের পাশে রেলওয়ে লেকে অংগীকার এর উপর চোখ পড়বেই। চাঁদপুর শহরের এক অন্যতম প্রধান ল্যান্ডমার্ক এই মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য। এর শুরুর দিকে যুক্ত থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। জেলা প্রশাসক এস এম শামসুল আলম কথা প্রসঙ্গেই এ ধরণের একটি স্মারক নির্মাণে তাঁর ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। এরপর এটি জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভার বৃহত্তর ফোরামে আলোচনা করা হয় এবং প্রস্তাবটি সবার সমর্থন পায়। এরপর এ বিষয়ে বিশেষ সভা ডাকা হয়, সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়ে আলোচনা হয়, ডিজাইন নিয়ে কথা হয়। চাঁদপুর কালেক্টরেট রেকর্ড রুমে যদি অংগীকার এর ফাইল পাওয়া যায় তবে তার একদম শুরুতেই আমার নিজের হাতে আঁকা নকশা পাওয়া যাবে যা বর্তমান ডিজাইনেরই বেসিক ড্রইং, শুধু উপরের স্টেনগানসহ হাতটি সেখানে নাই, আমি তখনো চিন্তা করছিলাম যে উপরে কি দেয়া যায়। যখন ‘অপরাজেয় বাংলা’র ভাস্কর সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ এর সঙ্গে যুক্ত হন তখনই নকশাটি সম্পূর্ণ হয়। আমরা তহবিল সংগ্রহে লেগে যাই, মূলতঃ উপাদান সংগ্রহে নামি। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ইট, বালি, সিমেন্টের পর ইট বিক্রি করে পাথর আর মজুরির টাকা প্রয়োজন হয়। অংগীকার এর নির্মাণ শেষ হবার আগেই আমি চাঁদপুর থেকে বদলী হয়ে যাই কিন্তু তখনো এবং এখনো মুক্তিযুদ্ধের স্মারক এই ভাস্কর্যের একটি বিশেষ স্থান আমার মনে রয়ে গিয়েছে। এখন ভালো লাগে ভাবতে যে চাঁদপুরের এই আইকনিক ল্যান্ডমার্ক এর সঙ্গে আমি যুক্ত ছিলাম।
মনে পড়ে মতলব উপজেলার বর্তমানে ছেঙ্গারচর, সুলতানপুর ইউনিয়নের নির্বাচনের কথা। নিয়মিত নির্বাচনে সেখানে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৮৪ ব্যাচের অফিসার আতাউল হক। সেখানে ভোটগ্রহন বাতিল করতে হয় এবং শান্তি শৃংখলা রক্ষায় পুলিশকে ৫ রাউন্ড গুলিও করতে হয়। এ নিয়ে আতাউল হক একটু নার্ভাসও ছিলেন। পুনঃনির্বাচনে আমাকে পাঠানো হয় বিপুল সংখ্যক পুলিশ সঙ্গে দিয়ে। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন এএসপি আহমদ শফি, বয়স্ক পুলিশ অফিসার। তখন ভাটি বর্ষা, সুলতানপুর মেঘনা-ধনাগোদা প্রকল্পের বাঁধের ভেতরে, চারিদিকে বর্ষার পানি, ৫৭ জন পুলিশ নিয়ে নৌকাযোগে আমরা সেন্টারে গেলাম। পুনঃনির্বাচনেও ঝুঁকি ছিল এবং চারিদিকে ককটেল বিস্ফোরণ সে পরিস্থিতির জানানও দিচ্ছিল। পুলিশ পুরোপুরি রক্ষণাত্মক পজিশনে তৈরী ছিল। প্রার্থীদের একজন ছিল স্থানীয় মন্ত্রীর আনুকূল্যপ্রাপ্ত এবং সরকারি দলের। সে তো শুধু আমার চারপাশে ঘুরে আর সাহায্য চায়। আমি বলি আপনি ভোটার নিয়ে আসেন, ভোটার ছাড়া তো ভোট হবে না। দিনশেষে ২৬০০+ ভোটের মধ্যে কাস্ট হল ৪০০+, মন্ত্রীর প্রার্থী পেলো ১০০ ভোট এবং সামগ্রিক নির্বাচনে সে নিশ্চিত পরাজিত। দলবল নিয়ে মতলব ফিরলাম এরপর চাঁদপুর, এর মধ্যে খবর পৌছে গিয়েছে। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহাংগীর হোসেনের বাসায় এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে ছিলেন, সেখানে এসে রিপোর্ট করলাম। জেলা প্রশাসক মহোদয় একটু হতচকিত কিন্তু বললেন ঠিক আছে, গিয়ে রেস্ট নাও। মন্ত্রীর ক্রোধ আর আমাকে স্পর্শ করে নাই। শুধু এটা না, এরচেয়েও মারাত্মক একাধিক ঘটনার আঁচও এস এম শামসুল আলম আমার গায়ে লাগতে দেননি।
চাঁদপুর নদী বন্দর, পুরান বাজার ব্যবসা কেন্দ্র হিসাবে বিখ্যাত ছিল। পুরান বাজারে ছিল অনেকগুলো লবন মিল। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার থেকে হার্মাদ জাহাজের চেহারার বোটে করে অশোধিত লবন নিয়ে আসা হতো এবং তা এখানে পরিশোধিত হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেতো। আর চাঁদপুরের ইলিশ প্রসেসিং ফ্যাক্টরীগুলোতো আছেই। পাটের ব্যবসাও ছিল চাঁদপুরের প্রাণ। তবে শিল্পায়ন তেমন ছিল না। চাঁদপুরে ছিল ডাব্লিউ রহমান জুট মিল ও স্টার আলকায়েদ জুট মিল এবং হাজিগঞ্জে নাহিদ জুট মিল। এ ছাড়া জুট বেলিং এন্ড প্রেসিং ফ্যাক্টরীগুলো ছিল। চাঁদপুরের জুট মিল দুটোই ব্যক্তি মালিকানাধীন এবং তখনও লোকসানী ছিল। শ্রমিক বেতন বকেয়া পড়তো এবং দুই মিলের জেনারেল ম্যানেজারই কিছুদিন পর পর ঘেরাও হয়ে যেতেন। একবার স্টার আলকায়েদ জুট মিলের জেনারেল ম্যানেজারকে উদ্ধার করতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) সহ আমি যাই এবং শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে কয়েক ঘন্টা নেগোশিয়েসনের পর একপর্যায়ে শ্রমিক নেতারা তাঁকে মুক্তি দিতে রাজি হন। কিন্তু ডাব্লিউ রহমান জুট মিলের সমস্যার সমাধান এতো সহজে হয় নাই। একরাত একদিন গেলে বিষয়টা বিপদজনক দিকে মোড় নেয় কারণ জিএম ছিলেন বয়স্ক মোটা মানুষ। গোপনে ব্যাটালিয়ন আনসার অধিযাচন দেয়া হয়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুহিলপুর থেকে আনসার আসতে থাকে, আমরাও অপেক্ষায় থেকে ঘুমিয়ে যাই। রাত দুইটায় এসে ব্যাটালিয়ন আনসার পৌঁছায়, আমি ডাকবাংলো থেকে লন্ডন ঘাটে যাই, রাত ২ঃ৩০ টায় ডাকাতিয়া নদী পার হয়ে অতর্কিতে হামলা চালানো হয়, শ্রমিকরাও ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। রীতিমত খন্ডযুদ্ধের পর আমরা বাংলো দখল করে জেনারেল ম্যানেজারকে উদ্ধার করি। এটা ছিল আমার জন্য একটা বিপজ্জনক এবং ভিন্ন ধরণের অভিজ্ঞতা।
এই সময়ে একবার তৎকালীন ফার্স্টলেডী রওশন এরশাদের ভ্রমন প্রোগ্রাম পাওয়া গেল। তিনি সরকারী শিশু সদনে যাবেন, মহিলা কলেজে যাবেন আর দুপুরে লাঞ্চও করবেন। আমি নাজির সাহেবকে বললাম এইবার যেন মিস না হয়, ডাল রান্না আগে। নির্দিষ্ট দিনে তিনি এলেন। মহিলা কলেজে আমি ছিলাম, সেখানে ডিসপ্লে এবং সংক্ষিপ্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। কলেজ অধ্যক্ষ মতিউর রহমান ব্যবস্থাপনায় দক্ষ ছিলেন। পরে লাঞ্চের সময় মজা, খেতে বসেই ফার্স্টলেডী বললেন যে আমরা নাকি প্রেসিডেন্টকে ডাল খাওয়াতে পারি নাই। বললাম, ম্যাডাম, আজ প্রথমেই ডাল রান্না করা হয়েছে, কোন মিস যেন না হয়! কত ছোট খাট জিনিসও যে মানুষ মনে রাখে আর রিপোর্ট হয়!
একদিন বিকেল আমি আমার অফিস রুমে বসে আছি, তখন এসপি সাহেব এলেন পাশেই জেলা প্রশাসকের বাংলোতে। আমিও রুম থেকে বের হয়ে বাংলো অফিসে গেলাম। দেখলাম জেলা প্রশাসক রেডি হয়ে বের হয়ে এলেন, তাঁরা দু’জনেই হাজীগঞ্জ এর দিকে বের হয়ে গেলেন যেমন সবসময়ই যান। কিন্তু সিএ সাহেব বললেন যে জেলা জজ সাহেবও যাচ্ছেন। এটা একটু ভিন্নতর, ভাবলাম যে কি হল? রাতে শুনলাম ইউএনও শাহাবউল্লাহ আর উপজেলা মুন্সেফ মাহবুবুল আলমের মাঝে একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে যা শারীরিক আঘাত পর্যন্ত গড়িয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে ইউএনও সাহেব বদলী হয়ে গেলেন খাগড়াছড়ি সদর উপজেলায়। উপজেলা মুন্সেফও বদলী হয়ে গেলেন বাঁশখালী উপজেলায়। সেখানে তাঁর সঙ্গে আমার আবার দেখা হয় ১৯৮৮ সালে সে গল্প পরবর্তীতে আসবে।